গল্প দায়িত্বের_সংসার পর্ব ২১

 #দায়িত্বের_সংসার 

#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)

#পর্বঃ২১

.

.

প্রথম সন্দেহ হয়েছিল সেদিন যখন আন্টি বললো তোর সাথে সায়ান ভাইয়ের বিয়ের কথা। প্রথমে আন্টি বলতে চায়নি। কিন্তু আমাদের জোড়াজুড়িতে বলতে বাধ্য হয়। তুই কি জানিস?  ইসলামে মায়ের পেটের দুবোনের জীবিত অবস্থায় একজনের সাথে বিয়ে হারাম?  প্রথম বউ তালাক হয়ে যায়?  

তোর বাবা জেনেশুনে কখনো এমন কাজ করবে না। যদিও অনামিকা আপুর সাথে সায়ান ভাইয়ের শুধুই রেজিষ্ট্রি করা বিয়ে তবুও বিয়ে তো!  বউ তো!  কালেমা পড়ে, কবুল বলে বিয়ে না হলেও তো অনামিকা আপু সায়ান ভাইয়ের বউ। সেখানে তোর সাথে সায়ান ভাইয়ের বিয়েটা যখন সব মেনে হলো তখন এই প্রশ্নটা উঠেছিলো। 

যখন দাদু বললো অনামিকা কে নিয়ে আসতেই হবে তখন তোর মা মুখ খুললো -অনামিকা কে সে পেটে ধরেনি। তার ঔরসজাত সন্তান শুধুই তুই। অনামিকা না। 

.

.

কথাগুলো বলে রাইমা অতসীর দিকে তাকালো। চোখেমুখে আংকের ছাপ। অতসীর হাত -পা কাপছে। হঠাৎ করে এত বড় কথা হয়তো নিতে পারছে না। রাইমা অতসী কে নিয়ে বটতলায় বসে। শক্ত করে ওর হাত ধরে বসে আবার বলা শুরু করে 

.

-তোর জন্ম মার্চ মাসে। আন্টির যেদিন লেবার  পেইন শুরু হয় সেদিন তোর একমাত্র ফুপু আয়েশা তোর মা কে নিয়ে হাসপাতালে যায়।তুই জন্ম নিস রাত ১.১৫ তে। হঠাৎ আন্টির ব্লাড লসের পরিমাণ খুব বেশি হয়, ইমিডিয়েটলি ব্লাডের প্রয়োজন পড়ে। তোর ফুপু অনামিকা আপু কে নার্সের কাছে রেখে রাতেই ব্লাডের জন্য বের হয় । সময় টা এমন ছিলো না গরম না শীত। 

সেসময় হুটহাট ঝড় শুরু হয়।তোর ফুপু একা গিয়েছিলো ব্লাড আনতে।কারণ সেরাতে  তোর বাবা ছিলো চিটাগাং।  

আন্টির গাড়ি ব্রেকফেল করে, অনামিকা আপুর মা মারা যায়। অনামিকা আপুর মা মারা যাওয়ায় সব থেকে বেশি কষ্ট পায় তোর বাবা কারণ তার বোন ব্যতীত এই পৃথিবীতে কেউ ছিলো না। অনামিকা আপুর বাবাও আপুকে নেয় না কারণ এক মেয়ের জন্য হয়তো জীবন থামিয়ে রাখতে পারবে না। তোর বাবা অনামিকা আপুকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করে এমনকি আংকেল এটা বিশ্বাস করে সেদিন যদি তোর জন্ম না হতো তাহলে হয়তো আপুর মা বেঁচে থাকতো। 

.

রাইমা কথাগুলো শুনে অতসী চুপচাপ বসে আছে। ও মনে হচ্ছে শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। বাবার এত অপমানের কারণ আজ বুঝতে পারছে। সত্যি তো কি এমন হতো যদি জন্মের পর সে মরে যেতো?  আচ্ছা?  জন্মের পর মরে গেলে কি বাবা আমাকেও মনে করে কাঁদতো? 

.

.

-এখনো ফিরে যাবি?  সায়ান ভাইয়ের কাছে?  

.

