গল্প দায়িত্বের_সংসার পর্ব ৪৪

 #দায়িত্বের_সংসার 

#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)

#পর্বঃ৪৪


এপার্টমেন্টে ফিরে এসে অতসী দ্রুত ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পড়ে নিলো। সায়ান অতসীকে শাড়িতেই পছন্দ করে। ফ্রিজ থেকে মুরগির মাংস বের করে নিয়ে দ্রুত ভুনা খিচুড়ির প্রিপারেশন নিচ্ছিলো। ইতিমধ্যে সায়ান ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। কলিংবেল বেজে উঠতেই সায়ান বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে লাগেজ হাতে। 


অতসীর যখন রান্না শেষ হলো তখন সায়ান কাউচে বসে ল্যাপটপে কিছু করছিল।অতসী পাশে বসতেই দেখতে পেলো ল্যাপটপের স্ক্রিনে আর কিছুই না কিচেনের সব কিছু দেখা যাচ্ছে। কয়েক মুহুর্ত সময় লাগলো পুরো বিষয় বুঝতে। এর মানে হচ্ছে মি.সায়ান মাহমুদ অতসীকে নজর বন্দী করে রেখেছিল।পুরো বাসায় সিসি ক্যামেরা ইন্সটল করা। 

পা তুলে অতসী সায়নের পিঠের উপর ভর দিয়ে বসে। এখানে আসার পর একবারও কথা বলেনি সায়ান৷ 

অভিমান? হুম! তাইতো। 


"মি.মাহমুদ!  আপনি এখানে কেনো এসেছেন? মিস করছিলেন আমায়? " 

"না!" 


অতসী ভেবেছিল উত্তর হ্যাঁ হবে কিন্তু না!  মুখের উপর না! এ বড্ড অন্যায়!  


"তবে কেনো এসেছেন? আমি তো আপনাকে মিস করিনি! "


সায়ান অতসীর কথার উত্তর না দিয়ে উঠে চলে যায়। ফিরে আসে হাতে খাবার নিয়ে। প্রায় তিনমাস পর অতসী আজ সায়ানের হাতে খাবার খাবে। খুশিতে ডগমগ। 

সায়ান অতসীর মুখের দিকে খাবার তুলে দিয়ে শান্ত গলায় বললো


"তোমার কলিগরা জানে না তুমি বিবাহিত?"

"কি জানি!"

"কখনো বলো নি?"

"কেউ জিজ্ঞেস করেনি তো! আচ্ছা, আপনি বলেছেন আপনি আমার সাথে এসেছেন তাহলে এতদিন কোথায় ছিলেন? "


অতসীর কথায় সায়ান বাম পাশের জানালার দিকে ইশারা করে। তারমানে অতসীর ধারণা ঠিক। কেউ একজন জানালার পর্দার আড়ালে অতসী কে দেখতো ।কেউ যে অতসীকে ফলো করে এমন কথা সায়ান কে অতসী বলেছিল। কিন্তু সায়ান কথা গায়ে মাখেনি। আজ বুঝতে পারছে কেনো গায়ে মাখেনি। 


"মি.মাহমুদ!  আপনার ব্যবসা- বানিজ্য তো লাটে উঠবে! 

" কেনো?"

"বাহ্! আপনি এখানে আমার সাথে থাকবেন, দেশের বাহিরে তাহলে ওসব কে দেখবে? " 

"কাল সকালে বুঝতে পারবে।"


খাওয়া শেষে সায়ান উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে লাইটস অফ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়৷ অতসী কি ভেবেছিল কাল রাতেও যে সায়ান আজ এভাবে এখানে থাকবে?

সায়ানের হাতে হাত রেখে অতসী বললো 


"মি.মাহমুদ!  অভিমান?"

"নাহ্!"

"তাহলে কথা বলছেন না কেনো? "

"কারণ অতসী তুমি সব বুঝতে পারো, শুধু আমায় ছাড়া। " 

"ভালোবাসি তো!"


অতসীর কথায় সায়ান ধড়ফড়িয়ে উঠে লাইট অন করে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে 


"কি বললে?"

"ভালোবাসি তো!"

"সিউর তুমি?"

