গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ৩৩ সমাপ্ত

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (৩৩ এবং শেষ)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


সময় এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে কেটে কেটে অনেকগুলো বছর।ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আহমেদ ভিলার সমস্ত লাইট জ্বলে উঠল, একসাথে সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠল,


- "হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।"


হ্যাঁ আজ নাজিয়া ও আবরারের ২৫তম বিবাহ বার্ষিকী। ওদেরকে কিভাবে সারপ্রাইজ দেবে সেটা ভাবতে ভাবতেই ছোটদের ১মাস কেটে গেছে কখন বুঝতেই পারেনি। আজকে সকালেও প্ল্যান নিয়ে প্রান আর আনহার মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। কিছুদিন আগেই প্রান ২৫বছর ছুঁলো আর আনহার ১৯রানিং ২০ অর্থাৎ বুড়ি হবে হবে হচ্ছে। 


আনহা একটা কেক নিয়ে এসে বলল,

- "মা বাবা চলো কেক কাটবে।"


ওরা কেক কাটতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার আগেই প্রান আরো একটা কেক নিয়ে হাজির। ওদের পথ আটকে বলল,

- "মাম্মাম পাপা আমার আনা কেক কাটবে, তুই ওইটা নিয়ে ফট।"


আনহা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,

- "তুই ওইটা নিয়ে ফট। বললেই হলো নাকি! আমি আগে এনেছি তাই আমার কেকটাই কাটা হবে তুমি যাও তো এইখান থেকে।"


বাকিরা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। এত সুন্দর একটা মুহূর্তেও এদের ঝগড়া করতে হবে! এরা বড়ো হলেও এদের ঝগড়া শুনলে মনে হবে এরা বাচ্চা, ক্লাস টু থ্রিতে পড়ে।


পরিস্থিতি জটিল হতে দেখে শাওন আবরার ও নাজিয়ার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

- "আঙ্কেল আন্টি তোমার থামাও নাহলে কিন্তু এখুনি বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে।"


নাজিয়া আনহাকে ধমক দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল কিন্তু তার আগে আবরার ওর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,

- "আমরা দুজনে দুজনের কেকই কাটব। এখন ঝগড়া না করে কেকগুলো রেখে দাও।"


আনহা ভেংচি দিয়ে কেকটা রেখে দিল, প্রান রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,

- "এই তুই কথায় কথায় ভেংচি কাটিস কেন? আমি বলেছি না আমার সামনে ওইসব করবি না!"

- "আমার মুখ আমি যা ইচ্ছা করব।"


প্রান রাগে কটমট করে তাকাল যার অর্থ অনুষ্ঠানটা শেষ হোক তোর খবর করে ছাড়ব। আনহা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সামনের চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল, যেটাতে প্রানের রাগ আকাশ ছুঁলো। কিন্তু এখন সবার‌ সামনে ওকে কিছু করতে পারবে না তাই চুপ করে রইল।


আবরার- নাজিয়া দুজনের আনা কেকটাই কাটল, তারপর দুজন দুজনকে খাইয়ে দিল। আবরার সকলের উদ্দেশ্যে বলল,

- "কেকগুলো খেয়ে যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে নাহলে কালকের পার্টি ক্যান্সিল।"


সবাই না বলে চেঁচিয়ে উঠল। একসাথে এতজনের আওয়াজে নাজিয়া আবরার কানে হাত দিতে বাধ্য হলো।


- "আরে আসতে কান খারাপ হয়ে যাবে।"

- "আমরা এখুনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি, তোমরা প্লিজ কালকের পার্টিটা ক্যানসিল করার কথা ভাববেও না।" (আনহা)

- "ঠিকাছে।"


আনহা সবাইকে নিজের আনা কেকটা কেটে দিল শুধুমাত্র প্রানকে বাদ দিয়ে। সেইম একই কাজটা প্রানও করল। এদের এতো ঝামেলা কেন?


আবরার ও নাজিয়া রুমের বারান্দায় গিয়ে বসল। বিয়ের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারল না, সময় কীভাবে কেটে যায়।


নাজিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

- "২৫বছর হয়ে গেল!" 

- "আমার‌ বিশ্বাসই হয় না এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম, ২৫টা বছর একসাথে পথচলা। ছেলেমেয়েগুলো কত বড়ো হয়ে গেল তাই না।"

- "হুমম। আমরা বয়স্ক হয়ে গেলাম, মা, আঙ্কেল আন্টি সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, ছেলে মেয়ে গুলো বড়ো হয়ে গেল সবটা কিরকম বদলে গেছে তাই না! "

- "সময় যে কারোর জন্য থেমে থাকে না।"


নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,


- "কিন্তু আবিরদার জীবন থমকে গেছে, সেই দিদিতেই আটকে আছে। এতগুলো বছরে কাউকেই আর তার পছন্দ হলো না।" 

- "ওইটা তো মাকে থামিয়ে রাখার জন্য বলেছিল। দাদা কখনোই ভাবির মায়া থেকে বের হতে পারবে না, ওদের গল্পটা 'এক আকাশ দূরত্ব' এর অনেক ভালোবাসা, মায়া কিন্তু তবুও কেউ কাউকে ছুঁতে পারবে না। আজীবন স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকবে, হয়তো এটাকেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলে।"


