#বালির_সংসার
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
(পর্ব ১ থেকে ৩)
.
.
#পর্বঃ১
.
.
ক্লিনিকের আউটডোরে বসে অর্থি যখন বাইরের দিকে তাকিয়ে রুপকের জন্য অপেক্ষা করছিলো তখন রুপক অফিসের চেম্বারে
বসে নিশিতার মাঝে ডুবে যাচ্ছিলো।
হালকা ব্যথায় যখন অর্থি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিলো তখন রুপক নিশিতার ঠোঁটে ঠোঁট নাড়তে ব্যস্ত।
হালকা ব্যথা যখন মারাত্নক হয়ে উঠলো হাত পা কাপছিলো অর্থির, তখন রুপক উত্তেজনা নিয়ে আরো কাছে টেনে নেওয়ায় ব্যস্ত নিশি কে।
নিশির নাকের ডগায় জমা হালকা ঘাম যেনো মুক্তোকণা ঠিক সে সময় অর্থির শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।
.
যখন রুপক ভাবছে তার বেস্ট ফ্রেন্ড এত সুন্দরী হওয়া স্বত্বেও এতদিন কেনো অর্থির কাছে ছিলো?
তখন অর্থি ভাবছে হয়তো কাজ পড়ে গেছে না হলে রাস্তায় জ্যামে আটকে গেছে।
না হলে রুপক আসতে দেরী করার ছেলে না! তাও আবার আজকের দিনে?
রুপক যখন আবার নিশিতা কে কাছে টেনে দুই বছরের কন্ট্রাকে সিগনেচার করাচ্ছিলো, অর্থি তখন নিজের ডেলিভারি পেপারে নিজেই বন সই দিচ্ছিলো।
.
কি অদ্ভুত তাই না? একটা মেয়ে কতটা একা হলে, কতটা নিরুপায় হয়ে এই কাজ টা করে।
.
শুনেছি ২০ টা হাড় ভাংগার সমান হয় এই লেবার পেইন।
তারপরেও মেয়েটা বার বার রুপক কে কল দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।
শুধু একটা ইচ্ছে যদি একবার দেখতে পেতো!
ঠিক সতেরো মিনিট পর যখন অর্থি ছেলে জন্ম দিলো, রুপক আবিস্কার করলো এক নতুন নিশিতা কে।
মেদহীন পেটে যে এত মাদকতা আছে জানা ছিলো না। কিন্তু তখন তার স্ত্রীর পেট থেকে জন্ম নেওয়া সদ্য শিশুর নাভীর নাড় কাটা হচ্ছে।
নাড় জন্যেই তো নারী জন্মের আগেই সন্তানের সাথে আজন্ম বাধা পড়ে।
.
অর্থি সব শুনতে পারছিলো কিন্তু কিছু বলার শক্তি নেই। অবচেতন মনে শুধুই রুপ কে খুজতে লাগলো।
রুপ তো এমন করে না! আজকের দিনেই ব্যস্ততা? না কি কোন বিপদ হলো।
পুরোপুরি অজ্ঞান না হলেও নিজের উঠে গিয়ে কিছু করার শক্তি আর আজ অর্থির নেই।
কিন্তু আজ যে বড্ড প্রয়োজন তোমায় রুপ! কই তুমি?
.
.
ঠিক রাত তিনটের দিকে ঘুম ভাংলো রুপের।পাশে শুয়ে আছে নিশিতা।
এই মেয়ের মাঝে এত জাদু আছে জানা ছিলো না রুপের।
ফোন অন করতেই ম্যাসেজ এলো
You missed 419 calls from Mayaboti...
.
তারপর শুরু হলো ম্যাসেজের টুংটাং
.
- তুমি কি বিজি?
.
- আমার ভালো লাগছে না। অস্বস্তি হচ্ছে খুব
.
- কই তুমি? খুব ব্যস্ত?
.
- রুপ আমার ওয়াটার ব্রোক করছে! তুমি প্লিজ আসো।
.
- আমি আর খালা ক্লিনিকে যাচ্ছি।
.
.
আমরা এসেছি! ডক্টর, অপারেশন করতে চাচ্ছে। তুমি আসো না।
.
.
এই তুমি ঠিক আছো তো?
.
অটি তে ঢুকছি। জানি না আর দেখা হবে কি না। পারলে একবার এসো।
অভিমান না! আমি বুঝি কাজের চাপ তোমার ইদানীং বেশি। ভালো থেকো।
.
