#দায়িত্বের_সংসার
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ২৭
.
.
গ্রামের বিয়েগুলো শহরের মতো নয়। বিয়েবাড়ি মানেই চারপাশের যত পাড়া-প্রতিবেশী, আত্নীয়স্বজন আছে সব মানুষ সবাই এসে আড্ডা, খাওয়া, হাতে হাতে কাজ।
বিশেষত নানী-দাদীরা। হাসি-তামাশায় মাতিয়ে রেখেছে।
সায়ান-অতসী গ্রামে এসেছে মূলত বিয়ে উপলক্ষে। অতসী নিজের ঘরে বসে বাহিরে তাকিয়ে দেখছিলো। সবাই কত আনন্দে আছে। আজকে মেয়েটার হলুদ আবার বিয়েও৷ কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হবে অনুষ্ঠানগুলো।
কবিতা আবৃতি করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হলো না। কেউ একজন এসে জানিয়ে গেলো বড়মা ডাকছে।
.
.
ঘরের কাছে যেতেই নাকে এলো আতরের মিষ্টি গন্ধ। সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে অতসী।
.
-এসো! তুমি কি ক্লান্ত? বিরক্ত হলে?
-না! বিরক্ত হবো কেনো?
-কাল সকালে চলে যাবে তাই ভাবলাম এখন কথা বলবো তোমার সাথে৷ কিছুক্ষণ পর থেকে তো বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে ।
- আচ্ছা!
-তোমার প্রিয় রঙ?
-কালো
-প্রিয় কবি?
-রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্।
-প্রিয় মানুষ? যাকে তুমি অনুসরণ করো
- সর্ব শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী (সাঃ)
-তাহলে নিজে হেরে কেনো যাচ্ছো?
.
অতসী কোন উত্তর দিলো না। হয়তো কথার মানে বুঝেনি।
.
-বুঝো নি? এসো! আমার চুলে তেল দিয়ে দাও।
.
অতসী তেলের বাটি নিয়ে চুলে তেল দেওয়া শুরু করে।
.
--- মহানবীর চলার পথে যে বৃদ্ধা কাটা দিয়ে রাখতো, বিপদের সময় মহানবীর সেবা যত্নে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।
- জানো?
-জানি।
.
-সর্বকালের সকল মানবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানব,
কতটা সহ্য করেছেন আমরা সবাই জানি। আমরা মহানবীর উম্মত। আমরা কি হার মানতে পারি?
-অনেক সময় সহ্যের বাহিরে চলে যায়।
-তাহলে শোন! একটা গল্প বলি। গল্প না আমার স্বামীর কথা।
আমি তখন সবে মাত্র উনিশ বছর বয়সী তরুণী। আমার স্বামী এলাকার জমিদার। চারিদিকে বেশ নাম-ডাক। সবাই একনামে চিনে কারণ সুনাম খুব অল্প দিনে ছড়িয়ে পড়েছিলো। একদিন ফেরার সময় কোন এক জেলের ক্ষতি হয়। কারণ উনি বহর নিয়ে চলতো। নিরাপত্তার বিষয় ছিলো কি না! তাই। দোষ কার কি ছিলো জানার প্রয়োজন বোধ করেনি কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত, আঘাতপ্রাপ্ত জেলেকে বাড়ি নিয়ে আসে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, সুস্থ হলে আমার স্বামী জেলেকে বুকে জড়িয়ে মাফ চেয়েছিলো। এই কথার রটনা রটে গেলো। আমার স্বামী না কি জমিদার হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা,অত্যাচারী, অহংকারী, জাতপাত মানে না আরো কত কিছু।
একদল লোক, গুটিকয়েক মানুষ উনার নামে বদনাম ছড়াচ্ছিলো তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো এমন কিছু লোক যারা পাত বেড়ে আমার ঘরে ভাত খেয়ে যেতো। আমার খাবার খেয়ে, আমার স্বামীর নামে চলে আবার চারিদিকে বদনাম ছড়াচ্ছিলো। আমার তখন রক্ত গরম, সব দেখে আমিও বেশ রেগে গেছিলাম কিন্তু আমার স্বামী? কোন প্রতিক্রিয়া নেই। মনে হচ্ছিলো যেনো কিছুই হয়নি। তখন রাগ আরো বেশি হচ্ছিলো। একদিন রাগ দেখালাম কিন্তু উনি বললো
-------ইরানী! ওরা চাইছে আমি ওদের মুখ লাগি, কিছু করি কিন্তু এমন না। কহে যে বড় না, সহে যে বড়। শুধু শুধু তাদের কথা চিন্তা করে লাভ নেই। তাদের কাছে সময়ের মূল্য হয়তো নেই তাই তারা আমাকে নিয়ে ভাবছে, কথা বলছে। কিন্তু আমার তো এত সময় নেই গো, ওটুক সময় যে আমি অন্যকাজে ব্যয় করে ভালো কিছু করতে পারবো। তুমিও কিছু মনে রেখো না৷ দেখো না অন্যমনস্ক হয়ে আজ দুধের পেয়ালায় চিনির বদলে লবণ দিয়েছো।
.
লজ্জা পেয়েছিলাম এবং পরের চিন্তা করে আমার নিজের করা সেটাই ছিলো প্রথম এবং শেষ ভুল।
.