নাজিয়া কিছু না বলে আবরারের কাঁধে মাথা রাখল। নিসার অনুপস্থিতি ওদের কষ্ট দেয়, কাঁদায় ঠিকই কিন্তু একটা কথা অস্বীকার করা যায় না নিসার অনুপস্থিতি না ঘটলে নাজিয়া -আবরারের গল্পটা কখনোই পূর্নতা পেত না। নাজিয়া নিজের দিদির সংসার বাঁচানোর জন্য আবরারের সাথে দূরত্ব বাড়িয়েই যেত হয়তো একসময়ে শ্রেয়ার সাথে আবরারের বিয়েটাও হয়ে যেত।‌ সবকিছু অন্যরকম হতো, হয়তো ভালো কিংবা খারাপ। যা কিছু হয় ভালোর জন্যই হয়, সবকিছুর পেছনেই কিছু না কিছু কারন থাকে। যেটা হয়তো আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়, তবে সেইটাই আমাদের জীবনে সুখ নিয়ে আসে।


আবির নিসার স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল। প্রান সবকিছুই জানে, ওর কাছে কোনকিছুই অজানা না।এতে ওর কোনো আফসোস নেয়, নাজিয়া ওকে মাতৃস্মেহে বড়ো করে তুলেছে ষ, কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি এইটাই কম কি! 


আবিরের মা, নাজিয়ার মা বাবা দুজনেই মারা গেছেন। পুরানো প্রজন্ম বলতে একমাত্র আবিরের বাবাই বেঁচে আছেন। উনিও সারাটাদিন নিজের ঘরে বসেই কাটিয়ে দেন, কখনো সখনো প্রানের‌ সাথে আড্ডায় বসেন নিজেদের পুরানো দিনগুলো নিয়ে। প্রান বিষয়গুলো খুব এনজয় করে। আনহাও দাদুর সাথে আড্ডায় বসে, ওর আড্ডার টপিক থাকে আবরার নাজিয়া, আবির নিসার প্রেমকাহিনী। এইগুলো আবার প্রানের ঠিক পোষায় না, তাই দুজন আলাদা আলাদা ভাবে আড্ডায় মেতে উঠে।


------


নাজিয়া ভাবনার মাঝে বলল,

- "এই প্রান আর আনহাকে নিয়ে কি করব বলো তো! দুজন আগে তো এইরকম ছিল না, এখন এইরকম করে কেন?"

- "আমিও তো সেইটাই বুঝি না। দিনকে দিন একে অপরের শত্রু হয়ে উঠছে।"

- "হুমম।"


কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রান ও আনহার মাঝে সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গত ১বছর যাবত দুইজন দুইজনকে একটুও সহ্য করতে পারে না, একটুতেই ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে দুজনের মধ্যে। এটা নিয়ে বড়োদের দুশ্চিন্তার শেষ নেয়। ওরা যে হারে যুদ্ধ শুরু করে তাতে চিন্তা না করে উপায় আছে?


----


সবাই নিজেদের রুমে চলে গেলেও প্রান ও আনহা থেকে যায়। দুজন দুজনের দিকে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকাচ্ছে, ঠিক যেমন দুটো বিড়াল লড়াই করার আগে প্রস্তুতি নেয় ঠিক সেইরকম।


আনহা নিজের কেকের অবশিষ্ট অংশটা হাতের মধ্যে নিয়ে প্রানের সারা মুখে লাগিয়ে দিল, প্রানও কম যায় না আনহার মুখেও কেকের অবশিষ্ট অংশটা লাগিয়ে দিল। বর্তমানে দুজনেই কেক মেখে ভূত। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।


- "তোকে পুরোই পেত্মী লাগছে।"

- "আর তোমাকে পুরো ভূত লাগছে।"


প্রান ফোন বার করে আনহার কয়েকটা ছবি তুলে নিল,

- 'এইগুলো তোকে ট্যাগ করে পোষ্ট করব।"


আনহা রেগে কটমট করে তাকাল। ওর কাছে ফোন না থাকায় প্রানের ছবি তুলতে পারল না, নাহলে ওকে মজা দেখাত।


- "আর ক্যাপশন দেব, কেক চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবার পর অবস্থা।"


আনহা আঙুল উঁচিয়ে বলল,

- "দ্যাখো ভালো হবে না। আমি কিন্তু তোমাকে আনফ্রেন্ড করে ব্লক করে দেব।"


প্রান আনহার আঙুলটাকে ধরে বলল,

- "এই সাহসটা দেখানোর চেষ্টাও করিস না, তাহলে..

- "কি?"


প্রান বাঁকা হেসে বলল,

- "শখের আইডিটাই আর খুঁজে পাবি না।"


আনহা কিছু বলল না, কারন প্রান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ওর কাছে একটা আইডি হ্যাক করা কিংবা নষ্ট করা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আনহা তো এতটা সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী না, প্রানের পায়ে প্যারা দিয়ে দিল ।


- "আহ্, এইটা তুই কি করলি?"

- "আনহা দূর্বল নয় ওকে।যে আমাকে দূর্বল ভাববে তার অবস্থা এর থেকেও খারাপ হবে মাইন্ড ইট।"


আনহা ভাব নিয়ে চলে গেল, প্রান করুন চোখে নিজের পায়ের দিকে তাকাল। তারপর বিরবির করে বলল,

- "জংলী বিড়াল কোথাকার।"


আনহা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগল।‌ নিজেকে অসুন্দর কিংবা অপছন্দ করার কোনো কারনই খুঁজে পেল না। 

নিজের প্রতিবিম্বের উপর হাত বুলিয়ে বলল,

- "আমাকে কেন এতটা অপছন্দ করো প্রান! আমি তো তোমার প্রতি দূর্বল ছিলাম কিন্তু তুমি কি করলে! আমার দূর্বলতাটাকে ঘৃনায় পরিনত করতে বাধ্য করলে। একসময়ে যাকে আমি নিজের জীবনে চাইতাম, আজ তার সাথেই প্রতিনিয়ত ঝগড়া করি, তার মুখটাও দেখতে চাই না। এইসব তো হবার কথা ছিল না! কিন্তু হয়েছে, তোমার আর আমার মাঝে এখন 'এক আকাশ দূরত্ব' যে দূরত্বটা তুমি নিজের হাতে তৈরি করেছ। আর এই দূরত্ব কখনোই মিটবে না...