রাইমার কথায় অতসী মুচকি হেসে বললো

-আমার ক্ষণিকের ভালোবাসা আমি তোকে দিয়ে দিয়েচি রাই! অযত্ন করিস না। 

-অতসী প্লিজ পাগলামো করিস না!  ওসব তোর দায়িত্ব ! দায়িত্বের বেড়াজালে জড়িয়ে যাস না। অন্তত সব সত্যি জানার পর। 

-আজ থেকে দায়িত্ব আরো বেড়ে গেলোরে। 

.

.

অতসী আর বসেনি। আজ যেনো সে কাঁদতেও ভুলে গেছে। দৌড়ে সায়ানের কাছে চলে আসে। দূর থেকে দিহান কে এক পলক দেখেছিলো। ভালোই তো আছো দিহানজি। রাইমা তোমাকে সুখী করবে। আমার কি আছে?  কিছুই নেই। কিন্তু তুমি সুখী তো?  ভালো থেকো। 

সায়ান হাত বাড়িয়ে অতসীর হাত থেকে ফাইল নেয়। এগিয়ে দেয় আইসক্রীম। অতসী চুপচাপ নিয়ে গাড়িতে বসে খেতে শুরু করে। সায়ান আগের মতোই ঘারিন্দা বাইপাস হয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। 

অতসীর সব কিছু অস্বস্তি লাগছে। হিজাব খুলে চুল ছেড়ে দিয়েছে। আরো একটা কাজ হচ্ছে। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে চুলে। কেউ জানবে না দেখবে না। 

আজ সত্যি অনামিকার জন্য খারাপ লাগছে। মা মরে যাওয়ার পর সে বাবা কেও হারিয়েছে। অতসীর নিজের মা কখনো অনামিকা কে নিজের করে নিতে পারেনি। কারণ অতসীর নিজের মনে হচ্ছে মা সব সময় আমাকে বেশি আদর করতো।

.

.

-তোমার কি খুব খারাপ লাগছে?  

-নাহ্! 

-কিছু খাবে?  এক্সাম খারাপ হয়েছে? 

- উঁহু!  

-আচ্ছা এদিকে আসো গ্লাস অফ করে দিবো। 

- থাক না!  আপনি রাস্তা ভুলে যাচ্ছেন!  এটা বাসাইলের রোড। এদিক দিয়ে যেতে সময় বেশি লাগবে। তাছাড়া নলুয়ার ওদিকের রাস্তাও তেমন ভালো না। 

.

-মিস.বোটানি ডিপার্টমেন্ট!  আমরা বাসুলিয়া যাচ্ছি। শুনেছি ওখানে না কি একটা গাছ আছে যা কখনো পানিতে ডুবে না!  যত পানি আসুক না কেনো গাছের  নির্দিষ্ট অংশ পানির উপরে থাকে?  

-হুম! 

-এর কারণ কি?  

-জানি না। আজ অবধি দেখিনি। 

-আজ দেখবে। 

.

বাসুলিয়া পৌঁছে সায়ান দেখে অতসী ঘুমিয়ে গেছে। আইসক্রিমের চকলেট নাকের ডগায় লেগে আছে। টিস্যু ভিজিয়ে মুছে দিয়ে আলতো করে ছুয়ে ডাকছিলো অতসী কে। এই বুঝি সে ব্যথা পেলো।কিন্তু এই সায়ান যে মনে মনে অতসীর জন্য মরণ ফাদ পাতছিলো কে জানতো?  

.

.

.

.

ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে

  ও বন্ধু আমার!

না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে

  বুঝি গো রাত পোহালো,

 বুঝি ওই রবির আলো

 আভাসে দেখা দিল গগন-পারে--

সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে ॥

 আকাশের যত তারা

চেয়ে রয় নিমেষহারা,বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।

তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।

প্রভাতের পথিক সবে

এল কি কলরবে--

গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে!

বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে

.

.