.
চুলে তেল দেওয়া শেষে অতসী বসে আছে। বড়মা চুল বেধে ঈশারা করলো অতসী কে কোলে মাথা রাখতে। অতসী চুপচাপ তাই করলো।
অতসীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বড় মা আবার বলা শুরু করলো
.
-আমি তোমার সম্পর্কে সব খোঁজ নিয়েছি। এতটা প্রতিবাদী অথচ নিজের বাবাকে কোন দিন কিছু বলো না কেনো?
-বাবা কে কিছু বলা যায় বুঝি? বাবা তো বাবাই। সন্তানকে বাবা যদি মারে, এটা মেনে নেওয়া যায় কিন্তু এর মানে তো এই না যে সন্তান বাবাকে আঘাত করবে।
-এটা শিক্ষা। যা তুমি তোমার মায়ের থেকে পেয়েছো৷ জানো তো হিন্দুধর্মের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। শকুনি মামার চক্রান্তে যখন ভাই ভাইদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিলো পুরো বংশ নিঃশেষ হয়ে যায়। শুধু পান্ডবরা পাঁচ ভাই বেঁচে ছিলো। শকুনি মামা যার কথা সব সময়
দুর্যোধন এবং তার ৯৯ জন ভাই শুনতো, মানতো সেই মামা কিন্তু তাদের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো।
.
তুমি সাহসী মেয়ে। এসব ঠুনকো বিষয়ে নিজেকে ছোট মনে করবে না। নিজের দায়িত্ব সবসময় পালন করবে। গুটি কয়েক মানুষের কথায় কান দিলে, নিজেকে আবদ্ধ করে রাখলে হয়তো আজকে দেশ স্বাধীন হতো না। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান কে কতটা হেনস্তা করেছিলেন আমরা স্বাধীনতার ইতিহাসে সবাই জানি। তবুও তিনি দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভেবে এগিয়েছিলেন বলেই কিন্তু আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
.
কথা শেষ করার আগেই সায়ান প্রবেশ করে। গা দুলিয়ে হেসে কোমরে হাত দিয়ে বলে
-বড় মা ! কি বলছো? যাকে বলছো সে কি জেগে আছে? ঘুমিয়ে গেছে। দেখো। মেয়েটা এত্ত ঘুমায়!
-তাতে কি হয়েছে?হয়তো ক্লান্ত
- উঁহু! ও ঘুমাতে ঘুমাতে ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে ।
উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সায়ান।
.
.
অতসীর যখন ঘুম ভাঙলো সায়ান কে দেখলো বড় মা খাইয়ে দিচ্ছে। আপন বলতে এই বড়মা শুধু আছে। অতসীর বেশ লাগলো। বড়মা হাত দিয়ে ঈশারা করলে পাশে গিয়ে বসলো।
বড়মা ভাতের লোকমা তুলে ধরলো। অতসী বিনা বাক্যে মুখে তুলে নিলেই সায়ান বললো
.
-এই ছিহ্ ! ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ না হয়ে কেউ খাবার খায়? তুমি কি অপরিষ্কার অতসী! ইয়াক
.
অতসী রাগে কটমট করে তাকালো সায়ানের দিকে। সায়ান বড়মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
-আচ্ছা বড়মা! আগে তো শুনেছিলাম এবাড়িতে জ্বীন আছে। এখনো কি আছে?
-কিছু জিনিস তো বাবা থাকেই।এরা বান্দা পড়ে যায়। বাড়ি ছেড়ে চাইলেও যায় না।
.
.
অতসী ঢোক গিলে সায়ানের দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো।
খাওয়া শেষে সায়ান অতসীকে জোড় করে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়।
.
-আমি সাতার জানি না মি. মাহমুদ! প্লিজ ভয় লাগে।
-আমি তো আছি।
-পানির স্রোত দেখুন। ভেসে যাবো তো।
-চুপ! চুপ! একদম চুপ।
-না ! প্লিজ
-এসো। না হলে রাতে জ্বীন আসলে আমাকে ডাকতে পারবে না।
.
এবার অতসী চুপচাপ পানিতে নামে। সায়ানের দুই হাত অতসীকে জাপ্টে ধরে আছে। অতসী এখনো চোখ বন্ধ। মনে হচ্ছে পায়ে এই বুঝি সাপে প্যাচিয়ে ধরবে।
সায়ান ধীরেধীরে আরেকটু গভীর পানিতে যাচ্ছিলো। হঠাৎ অতসী সায়ান কে বললো
.
-মি.মাহমুদ! আমাকে একটু উঁচু করবেন৷
.
সায়ান কোমর ধরে উঁচু করায় অতসী দুহাত রাখে সায়ানের কাধে।হঠাৎ অতসীর কি হলো সে নিজেও জানেনা। কিন্তু এক সুপ্ত ইচ্ছে যেনো পূর্ণতা পেতে চলেছে।
ভর সামলে হঠাৎ নামা এক পশলা বৃষ্টির মতো অবাধ্য চুমুতে ভরিয়ে দেয় সায়ানের গাল, কপাল এবং দুচোখের পত্রপল্লব।
.
.
চলবে
#ছবিয়াল_আশরাফুল
0 Comments:
Post a Comment