#সমাপ্ত 


শেষ হয়েও হইলো না শেষ।গল্পের সমাপ্তিটা এইরকম ভাবেই শেষ করার ইচ্ছা ছিল আর সেইভাবেই করলাম। গল্পটা শুরু হয়েছে এক প্রজন্ম দিয়ে আর শেষ হলো আরেক প্রজন্মে। পাঠকরা ভাবুক আনহা ও প্রানকে নিয়ে আমি এটাই চাই...


হয়তো কখনো প্রান ও আনহা গল্পে আসবে তবে সেটা কিছুটা ভিন্নভাবে অথবা এর পর থেকেই। আপনারা কোনটা চান? প্রান ও আনহা কোনভাবে ফিরুক?

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ৩২

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (৩২)

#তানজিলা_খাতুন_তানু


- "এই নাজিয়া বার্থ সার্টিফিকেটটা দ্যাখ সব ঠিক আছে কিনা।"


নাজিয়া সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। বেবির নাম "আনহা আহমেদ"। নামটা আবরার ঠিক করেছে দুইজনের নাম মিলিয়ে। নাজিয়ার কোনো আপত্তি ছিল নাহ তাই এই নামটাই সার্টিফিকেটে দেওয়া হয়েছে।


প্রান বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

- "বাবা ওইটা কি?"

- "ওটাকে বার্থ সার্টিফিকেট বলে।"

- "বাথ সারফিকেট কি?"

- "তুমি ছোট এইসব বুঝবে না।"


কিন্তু প্রান নাছোড়বান্দা, সে জেনেই ছাড়বে ওইটা আসলে কি। নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,

- "প্রান সোনা আমার কাছে আসো। আমি বলছি এইটা কি।"


প্রান ওর বাবার কোল থেকে নেমে নাজিয়ার‌ পাশে বসে পড়ল। 


- "বলো।"

- "বার্থ সার্টিফিকেট মানে হলো, যেখানে তোমার বেবি ডলের নাম, জন্মানোর তারিখ লেখা থাকে।"

- "আমারও আছে?"

- "হুমম।"


প্রান চুপ করে কিছু একটা ভাবল তারপর জিজ্ঞেস করল,

- "মাম্মাম মা মানে কি? আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করে মায়ের কথা।"

- "তুমি কি বলো?"

- "আমি বলি আমার মা নেই, ওই আকাশের তারা হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না সবাই বলে আমি নাকি মিথ্যা বলি, তুমিই নাকি আমার মা। কিন্তু তুমি তো আমার মাম্মাম মা না।"


নাজিয়া প্রানকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। চোখ ছলছল করছে, আবিরের চোখটা জ্বালাপোড়া করছে। ছেলের মুখে ওইসব শুনে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থাতে থাকল না, নাজিয়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।


প্রান কিছু বুঝল না, চুপচাপ নাজিয়ার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকল। নাজিয়া নিরবে চোখের পানিটা মুছে নিয়ে, প্রানের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

- "যখন কেউ তোমাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করবে, তখন তুমি বলবে আমার একটা মা আকাশের তারা হয়ে গেছে আর একটা মায়ের কাছে আমি থাকি যাকে আমি মাম্মাম বলে ডাকি।বুঝলে!"

- "তারমানে তুমিও আমার মা?"


নাজিয়াকে আবারো প্রানকে জড়িয়ে ধরে বলল,

- "হুমম বাবা আমিই তোর মা।"


---


আবির বিছানায় বসে প্রানের কথাগুলো ভেবে চলেছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, নিজেকে বাবা বলতে ও নিসাকে মা বলতে না শেখালেই হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা এইভাবে দ্বিধায় ভুগত না। 


আবির নিজের ফোনে নিসার একটা ছবি বার করে বলল,

- "খুব মজায় আছো তাই না! দেখছ ছোট প্রানও নিজের অজান্তে তোমার উপস্থিতি চাইছে, তুমি আমাদের ছেড়ে না গেলেও পারতে...


আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেয়, মানুষটা এমন জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে চাইলেও ফেরত নিয়ে আসা যায় না। আবিরের মা চেয়েছিলেন ছেলের একটা গতি করার, আবিরকে পুনরায় বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। নাজিয়া আবিরের দিকটা বিবেচনা করে ওনার সাথে সহমত প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু আবরার একমত হতে পারেনি এই নিয়ে নাজিয়ার সাথে কিছুটা ঝামেলাও লেগেছিল...


- "আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, তুমি কি বলতে চাইছ দাদা আর একটা বিয়ে করলেই সুখে থাকবে?"

- "সুখে থাকবে এইটার গ্যারান্টি তো দিতে পারব না, তবুও একটা চেষ্টা।"

- "যেখানে গ্যারান্টি দিতে পারবে না, সেখানে কথা বাড়ানোর কোনো দরকার নেয়। আর নাজিয়া তুমি কিভাবে রাজি হচ্ছো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না, তুমি তো দাদা ভাবির ভালোবাসার সাক্ষী তাহলে...