এর পর আর কোন ম্যাসেজ নেই।
বুকের ভিতর টা ধক করে উঠলো রুপের।
অর্থি! অর্থি ঠিক আছে তো?
রুপ যখন উঠতে যাবে তখন অনুভব করলো নিশিতা উঠে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে।
.
- রুপ! আমি তোর কাছে কোনদিন কিছু চাইনি। শুধু একটা রাত চেয়েছি। তুই আমার কাছে আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আজ তুই কোথাও গেলে আমি সত্যি মরে যাবো।
.
নিশিতার ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে রুপ মন থেকে চলে যেতে চাইলেও শরীর সায় দিলো না।
পরম আবেশে যখন নিশি দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে তখন মিটিমিটি চোখে তাকাচ্ছে অর্থি।
এখনো যে তার দুচোখ রুপকেই খুজছে।
.
.
#পর্বঃ২
.
.
অর্থি জমজ সন্তান জন্ম দিয়েছে। এক ছেলে এক মেয়ে।
কিন্তু এখনো ওদের কে স্পর্শ করতে পারেনি। ডক্টর আদিত্য আহমদ বললেন বাচ্চাদের জন্য স্পেস খুব একটা ছিলো না। ছেলেটা মোটামুটি সুস্থ আছে কিন্তু মেয়েটা কে অবজারভেশনে রাখতে হচ্ছে।
.
ভোরের দিকে অর্থির মনে হলো কেউ একজন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। তার মাথাটা ঠিক অর্থির বুকে।
চোখ না খুলেই বুঝতে পারলো এটা আর কেউ নয় রুপ।
যখন যখন দোষ করে ফেলে ঠিক তখন চুপচাপ এসে অর্থির বুকে মাথা রেখে চুপচাপ থাকবে, একসময় ঘুমিয়ে যাবে। নিজেও উঠবে না ওকেও উঠতে দিবে না। ঘুম থেকে উঠে
দেখবে অর্থির সব রাগ গলে পানি।
আচ্ছা রুপ কি জানে? ওদের দুজন বেবি হয়েছে?
.
নার্স এসে এভাবে দেখে রুপ কে ডাক দিতে চাইলে অর্থি ঈশারা করে কিছু না বলতে।
- আপনার কস্ট হচ্ছে না?
নার্সের প্রশ্নে অর্থি শুধু মাথা নেড়ে না বলে।
.
.
ঘুম থেকে উঠে রুপ দেখে অর্থি জেগে আছে।
রুপের অপমানবোধ কাজ করছিলো।
এই মেয়েটাকে এই সময় একা ফেলে যাওয়া ঠিক হয়নি।
আগে থেকে সে জানতো যে কিছু কমপ্লিকেশন আছে তারপরেও!
নিজের দুহাত দিয়ে অর্থি কে স্পর্শ করতে বিবেকে বাধছে।
সব থেকে কঠিন সময় এই সময়।
ভরসার হাত চেয়েছিলো মেয়েটা।
একটা সময় মেয়েটা রুপের জন্য সব ছেড়েছিলো।
কিন্তু আজ?
.
.
- আমাকে একটু পানি দিবা? গলা শুকিয়ে গেছে।
- মোটেই না! স্যালাইন চলছে।
- একটু। প্লিজ। না হলে মরে যাবো।
- না! একটুও না।
- আমি মরে গেলেতো তুমি খুশি হও। কালকেই বিয়ে করতে পারবা। কিন্তু আমার সন্তান দুইটা তো এতিম হবো।
.
কথাটা রুপের বুকে গিয়ে কাটার মতো বিধেছে। আচ্ছা ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে? না হলে এসব কেনো বলছে?
.
কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ম্যাসেজের শব্দ হলো
Nishi- tnkkkk u solo much.. Kal rate etttttto gula valobashar jnno.. Love u
.
রুপ রিপ্লে দিলো না। মোহে পড়ে হয়তো সে ভুল করেছে কিন্তু এক ভুল বারবার করলে সেটা পাপ হয়। ম্যাসেজ মিউট করে রেখে দিলো সে।
.
.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরো কয়েকটা দিন।
ছেলেকে কোলে পেয়েছে। কাল মেয়েকে দিবে। দিলেই ওরা বাসায় চলে যেতে পারবে।
এই কয়েকদিন রুপ অফিস,সাইট কোথাও যায়নি। শুধুই অর্থির কাছে ছিলো।
পুরো দুনিয়া যখন এখানে তাহলে ফোন দিয়ে কি হবে আর অর্থির খেয়াল রাখতেই সময় পার। ফোন চার্জে দেওয়ার সময় সে পায়নি।
.