"নাহ্! আমি সিউর হবো কেনো? সিউর তো হবে সাহারা আপু!  আহা কত প্রেম। যত্তসব"

"মেয়েদের নিজেদের মধ্যে  এই একটা গুণ খুব ভালো ভাবে রপ্ত করতে  জানে।তা কি জানো? আর যাইহোক প্রিয় মানুষকে যদি কেউ ভুলেও বলেছে যে  পছন্দ করে  তবে সারা জীবনেও তার নাম ভুলবে না এবং সময় সময় প্রিয় মানুষকে এটা নিয়ে খোটা অবশ্যই দিবে। " 

"ভালো করি।" 

"এটা বেশ!  অভিমান করার কথা আমার, আর এখানে উল্টো? "


সায়ানের কথায় উত্তর না দিয়ে অতসী নাক ফুলিয়ে বসে আছে৷ রাগ করলে মানুষ গাল ফুলিয়ে বসে থাকে কিন্তু অতসীর নাক ফুলে যায়। সেই ফোলা নাকেই টুক করে সায়ান একটা কামর বসিয়ে দিয়েছে। 

সে রাতে ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। শুরু হলো নিত্যনতুন ভাবে একে অপরকে আবিষ্কার করে নেওয়া।

কয়েকদফা ভালোবাসাবাসির পর ভোর রাতে কখন অতসী ঘুমিয়েছে নিজেও জানে না। কিন্তু সায়ান পুরো সময় জেগে রইলো। পুরো দুটো বছর এনালাইসিস কর‍তে ব্যস্ত সায়ানের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো অতসী ফোনে আসা কলে। 

ম্যাসেঞ্জারে এত সকালে কল? হিসেব করে দেখলো বাংলাদেশে তখন বেলা প্রায় এগারোটা। 


অনামিকার কল দেখে সায়ান মোটেও অবাক হয়নি। সায়ান জানে ইদানীং দুই বোনের মধ্যে বেশ সখ্যতা। বাবা-মায়ের ভুলের জন্য মাঝপথে দুবোন আলাদা হয়েছিল কিন্তু সময়ের স্রোত সব ঠিক করেছে। তবুও সায়ানের মনে অনামিকা কে নিয়ে একটা খুঁতখুঁত ভাব কাজ করে। হয়তো অনুশোচনা!  যাইহোক ফোন সাইলেন্ট করে রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সায়ান।


একজন সফল পুরুষের পিছনে যেমন একজন নারীর অবদান থাকে ঠিক তেমন একজন সফল নারীর পিছনে থাকে একজন পুরুষের অবদান।সায়ান অতসীর জন্য এক আশীর্বাদস্বরুপ অবদান রেখেছে। সবসময় ছায়ার মতো সাথে চলেছে, কেয়ার করেছে,শাসন করেছে,ভালোবেসেছে,ভুল শুধরে দিয়েছে। তাইতো ঠিক দুবছর পর আজকে সেই কাংখিত দিন এসেছে। 

Best women entrepreneur  এর খেতাব আজ অতসী পেতে চলেছে। দেশে, বিদেশে প্রায় ২০০ জন দরিদ্র নারীদের নিয়ে কাজ করে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পেরেছে। এতে দিহান, রাইমার অবদান কিন্তু কম নয়!  দিহানের হাত ধরে কাজের শুরু, কিন্তু সায়ানের সাথে পথচলা।

হ্যাঁ! দুই বছর পার হয়েছে। সায়ান নিজের বিজনেসকে মাল্টিন্যাশনাল করতে সক্ষম হয়েছে সেদিকে অতসী নিজেকে প্রমাণ করেছে। 


এমন একদিন সায়ানের অফিসে একটা পার্সেল আসে। নাম,ঠিকানা কিছুই নেই। শুধু সায়ানের নামে এসেছে এটাই। পার্সেল খুলে সায়ান হতভম্ব হয়ে বসে আছে।কিছুক্ষণ পর  দ্রুত উঠে ফিরে আসে অতসীর কাছে। 

অতসী তখন দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অনেক হয়েছে। এবার ফিরে যাবেই। সায়ান কে এসময় ফিরে আসতে দেখে অতসী উঠে দাঁড়ায়। ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?কিছু একটা টেবিলে রেখে ধীরেধীরে অতসীর দিকে এগিয়ে আসে সায়ান। 