নাজিয়া একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

- "হ্যাঁ আমি জানি দিদি আর আবিরদা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসত। যেখানে বিয়ের পর বেবিনা হলে সমস্যার তৈরি হয় সেখানে আবিরদা এতগুলো বছর দিদিকে কোনো কথা না বলে, কোনরকমের ঝামেলা না করে সবকিছু মানিয়ে নিয়ে ছিল। দিদির চলে যাওয়াটা আবিরদা এখনো মেনে নিতে পারেনি, এখনো মনে মনে দিদিকেই ভালোবাসে। কিন্তু জীবন তো কোনো গল্প না, যেখানে একা একা সারাটাজীবন কাটিয়ে দেব। প্রতিটা মানুষেরই একটা সঙ্গীর দরকার হয়, আর আবিরদার বয়সই বা কত এখনো গোটা জীবনটা পড়ে আছে। ওনার একটা সঙ্গী দরকার তাই আমি আর মা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আবিরদার বিয়ে করাব।"


- "যা ইচ্ছা তাই করো, তবে আমি কখনোই দাদার পাশে অন্য কাউকে মেনে নিতে পারব না।"

- "আরে তুমি এইরকম বললে দাদাকে রাজি করাব কিভাবে?"

- "সেটা তোমাদের ব্যাপার।"


আবিরকে অনেক চেষ্টা করেও রাজি করানো যায়নি। যদিও এই দায়িত্বটা সম্পূর্ণ আবিরের মায়ের ছিল, নাজিয়া কখনোই আবিরকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলতে পারবে না। হ্যাঁ ওহ চায় আবিরের একজন সঙ্গী হোক, কিন্তু নিজের বন্ধুর মতো দিদির জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নেওয়াটা খুব একটা সহজ বিষয় নয়। সবটা শুনে বুঝে আবিরের বিয়ে দিতে চাইলেও বেহায়া মন যে সেটা কিছুতেই মানতে চায় না, দিদির সংসার, ভালোবাসার মানুষটার উপরে অন্যকারোর অধিকার বিষয়টা ভাবলেই কিরকম একটা ব্যথা অনুভব হয় বুকের ভেতর। আবার একজন মায়ের চিন্তাকে ফেলে দিতেও পারে না।


আবিরকে রাজি করানোর জন্য ওর‌ মা সবরকমের চেষ্টাই করেছেন কিন্তু ফলাফল ব্যর্থ। আবির সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছিল,


- "যদি কখনো কাউকে দেখে আমার মনে হয়, আমি তার সাথে সারাজীবন থাকতে পারব তখন আমি নিজে এসে তোমার কাছে বিয়ের কথা বলব প্রমিস।"


আবিরের মা হতাশ হয়ে বললেন,

- "সেই দিনটা কি আদৌও আমি দেখতে পারব?"


আবির মৃদু হেসে উত্তর দিল,

- "জানি না।"


নিসাকে ছাড়া আবির বড্ড একা তবে সেই একাকিত্ব দূর করার জন্য নতুন সঙ্গীর প্রয়োজন নেয়, নিসার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোই যথেষ্ট। নিসার স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে আবির বেঁচে আছে, আর বাকি দিনগুলো এইভাবেই কাটিয়ে দেবে অসুবিধা কি! আর যদি কখনো কাউকে ভালো লেগে যায়, তখন না হয় ভাবা যাবে এখন এইসব বন্ধ থাকুক।


আবির চলে যাবার আগে মায়ের উদ্দেশ্যে একটা কথা বলল,

- "আর একটা কথা, আমাকে সেকেন্ড বার বিয়ে নিয়ে কিছু বললে আমি এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো।"


আবিরের মা আতকে উঠলেন, ছেলে এইসব কি বলে?


- "কোথায় যাবি তুই?"

- "বিদেশ চলে যাবো, আর ফিরব না।"


আবিরের মা আর সাহস করেননি ছেলেকে ঘাটানোর। ওনার ছেলেরা বড্ড জেদি, জেদের বশে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিলে সেটার পরির্বতন হয় না। উনি শেষবয়সে ছেলেদের ছেড়ে থাকতে চাননা, তাই চুপ করে গেলেন।


তারপর থেকে বাড়িতে আবিরের বিয়ে নিয়ে কোনরকমের কথা উঠেনি। এতে আবির আবরার দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।


---


প্রান নাজিয়া বুকে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নাজিয়া ওকে শুইয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই শ্রেয়ার ফোন ঢুকল।


- "কেমন আছো?"

- "এইতো চলছে, তোমার।"

- "হুমম ভালো। বেবি কেমন আছে?"

- "ভালো।"

- "আবরার, আবিরদা, প্রান, মামনি সব কোথায়।"

- "আবরার অফিসে, আবির‌দা, মামনি রুমে আছে আর প্রান এইমাত্র ঘুমাল। তোমাদের পুঁচকে টা কেমন আছে কি করছে?"

- "ওর বাবার কাছে আছে। বাবা গো কি দুষ্টু হয়েছে কি বলব।"

- "বাচ্চারা একটু হয়।"

- "আমাদের প্রান কিন্তু গুড বয় বলো।"

- "হ্যাঁ, সে আর বলতে।"


নাজিয়া ও শ্রেয়া গল্প করতে লাগল। শ্রেয়া ও শান্তর ছেলে শাওন ৩বছরের। প্রচন্ড দুষ্টু, সারাটাদিন ওর পেছনেই ছুটতে ছুটতে শ্রেয়া শেষ। 


দুজনে কথা বলার একটা পর্যায়ে শ্রেয়া বলল,

- "আজ একটু শপিং করতে গিয়েছিলাম, সেখানে হাসিবের সাথে দেখা হয়েছিল।"

- "ওহ্।"

- "জানো তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল, আমি বললাম তোমার মেয়ে হয়েছে তারপর ওহ কিছু না বলেই চলে গেল। কেসটা ঠিক বুঝলাম না।"

- "বাদ দাও তো। আচ্ছা হাসিব বিয়ে করেছে?"