দুই দিন পর ফোন অন করে দেখে নিশিতার অনেক ম্যাসেজ।
শেষ ম্যাসেজ টা এমন ছিলো
Nishi- tui jdi ekhn na asish! miliye nish ami suicide korbo.....
.
সাথে হাত কাটার একটা ছবি।এমন দেখে রুপ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না।
আসছি বলেই বেজমেন্ট থেকে গাড়ি নিয়ে দ্রুত ছুটলো বনানীর ফ্ল্যাটে।
নিশি কিছু করে বসবে না তো? খুব জেদি মেয়ে। আট বছর ধরে চেনে ওকে। যা চাই না পেলে নিজের ক্ষতি করবে।
ওর কিছু হলে ও কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না।
অনেক ক্ষণ বেল বাজানোর পর দরজা খুলছে না নিশি।
ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
ঠিক আছে তো ও?
ঠিক সে সময় দরজা খুলে দিলো নিশি।
কোন কথা না বলেই খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিশিকে।
ঠিক এমন ভাবে ধরেছিলো কলেজ থেকে টুরে গিয়ে যখন নিশি রাতের বেলা কক্সবাজারে লুকিয়ে ওকে ভয় দেখিয়েছিলো সেদিন।
.
- একটা চড় মেরে তোর সব দাত ফেলে দেবো ( রুপ)
- এই বাহানায় তো স্পর্শ পাবো। (নিশি)
- মাথা ঠিক আছে তোর? কি সব ম্যাসেজ দিয়েছিস?
- আমি মরলে কার কি?
- আমার সবই।।
- তাহলে কই ছিলি এই কয়দিন? অর্থির কাছে তো? কি আছে ওর মাঝে যা আমার মাঝে নেই?
.
রুপ নিজের মাঝে নিশি কে মিলিয়ে নেয়।
বুঝতে পারে মেয়েটার জ্বর।
কিছু হয়তো খায় নি।
বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে
- আমি খাবার নিয়ে আসছি! তুই উঠবি না।
- তুই চলে যাবি....
- আমি যাবো না পাগলী।
- চলে গেলে সত্যি মরে যাবো কিন্তু
.
রুপ কিছু না বলে নিশির কপালে চুমু দেয়।
- ঠোঁটে দিলে কি ফুরিয়ে যেতো?
.
অভ্যেস হয়েগেছে রুপের। কোথাও বের হওয়ার আগে অর্থি কে সবসময় কপালে চুমু দিয়ে বের হয়। ঠোঁটে দিলে বলতো
ভালোবাসার বিশুদ্ধ, পবিত্র বহিঃপ্রকাশ কিন্তু কপালে চুমু দেওয়া তেই।
.
সেদিন বৈশাখের প্রথম কালবৈশাখী ছিলো যা অনেক কিছু কেড়ে নিয়ে গেলো।
.
.
রাত প্রায় ১০ টা। রাতের খাবার খেয়ে কেবল শুতে যাচ্ছিলেন অর্থির মা বাবা। ঠিক সে সময় অর্থির মায়ের ফোনে কল এলো। স্ক্রীণে নাম্বার দেখে আতকে উঠিলেন তিনি। এত দিন পর? কেনো অর্থি কল দিয়েছে? মেয়েটা ঠিক আছে তো? কাপা কাপা হাতে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ কাদছে আর বলছে..
.
- মা! মা গো? তুমি কেনো আমাকে অভিশাপ দিছিলা? মা আমি তোমার সন্তান বেঁচে রইলাম কিন্তু তোমার কথা মতো আমি সন্তান হারা মা।
মা! তুমি অভিশাপ টা ফিরিয়ে নেও না গো মা।
আমার দুধের সন্তান টা বেঁচে যাক।
মা! মা তুমি শুনছো?
.
.
#পর্বঃ৩
.
.
অর্থি যেদিন বাড়ি ছেড়েছিলো সেদিন মা তাকে অভিশাপ করে বলেছিলো
- মেয়ে হয়ে তুই যে কষ্ট গুলো দিয়ে গেলি এর জন্য তুই সারাজীবন সুখী হতে পারবি না। আজ থেকে তুই মরে গেলি। আমার থেকে আমার মেয়েকে কেড়ে নিলি, আল্লাহ তায়ালার কাছে আচল ফেলে চাইলাম তোর বুকে থেকেও আল্লাহ যেনো তোর সন্তান কে কেড়ে নেয়।
তখন তুই বুঝবি। কষ্ট কাকে বলে।
.