অতসীর কথায় উত্তর না দিয়ে হাটু গেড়ে অতসীর সামনে বসে। পেটের দিকটার কাপড় সরিয়ে দিয়ে অজস্র ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছিলো। 

অতসী সায়ানের চুলে হাত রেখে বললো


"এত সহজে বুঝলেন কিভাবে?  আমি তো মনে করেছিলাম আপনি ভয় পাবেন। কে পাঠলো?  চিন্তায় থাকবেন আর আপনি?  আমার সব আশায় পানি ফেলে দিলেন। " 


সায়ান উঠে দাঁড়িয়ে প্যাকেট থেকে প্রেগন্যান্সি  কিট বের করে অতসীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে 


"এটা তুমি ছাড়া আর কেউ করবে না মিসেস.মাহমুদ!  রেজাল্ট পজেটিভ। আমি বাবা হবো। অথচ তুমি আমাকে না জানিয়ে নিজের মুখে না বলে কুরিয়ার করে আমাকে এটা পাঠিয়েছো।শুধু মাত্র আমি যেনো চিন্তায় থাকি কে পাঠাতে পারে? অথচ এটা চিন্তা করলে না? আমি তোমার সব পাগলামির সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত। তবে  এ ভারী অন্যায়!"


"অন্যায়?"

"তা নয় তো কি?  এভাবে সকাল সকাল সারপ্রাইজ দেয়? জানো কতটা দ্রুত ড্রাইভ করে এসেছি। এদিকে ট্রাফিক রুলস অন্যদিকে এই নিউজ। আমার মধ্যে কি চলছিল শুধু আমিই জানি। জরিমানা হয়েছে। আর আমি কখনো কারো জরিমানা মওকুফ করিনা। "


বেশ কয়েকদিন পর সায়ান-অতসী দেশে ফিরে আসে। অতসীর আদর যত্নে কমতি রাখছে না সায়ান। মাঝে বড়মা এসে অতসীর সাথে দেখা করেছে। 

অতসীর বাবার প্রতি দুই মেয়ের এখন কোন অভিযোগ নেই। বাবা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এটাই অনেক। অনামিকা এখন দরিদ্র বিধবা মহিলা,এতিমদের নিয়ে কাজ করছে। চেষ্টা করছে তাদের সুন্দর একটা জীবন উপহার না দিতে পারলেও যেনো স্বাভাবিক একটা জীবন দিতে পারে। কিন্তু রেদোয়ান কে মাফ করতে পারেনি। আদৌও পারবে কি না সে জানে না। তবে রেদোয়ান হাল ছাড়েনি। অনামিকার সাপোর্ট হওয়ার চেষ্টা সে করেই চলেছে। 


আজ সায়ানদের বাসায় সবাই একত্র হয়েছে। অনেকদিন পর পুরো ফ্যামিলি, দিহান-ইফাদরা সবাই একসাথে। 

কিন্তু সকাল থেকে অতসী বার চারেক বমি করে ক্লান্ত শরীরে গা এলিয়েছে মায়ের কাছে। এসির মধ্যেও ঘামছে সে। সায়ান অতসীর পায়ের কাছে বসে আছে। অনামিকা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছিল তখন রাইমা হাতে তেতুলগোলা পানি নিয়ে আসে। অতসীর দিকে এগিয়ে দিতেই অনামিকা বাধা দেয়৷ সবে মাত্র তিনমাস চলছে। 

রাইমা কে বাধা দেওয়ায় রাইমা বেশ খানিকটা মন খারাপ করে। কারণ সে ভেবেছিল অতসীর বমি এতে কমে যাবে। 


অনামিকা সায়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো 

-মি.সায়ান মাহমুদ!  নিজের জিনিসের খেয়াল নিজে রাখতে শিখুন। খেলা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। ভুলে যাবেন না "প্রতিটি চুনোপুঁটির পিছনে  রাঘব বোয়াল থাকে।" 


শেষ বাক্যে বলার সময় অনামিকার স্থির দৃষ্টি ছিলো  রাইমার দিকে। 


চলবে। 


#ছবিয়ালঃসায়েদ

0 Comments:

Post a Comment