- "না।ওকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে ওহ হেসে বলল, 'যাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম সে অন্যকারোর ছিল তাই আর বিয়ে করা হয়নি।' জানো কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম, ওর মতো ছেলেও কাউকে ভালোবেসেছে আর তারজন্য এখনো বিয়েও করেনি!"


নাজিয়ার অস্বস্তি হচ্ছে। শ্রেয়া কথাগুলো না বুঝলেও ওর কাছে কোনো কিছুই অস্পষ্ট নয়। হাসিব যে ওর কথাই বলেছে সেটা শিওর, নাজিয়ার ভীষন মায়া হলো মনে মনে ভাবল,

- "আমরা সবসময়ে ভুল জিনিসটাকেই আমাদের জীবনে বেছে নিই, তারজন্য আমাদের আজীবন আফসোস করতে হয়।"


কয়েকদিন অফিসে না যাবার জন্য আবরারের অনেক কাজ জমা হয়ে গিয়েছিল, সেইগুলো করতে গিয়ে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। আবিরের মা নাজিয়াকে জোর করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন আর নিজে আবরারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।


সারাটাদিন খাটুনির পর বাড়ি ফিরে প্রিয় মানুষটার দেখা সকলেরই আশায় থাকে। আবরারও নাজিয়াকে আশা করছিল কিন্তু মাকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।


- "মা তুমি?"

- "হুমম। নাজিয়ার এইসময়ে বেশি রাতজাগা ঠিক না, তাই ওকে খাইয়ে ঘুম দিয়ে দিয়েছি। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়, একসাথে খাবো।"


আবরার কাজের চাপে একপ্রকার ভুলতেই বসেছিল নাজিয়া অসুস্থ। তাই তো দরজায় ওকে আশা করে বসেছিল। আবরার নিজের ঘরে ঢুকতে চোখটা আটকে গেল বিছানায়। দুইদিকে দুইজনকে নিয়ে নাজিয়া ঘুমাচ্ছে, আবরার মৃদু হাসল। জীবন সুন্দর।


#চলবে...


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ৩১

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (৩১)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


রাত ১০টা। হঠাৎ করেই নাজিয়ার পেইন শুরু হয়, যন্ত্রনায় এদিক ওদিক করতে থাকে। আবরার ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করছিল, নাজিয়াকে উশখুশ করতে দেখে ওর কাছে গিয়ে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,


- "কি হয়েছে নাজু, ইউ ওকে?"


নাজিয়া কথা বলার মতো অবস্থায় নেই, যন্ত্রনায় চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আবরারের হাতটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কোনমতে আটকে আটকে বলল,

- "আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।"


আবরার ঢোক গিলল। নাজিয়ার এই অবস্থা দেখে নিজের কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে কোনোরকমে সামলে আবিরের নম্বরে কল দিল। আবির সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরে বিছানায় গা এলিয়েছে, বাড়িতে থেকে আবরারের ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হলো। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই আবরার বলল,


- "দাদা তাড়াতাড়ি আমাদের ঘরে আয়, নাজিয়ার পেইন উঠেছে।"


আবির কোনরকমে বিছানা থেকে উঠে আবরারের ঘরের দিকে দৌড় দিল। নাজিয়া আবরারের হাতটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, আবির আবরারকে বলল,


- "আমি গাড়ি বার করছি, তুই নাজু'কে নিয়ে এখুনি আয়। আমাদের হসপিটালে যেতে হবে।"

- "হুমম।"


আবির যেতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে আবরারকে বলল,

- "তুই উঠ, মাকে গিয়ে বল আমরা হসপিটালে যাবো। তারপর গাড়ি বার কর, আমি নাজু'কে নিয়ে যাচ্ছি।"


আবরার ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। নাজিয়ার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। আবির নাজিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

- "আর একটু ধৈর্য ধর। আল্লাহ তায়ালা কে ডাক সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।"


নাজিয়া কিছু বলতে পারল না, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আবিরের সেই বীভৎস দিনের কথা মনে পড়ছে বারবার, বাচ্চা প্রসবের সময়েই নিসাকে হারিয়েছে। আবির নাজিয়াকে হারাতে চায় না, বারবার দোয়া করছে যাতে নাজিয়া ও বেবি দুজনেই সুস্থ থাকে।


আবরার এলোমেলো ভাবে মায়ের ঘরে ঢুকল। ওকে এইভাবে দেখে মা ও বাবা দুজনেই চমকে উঠলেন। মা আবরারের কাছে গিয়ে বলল,


- "আবরার বাবা কি হয়েছে? তোকে এইরকম লাগছে কেন!"


