গল্পঃ সে_ফিরে_আসবেই পর্ব ৩

 গল্পঃ #সে_ফিরে_আসবেই      

৩য়_পর্ব

লেখকঃ #অনন্য_শফিক


ভালোবাসার কী কোন সংজ্ঞা হয়?

আমার মনে হয় হয় না। এবং এই ভালোবাসাকে কোন শৃঙ্খলেও আবদ্ধ করা যায় না। ভালোবাসা নিষেধ মানে না, অবজ্ঞা মানে না, জাত পাত ধর্ম কোনটাই না!


অফিসে আমি যে চেয়ারটায় বসি তার পাশের চেয়ারে বসে পিয়ালী সরকার। হিন্দু ধর্মাবলম্বী। দেখতে ভীষণ স্মার্ট। মিষ্টি করে কথা বলে। বয়স পঁচিশের কম নয়। বিয়ে করেনি। বিয়ে নাকি সে কোনদিন করবেও না। এই পিয়ালীর প্রধান কাজ হলো অফিসের কাজ ফেলে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা। আমি কিন্তু তার তাকিয়ে থাকাটা বুঝি। কিন্তু ওকে বুঝতে দেই না।


এই জন্য পিয়ালীর খুব অভিমান হয়। মাঝেমধ্যে রাগ করে আমার সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দেয় পর্যন্ত। কিন্তু তিনদিনের বেশি আর কথা না বলে থাকতে পারে না। তারপর নিজে থেকেই কথা বলতে আসে। বলে,' ফাহাদ ভাই, আপনি কী হিন্দুদের অপছন্দ করেন?'


ওর কথা শুনে আমি ভীষম খাই। অবাক হয়ে বলি,' এমন কথা বলছো কেন পিয়ালী?'


পিয়ালীর চোখ টলমল করে। ঠোঁটের গোলাপী পাপড়ি তিরতির করে কাঁপতে থাকে বন পাতার মতো। সে আর কথা বলে না। চুপচাপ ডেক্সটপে চোখ রাখে। কী বোর্ডে কী যেন টাইপ করে!


এর আগে একবার আরো অদ্ভুত কান্ড করেছিলো পিয়ালী। সে আমার সাথে একটা উদ্যানে ঘুরতে বেরিয়েছিল। আর বিকেলের মৃদু বাতাসে কাঠ গোলাপের গাছের নীচে বসে আমায় বলেছিল তার ভালোবাসার কথা। সে যাকে ভালোবাসে সেই পুরুষ বিবাহিত। এবং পুরুষটির একটি সন্তান আছে। তখনই আমি কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছিলাম পিয়ালী কাকে ভালোবাসে আসলে! কিন্তু এই বিষয়ে তাকে কিছু ঘাঁটাইনি!


এই নিয়েও তার অনেক ক্ষোভ আমার প্রতি। কেন তাকে আমি একবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করলাম না কোন পুরুষের জন্য তার এই ভালোবাসা!


সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল,' আপনি কী আমার প্রতি বিরক্ত ফাহাদ ভাই? যদি বিরক্ত হোন তবে চাকুরিটা আমি ছেড়ে দিবো। আপনার সামনে কখনো পড়বো না আর!'


বলে হনহন করে হেঁটে আমায় ফেলে রেখেই সে একা চলে গিয়েছিল।


আজ সকালবেলা নীলা উঠে রান্নাবান্না করেছে। তারপর আমায় ডেকে নিয়ে আমার সাথে খেতে বসেছে। খেতে বসে সে হঠাৎ করে বললো,' ফাহাদ, আমি আজ মানহাকে নিয়ে ওর নানা বাড়ি যাবো। কদিন থেকে আসবো!'


ওর কথা শুনে আমি ভীষম খাই। নীলা দ্রুত জলভরা গ্লাসটা এগিয়ে দেয়।


আমি সেই গ্লাস তুলে নিয়ে এক চুমুকেই সবটুকু পানি খেয়ে ফেলি।


মানহা তখন বলে,' বাবা যাবে না মা?'


নীলা বলে,' না। আমি আর তুমি যাবো। বাবার অনেক কাজ। যেতে পারবে না এবার।'


নীলার কথাটা শুনে ভীষণ রকম কষ্ট পাই আমি। এর আগে আমায় ছেড়ে সে কোথাও যেতে পারতো না। গিয়ে থাকতে পারতো না। এরজন্য ওর বন্ধুরা ওকে কত কী বলে। হাসাহাসি করে পর্যন্তাবলে বর পাগলি মেয়ে। নীলাও তখন শক্ত করেই বলতো, বরের জন্য পাগল হবো না তো পরের জন্য পাগল হবো?


এই নীলার আজ কতো পরিবর্তন!