বাবাকে চোখে আইড্রপ দিয়ে স্টাডিরুমে দিকে যেতেই কানে এলো বেহালা বাজিয়ে গাওয়া গান। বর্তমানে বাংলাদেশের সব থেকে সেরা 

 ফার্মাসিস্ট মি. রেদোয়ান রাকিব এগিয়ে যাচ্ছে তার একমাত্র বোন আফরিন  রওনকের  রুমের দিকে। 

রওনক  নাম টা সচরাচর ডাকে না। কিন্তু বাবার বেশ প্রিয় নাম। বরাবর আফরিন  বেশ ভালো রবীন্দ্র সংগীত গায় কিন্তু আজ বোনের গানের মাঝে বেশ কষ্ট অনুভব করছে সে। 

.

দরজায় নক করতেই দরজা খুলে গেলো। ব্যলকণিতে বেহালা নিয়ে বসে আছে আফরিন । চোখের গাঢ় কাজল যেনো দুচোখের পানির সাথে মিশে বেদনার রঙ প্রকাশ করছে। আলতো করে বোনের মাথায় হাত রাখে রেদোয়ান। 

ভাইয়ের স্পর্শ বুঝে কান্না বন্ধ করে হাসি মুখে তাকায় আফরিন। 

.

ভাইয়ের দিকে তাকাতেই চোখ পড়ে ভাইয়ের বুকের দিকে। ভাইয়ার শরীরের সব থেকে আরামের এবং পছন্দের জায়গা ছিলো বুক। ঘন লোমশ বুক। এতটা লোমশ ছিলো যা কাউকে সত্যি খুব আকর্ষণ করতে বাধ্য৷ 

কিন্তু ভাইয়া তার প্রেমিকার কথায় যেদিন বুকের লোম কেটে ফেলেছিলো সেদিন আফরিন  খুব কান্না করে। খুব!  অভিমানের জন্য ভাইয়ের সাথে কথা  অবধি বলেনি। তার প্রেমিকা তার বুকে মাথা রাখতো না এত লোমের জন্য তাই সে কেটে ফেলেছিলো কিন্তু এটা চিন্তা করেনি তার বোনের সব থেকে প্রিয় ছিলো। 

অথচ দিন শেষে সেই মহান মানবী ভাইয়া কে ছেড়ে চলে গেলো। ভাইয়া খুব ভেঙে পড়ে তখন কিন্তু এই আফরিন  সামলিয়েছিলো। 

এটাই মনে হয় নারী!  সে সব সামলাতে পারে কিন্তু নিজেকে পারে না। 

এক হাতে সংসার অন্য হাতে বাবার বিজনেস, নিজের লেখাপড়া আবার অসুস্থ বাবার দেখাশুনা দিন শেষে প্রিয় মানুষের একটা কলের অপেক্ষা। এসব তো নারীই পারে। পুরুষ মানুষ বাহিরে সারাদিন কাজ না করলেও ঘরে এসে সে ক্লান্ত অথচ নারী!  সে সারাদিন সব সামলিয়েও দিন শেষে তাকে প্রাণোবন্ত থাকতেই হবে। কারণ তার হাসিতেই যে পুরো পরিবার হাসে। 

.

ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে। 

.

-কিছু হয়েছে আমার পাখিটার?  

-না তো কি হবে? 

-কাদঁছিস কেনো? 

-কাঁদতে আবার কারণ লাগে?  

-হুম! বড্ড বড় হয়ে গেছিস!  

-ভাইয়া!

-বল!  

-আমি এখানে থাকবো না ভাইয়া!  আমি ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাক করতে চাই!  

-বেশ! যা চাইবি তাই!  তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম কারণ বাবার চিকিৎসা ওখানেই ভালো হবে আর তোর স্টা.....

(রেদোয়ানের কথাটা শেষ করতে দেয় না আফরিন। আগেই বলে উঠে) 

-আমরা যে যাচ্ছি কাউকে জানাবে না। এমন কি ইফাদ কেও না। 

.

.

সায়ানের ফোন বার বার করে ভাইব্রেট হচ্ছে। বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করলো। অপরপাশে থেকে কেউ একজন খুব উত্তেজিত হয়ে বললো 

.

-সায়ান যা করছিস ভেবে করছিস তো?  এতে অতসীর লাইফ রিস্কে পড়বে । এমনকি...

-হ্যাঁ! বুঝেই করছি কারণ আমি আর দু মন দু দশায় থাকতে পারছি না। 

.

.

চলবে

0 Comments:

Post a Comment