আবরার নিজের কান্না কোনোরকমে আটকে রেখে, মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

- "মা নাজিয়ার পেইন উঠেছে। আমরা হসপিটালে যাচ্ছি, দোয়া করো।"


আবরার আর কিছু বলতে পারল না, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আবিরের মা আতকে উঠলেন, নাজিয়ার প্রেগন্যান্সি নিয়ে সবাই স্বাভাবিক ভাব করলেও নিসার ব্যাপারটার পর থেকে সবার কাছেই ওইটা একটা আতকের ব্যাপার। মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করেন বললেন,


- "আল্লাহ তুমি নাজিয়াকে সুস্থ রেখো। ওর কিছু হলে আমার আবরার শেষ হয়ে যাবে।"


আবিরের মা নাজিয়ার সাথে আবরারের বিয়ে হবার পর বুঝেছিলেন, ওরা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। আবরার নাজিয়া একে অন্যকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।


আবরার মা-বাবার কাছে দোয়া চেয়ে গাড়ি বের করতে চলে গেল। আবিরের মা নাজিয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই আবির নাজিয়াকে নিয়ে চলে আসে। আবির যাবার আগে বলে,


- "মা আমরা গেলাম দোয়া করো। আর প্রানকে দেখে রেখো।"


রাতটা সকলের কাছেই আতঙ্কের। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে সকলের একটাই দোয়া নাজিয়া ও বেবি দুজনেই যেন সুস্থ থাকে। আবির নিজেকে সামলে আবরারকে সামলাতে ব্যস্ত। ছেলেটা বড্ড ভেঙে পড়েছে। 


রাত পেরিয়ে ভোর হলো। ফজরের আযান দিচ্ছে, তখন এক নার্স এসে বলল,

- "কনগ্রাচুলেশন, আপনাদের প্রেসেন্টের মেয়ে হয়েছে।"


আবরার বসা থেকে উঠে জিজ্ঞেস করল,

- "আমার ওয়াইফ কেমন আছেন?"

- "উনিও সুস্থ আছেন, চিন্তার কিছু নেয়।"


আবির ও আবরার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আবির নিজের মা ও নাজিয়ার মাকে ফোন করে খুশির খবরটা জানিয়ে দিল। আবরার তখনও চুপচাপ বেঞ্চে বসে আছে, অনুভূতিটা'কে কিভাবে নেবে সেটাই বুঝতে পারছে না। 


আবিরের খেয়াল হলো, ইসলাম ধর্ম অনুসারে সদ্য জন্মানো বাচ্চার কানে আযান দিতে হয়। আবির নার্সকে বলে বেবিকে নিয়ে আসতে বলল, তারপর ছোট সোনাটার কানে আযান দিয়ে আবরারের কোলে তুলে দিল।


- "মেয়েকে কোলে নিয়ে দ্যাখ, কেমন হয়েছে।"


আবরার কাঁপা হাতে ছোট পুতুলটাকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরল। ছোট ছোট হাত-পা, আবরার মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,


- "মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, আর দিও না কেমন। একদম গুড গার্ল হবে কিন্তু।"


আবির‌ ফিক করে হেসে দিল আবরারের বাচ্চা বাচ্চা কথায়। ছেলেটা এখনো বড়ো হলো না।আবরার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।আর‌ আবির চারিদিকে ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।


সকাল না হতে হতেই হসপিটালে সবাই হাজির। প্রান ঘুম থেকে ওঠা থেকে মাম্মামের কাছে যাবার বায়না করেই চলেছে, বাধ্য হয়েই ওকে সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়েছে। সবাই নাজিয়ার মেয়েকে আদর করতে ব্যস্ত, তখন প্রান ব্যস্ত নাজিয়াকে নিয়ে। নাজিয়ার সারামুখে চুমু দিয়ে বলল,


- "মাম্মাম তুমি এখানে কেন? জানো আমি যখন তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।"

- "আমি এখানে তো একটা প্রিন্সেসকে আনতে এসেছি।"

- "প্রিন্সেস! কোন প্রিন্সেস মাম্মাম?"


নাজিয়া মুচকি হেসে ওর মায়ের কোল থেকে ছোট প্রিন্সেসকে নিয়ে বলল,

- "এই সেই প্রিন্সেস। লিটল প্রিন্সেস।"


প্রান চোখ গোল গোল করে তাকাল। ওর কাছে সদ্য জন্মানো বেবীটাকে পুতুলের মতো লাগল,

- "বেবি ডল।"


নাজিয়া হেসে দিল। ছেলের প্রিন্সেস নামটা পছন্দ হয়নি, তাই নিজেই নাম দিয়ে দিল বেবি ডল।


- "মাম্মাম আমাকে দাও না বেবি ডলকে।"

- "আচ্ছা তুমি বসো একটুও নড়াচড়া করবে না কিন্তু। আমি বোনকে দিচ্ছি।"


প্রান বুঝল না, তাই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

- "বোন কে?"

- "এই তো বোন।"

- "নাহ এইটা আমার বেবিডল।"

- "আচ্ছা তাই বেবি ডল, এখন চুপ করে বসো‌ আমি কোলে দিচ্ছি।"


বেবিটাকে প্রানের কোলে দিতেই বেচারী কেঁদে উঠল। প্রানের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, বেবি ডল এইরকম করল কেন?


- "মাম্মাম বেবি ডল আমার কোলে এসে কাঁদল কেন? ওর কি আমাকে ভালো লাগেনি!"

- "না বাবা সেইরকম কিছু না। ওহ ছোট তো তাই এইরকম কাঁদছে।"


প্রান মুখটা কালে করে বলল,

- "ওহ।"


যেহেতু নাজিয়ার নরমাল ডেলিভারি হয়েছে তাই ২দিন পরেই রিলিজ করে দিলো। নাজিয়ার মা ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আবিরের‌ মা রাজি হননি। উনি ওনার নাতনী, বউমাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকবেন না অগত্যা নাজিয়ার মা মেয়ের কাছে কিছুদিন থাকার সিদ্ধান্ত নেন।


নাজিয়া বিছানায় আধশোয়া হয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে, আর তার পাশে বসে প্রান ওদেরকে দেখছে।


- "কি দেখছ?"