অফিসের সময় হয়ে এলে নীলা আমার হাতে টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি তুলে দিয়ে বলে,' বাইরের খাবার খেও না। আমি ফ্রিজে তিন চারদিনের জন্য তরকারি রান্না করে রেখে যাচ্ছি। তুমি শুধু ভাত রান্না করবে। ইচ্ছে হলে একটু সবজি বেজে নিবে। রুটি খেতে চাইলে করে নিবে।'


আমি মাথা কাঁত করে বলি,' ঠিক আছে।'


চলে যাওয়ার আগে নীলার হাতে টিপ আর চুড়ির প্যাকেটটা তুলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন জানি দিতে পারি না। সাহস হয় নাভিয় ভয় লাগে।


মনে হয় এই নীলা আমার অপরিচিত কেউ!


বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মানহাকে একটু কোলে টেনে নেই। আদর করি। কপালে চুমু খাই। তারপর পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে নীলার হাতে ধরিয়ে দেই। বলি,' মানহা এটা ওটা খেতে চায় কিনে দিও। 


আর তুমিও-


কথাটা শেষ করতে পারি না। হঠাৎ মনে হয় আমার শেষের কথাটা বলা উচিৎ হয়নি!


তারপর মানহাকে টাটা বলে বাসা থেকে বের হয়ে আসি।


অফিসে বসে আছি ভার মুখে। কিছুই ভালো লাগছে না। কফি বরফ হয়ে গেছে। আমি ছুঁয়েও দেখিনি কাপ। আমি শুধু ভাবছি, এমন ফুলের মতো সুন্দর একটা সংসার কীভাবে হঠাৎ এলোমেলো হয়ে যেতে পারে? নীলা কীভাবে এমন বদলে যেতে পারে?ওর যদি আগে সম্পর্ক থাকবেই তবে ছেড়ে এলো কেন? ছেড়ে এসে আমাকেই বা কেন ওর মায়ায় জড়ালো? আর এখন আবার আমায় ছেড়ে ওর কাছেই চলে যেতে চাচ্ছে কেন! এটা কী পুতুল খেলা! আমার কী কষ্ট হয় না। খারাপ লাগে না।


আর মানহার? আমার লক্ষ্মী মেয়েটার কী হবে?


আমায় এভাবে চুপচাপ মুখ ভার করে চিন্তামগ্ন হয়ে বসে থাকতে দেখে পিয়ালী এসে দাঁড়ালো আমার টেবিলের সামনে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,' ফাহাদ ভাই, আপনার কী কোন কারণে মন খারাপ?' আমি হাসার চেষ্টা করে বলি,' না তো। কেন আমায় দেখে কী এমন মনে হচ্ছে?'


'হ্যা হচ্ছে।'


আমি আর কোন কথা বলি না। আবার চুপ হয়ে যাই।


পিয়ালী এবার বলে,' চলুন না আজ বিকেলে আমরা ঘুরতে যাই!'


আমি বলি,' অফিসে তো অনেক কাজ!'


'পরে একদিন আপনাকে আমি হেল্প করবো। আপনার অর্ধেক কাজ আমি করে দিবো। তবুও চলুন আজ ঘুরতে বের হই।প্লিজ প্লিজ আর না বলবেন না!'


পিয়ালীর অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি। তাছাড়া আমারও মন খারাপ ছিল। একটু অবসরের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সময়টা আমি বদলে দেই। বলি, 'পিয়ালী, কাল তো ফ্রাইডে। চলো আগামীকাল বের হই। সোনারগাঁ থেকে ঘুরে আসি।'


পিয়ালী ওর সাদা দাঁত বের করে হেসে বলে,' ওকে।'


আমি আর পিয়ালী বসে আছি সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরের লেকটার কাছে। পিয়ালী আমার কাছ থেকে বারবার জানতে চাইছে, আসলে আমার কী হয়েছে! কেন আমি অফিসে একদিন আসিনি। আবার এরপর দিন আসার পর থেকেই মন খারাপ কেন আমার!


আমি ওর প্রশ্নের উত্তর দেই না। এড়িয়ে গিয়ে বলি,' পিয়ালী, তুমি কাকে ভালোবাসো বলবে?'


পিয়ালী এই কথা শুনে কেমন বোকার মতো হয়ে উঠে। তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। দ্রুত চোখ নীচ দিকে নামিয়ে নরম গলায় বলে,' আপনাকে বলে আর সমস্যা বাড়াতে চাই না!'


আমি বলি,' সমস্যা কী? বলো না! বললে তো দোষ নেই!আমি তো আর সেই পুরুষকে গিয়ে খুঁজে বের করে বলবো না তোমার কথা!'


পিয়ালী তখন কী যেন বলতে ঠোঁট খুলছিলো। আর তখনই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে। আমাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে এক জোড়া ছেলে মেয়ে সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়। ছেলেটাকে আমি চিনি তমাল।


মেয়েটা আমার স্ত্রী। নীলা।


ওরা আমাদের দেখে না। কিন্তু পিয়ালী ঠিক দেখে ফেলে নীলাকে এবং চিনেও ফেলে। পিয়ালী সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ডেকে উঠে,' এই নীলা ভাবী?'


#চলবে

0 Comments:

Post a Comment