ফোন কানে নিয়েই কথাগুলো মনে পড়ে গেলো অর্থির মায়ের। বুকের ভিতর টা হুহু করে উঠলো।
.
.
- মা! জানো মা! আমার দুইদিনের মেয়েটা আর বাঁঁচবে না মা! জন্মের পর থেকে মা ওকে তো বুকেই নিতে পারিনি।
মা! আমি তোমার পায়ে ধরি, অভিশাপ টা ফিরিয়ে নাও।
মা!
.
কল কেটে গেলো। অর্থির মা চুপচাপ আছে। ওর বাবা জিজ্ঞেস করছিলো কি হয়েছে।।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সবটা জেনে ঝড় মাথায় নিয়েই বেড়িয়ে পড়লো।
মেয়ে তার খুব আদরের। সেদিন বাধ্য হয়েছিলো বাড়ি ছাড়তে।
কিছু বলতে পারেনি। চুপচাপ ওর বাসার সামনে মসজিদে নামাজ আদায় করে একটু দেখার আশায়।
.
.
বাবা মা কে দেখে অর্থি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মা স্বান্তনার বাণী দিলেও কি কান্না থামে?
বাবা যেনো মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদি কিছু করেই হোক নাতনী কে বাঁচাতে।
যদি আল্লাহ একটু রহমত করে।
মেয়ের উপর অভিমান তাই বলে মন থেকে বলেনি কথা গুলো।
আল্লাহ তুমি মাফ করো গো। আল্লাহ গো। রহমত করো।
মেয়ের মুখের দিকে তাকাও।
.
রুপ ফিরে এসে দেখে নিশি বিছানায় শুয়ে আছে। হাতে রুপের ফোন।
স্ক্রীনে ভেসে আসে অর্থির হাসি মুখ।
অর্থির মুখ টা দেখে বিবেক যে বাধছে। মেয়েটা যে ক্লিনিকে।
কিন্তু নিশি কে ছেড়ে যাওয়াটা যে সম্ভব না।
মেয়েটার খুব জ্বর।
- খাবার খেয়ে নে।
- ওকে ছেড়ে দে।
- মানে?
- বুঝিস না তুই? এই মেয়েকে ছেড়ে দে। চল অন্য কোথাও যাবো।
ছোট্ট সংসার বানাবো। চল না।।
- কি বলছিস এসব। খেয়ে মেডিসিন নিবি আয়।
- আগে বল তুই ওকে ছাড়বি! না হলে খাবো না।
- একটা থাপ্পড় মারবো। আয় এদিকে খেয়েনে।
- আমি তোর এই শাসন খুব মিস করি। তোকে খুব ভালোবাসি সেই প্রথম থেকে।
.
নিশি এসে চুপচাপ বিড়ালছানার মতো রুপের বুকে মাথা রাখে। জ্বর টা মনে হয় ক্রমশ বাড়ছে।
.
.
দূর থেকে আজানের শব্দ আসছে। ঝড় থেমে গেছে।
কিছুক্ষণ আগে ডক্টর আদিত্য আহমেদ বললেন মেয়েটা কে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাঁচানো গেলো না।
অর্থি চুপচাপ বসে আছে।
আজকে তার চোখ আর রুপ কে খুজছে না।
আজ তার হাত স্পর্শ করতে চাচ্ছে তার অরুনীমা কে।
হ্যাঁ! অরুণীমা।
রুপ আর অর্থির মেয়ে অরুনীমা।
কিন্তু এখন আর নাম রেখে কি লাভ?
সবাই তো বলছে লাশ।
সব ফরমালিটিস পুরো করলো অর্থির বাবা।
পশ্চিমাকাশে সূর্য উঠছে। সেদিকে এম্বুলেন্স এর সায়রন বাজিয়ে নিয়ে চলেছে ছোট্ট অরুনীমা কে। অর্থির মা রুপ কে খুজলেও আজ অর্থি খুজছে না।
মা! মেয়ে! কেউ কারো স্পর্শ পেলো না। আগেই সব শেষ।
মেয়ের লাশ কোলে নিতেই গগনবিদারী চিৎকারে ভেসে উঠলো পুরো চারপাশ।
ক্লিনার খালাগুলো যেনো কাদছে।
প্রকৃতি অর্থির সাথে মিলিয়ে কাদছে।
আহারে মা! আহারে মাতৃত্ব।
.
.
চলবে...
0 Comments:
Post a Comment