- "দেখছি তুমি বেশি সুন্দর না বেবি ডল বেশি সুন্দর।"

- "তা কি দেখলে?"


প্রান কিছুক্ষণ ভাবার ভান করে বলল,

- "আমার মাম্মাম ইজ বেস্ট।"


নাজিয়া মুচকি হাসল, প্রানের মুখেও হাসি। সেইসময়ে আবির নাজিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিল, মূহুর্তটা দেখে থমকে দাঁড়াল। মা ও দুই সন্তানের সুন্দর মুহূর্তটা চোখ ভরে দেখল। নিসা বেঁচে থাকলে ওর জীবনটাও এইরকম সুন্দর সাজানো গোছানো হতো কিন্তু আফসোস তার কিছুই হয়নি। 


প্রানের চোখ পড়ে আবিরের দিকে, বিছানা থেকে উঠে বাবা বলে দৌড়ে কোলে উঠে পড়ে। প্রান আবিরকে বাবা বলেই ডাকে, নাজিয়া ও আবরার প্রানকে নিজের সন্তানের মতো বড়ো করে তুললেও আবির কিংবা নিসাকে নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়নি। তাই ছোট থেকে নাজিয়াকে মাম্মাম, আবরারকে পাপা, আবিরকে বাবা এবং নিসাকে মা বলতে শিখিয়েছি। ওরা কেউই চায়না, প্রান নিজের পরিচয় নিয়ে সংকোচে থাকুক। ওরও জানার অধিকার আছে ওর মা বাবা কে। যখন ক্লাসে ওকে কেউ ওর বাবা মা কথা জিজ্ঞেস করে উত্তরে ওহ বলে,

- "আমার বাবা আছে, মা নেই। কিন্তু আমার পাপা, মাম্মাম আছে।"


ছোট প্রান এখনো বোঝে না মা বাবা কাকে বলে, কাদের বলে।এখন নাজিয়া ও আবরারকে ছাড়া কিছুই বোঝে না কিন্তু যেদিন বড়ো হয়ে যাবে সেদিনও কি নাজিয়া ও আবরারের প্রতি একই ভালোবাসা থাকবে?


#চলবে...


প্রথমে ভেবেছিলাম ১-২পর্বে শেষ করে দেব। কিন্তু লিখতে গিয়ে বুঝলাম আরো কিছু পর্ব দিতে হবে নাহলে গল্পটা ছন্নছাড়া হয়ে শেষ হবে। আর ক'টা পর্ব হয় দেখি তারপর না হয় ইতি টানব...

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ৩০

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (৩০)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


কয়েকদিন থেকে নাজিয়ার শরীরটা বড্ড খারাপ, কিছুই খেতে পারছে না, আর খেলেও বমি বমি লাগছে। প্রানকে স্কুলের জন্য রেডি করাতে করাতে নাজিয়ার বমি বমি ভাব লাগে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যেতে প্রানও পেছন পেছন যায়।


- "মাম্মাম তোমার কি হয়েছে!"


নাজিয়া কিছু বলতে পারে না তার আগেই গড়গড় করে বমি করে দেয়। ৫বছরের প্রান প্রচন্ড ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে আসে।


আবিরের মা প্রানকে কাঁদতে কাঁদতে আসতে দেখে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

- "কি রে কাঁদছিস কেন?"

- "দিদুন মাম্মামের শরীর খারাপ বমি করছে তুমি তাড়াতাড়ি চলো।"


প্রানের কথা শুনে আবিরের মা দ্রুত নাজিয়ার ঘরে আসেন। বমি করার পর নাজিয়ার শরীর অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে, উনি ওর চোখেমুখে পানি দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। অভিজ্ঞ চোখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছে তবে নাতির সামনে কিছু বললেন না। 


- "তুই বিছানায় শুয়ে রেস্ট নে, উঠার দরকার নেয় ওদিকটা আমি সামলে নেব।"

- "কিন্তু মামনি!"

- "কোনো কিন্তু না, চুপচাপ শুয়ে থাক।আর প্রান তুই তোর মাম্মামের কাছে থাক, দেখবি বিছানা থেকে না উঠে।"


প্রান ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। আবিরের মা ঘর থেকে চলে যেতে প্রান নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।


- "কি হয়েছে আমার প্রানের! কাঁদছ কেন?"

- "তোমার কষ্ট হচ্ছিল তাই না!"

- "না বাবা কিছু হয়নি। তুমি কান্না থামাও নাহলে কিন্তু মাম্মামের সত্যি সত্যি কষ্ট হবে এইবার।"


প্রান চটপট কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বলল,

- "না আমি কান্না থামিয়েছি।"


নাজিয়া ছেলের কান্ডে ফিক করে হেসে ফেলল। প্রান শান্তশিষ্ট একটা বাচ্চা যদিও দুষ্টুমি করে তবে নাজিয়ার খুব বাধ্য ছেলে। 


সন্ধ্যায় আবরার অফিস থেকে ফিরলে আবিরের মা বললেন,

- "কাল নাজিয়াকে নিয়ে একবার ডাক্তারের কাছে যাস তো।"

- "কেন? ওহ ঠিক আছে তো!"

- "হুমম, সেটা দেখার জন্যই যেতে বলেছি।"


আবরার ওনার কথা না শুনে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকল। তখন নাজিয়া প্রানকে পড়াচ্ছে। নাজিয়াকে সুস্থ দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল।


- "প্রান।"


প্রান দৌড়ে আবরারের কোলে উঠে যায়।

- "বাবাই।"


আবরার প্রানের গালে চুমু দিয়ে বলল,

- "একটু দিদুনের কাছে যাও তো সোনা, মাম্মামের সাথে আমার একটু দরকার আছে।"


প্রান বাধ্য ছেলের মতো ঘর ছাড়তে আবরার নাজিয়ার পাশে বসে বলল,

- "শরীর ঠিক আছে তো!"

- "হুমম।"

- "সত্যি করে বলো! মা কেন কাল ডক্টরের কাছে যেতে বলল?"

- "একটু বমি হয়েছে, হয়তো অ্যাসিডিটি হয়ে গিয়েছিল।"


আবরার কিছু না বলে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল। বিয়ের ৫বছরে আবরারের ভালোবাসার কোনরকমের পরির্বতন হয়নি, উল্টে ভালোবাসা আরো বেড়েছে, পাগলামী বেড়েছে। এককথায় আবরার নাজিয়াকে এখনো চোখে হারায়।


পরেরদিন, 

আবরার নাজিয়াকে নিয়ে একজন মহিলা ডক্টরের কাছে এসেছে। নাজিয়া আসতে চাইছিল না, শাশুড়িমা জোর করে পাঠিয়েছেন এমনকি কোন ডক্টরের কাছে যাবে এটা উনিই ঠিক করে দিয়েছেন। 


নাজিয়া একাই ভেতরে ডক্টরের সাথে কথা বলছে, আবরারকে বাইরে বসতে বলা হয়েছে।নাজিয়া ডক্টরের কাছে গিয়ে নিজের সমস্যাগুলো বলার পর উনি জিজ্ঞেস করলেন,

- "আপনার পিরিয়ড নিয়মিত হচ্ছে?"

- "নাহ, কয়েকমাস একটু প্রবলেম হচ্ছে।"

- " আপনাদের বিয়ে কতদিন হলো।"

- "৫বছর।"


ডক্টর কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

- "বিয়ের এতবছর হয়ে গেছে আপনারা বেবি নেননি কেন?"


নাজিয়া উশখুশ করে বলল,

- "একচুয়ালী ডক্টর...

- "পার্সোনাল কিছু?"

- "না আসলে আমার বোন মারা যাবার পর তার ছেলেকে আমি মানুষ করতে শুরু করি। তার কেয়ারের জন্য আমরা বেবি নিইনি।"


ডক্টর কিছুটা চিন্তিত স্বরে বললেন,

- "তাহলে হয়তো আপনার জন্য বিষয়টা একটু রিস্কের আছে।"

- "কেন ডক্টর?"

- "আপনি প্রেগন্যান্ট।"


নাজিয়া চমকে উঠল। একটা মেয়ের প্রেগন্যান্সির খবরটা তার জন্য কতটা আনন্দের সেটা একমাত্র সেই জানে। নাজিয়ার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে ডক্টর আর কিছুই বলতে পারল না, একজন মেয়ে হয়ে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না নাজিয়ার অনুভূতিটা।


ডক্টর একজনকে বলল আবরারকে ভেতরে পাঠানোর জন্য। আবরার ভেতরে আসতে ডক্টর মৃদু হেসে বলল,

- "কনগ্রাচুলেশন মিস্টার। আপনি বাবা হতে চলেছেন।"


সেইম একই অনুভূতি আবরারেরও কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা মনে‌ পড়তেই আবরার আঁতকে উঠল। নাজিয়ার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকাতেই ওর বুকটা ধ্বক করে উঠছে। হাসিমাখা মুখটায় হঠাৎ অমাবস্যার ঘন কালো মেঘ দেখে ডক্টর কিছূটা অবাক হলেন,

- "কি হলো মিষ্টার! আপনি খুশি হননি?"


আবরার ঢোক গিলল, একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। ওহ কিছুতেই নাজিয়াকে হারাতে চাইনা।


- "ডক্টর আমরা বেবি চাই না।"


নাজিয়া ও ডক্টর দুজনেই চমকে উঠলেন। সদ্য পিতা হবার সংবাদ পেয়ে কোনো বাবা যে এইরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে এইটা ওনার ধারনার বাইরে ছিল। আবরারের প্রতি ওনার ক্ষোভের সৃষ্টি হলো।


- "আপনি এইসব কি বলছেন? ভেবে বলছেন তো!"


নাজিয়া এখনো শকের মধ্যে আছে, একটার পর একটা ধাক্কা সামলাতে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। একটু আগে মা হবার খবর পেয়ে খত খুশি ছিল আর এখন আবরার এইসব কি বলছে!


আবরার নিজের জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

- "আমি ভেবেচিন্তেই বলছি।"


নাজিয়া ফুঁসে উঠল, 

- "এই তুমি এইসব কি বলছো! আমাদের প্রথম সন্তান আসছে আর তুমি বলছো ওকে আমাদের চাইনা! পাগল হয়ে গেছো তুমি?"


- "হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি। একটা সন্তানের জন্য আমি ভাবির মতো তোমাকে হারাতে দিতে পারব না।দাদার মতো জীবন আমার চাই না। আমার তোমাকে চাই।"


নাজিয়া আর কিছু বলতে পারল না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ডক্টর কিছুই বুঝতে পারছে না, একবার নাজিয়া আর একবার আবরারের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আবরারের চোখের কোনে পানির উপস্থিতি জানান দিচ্ছে  নাজিয়ার প্রতি ভালোবাসা ঠিক কতটা। 


- "আপনারা প্লিজ শান্ত হন। অসুবিধা না থাকলে আমার সাথে সবটা শেয়ার করতে পারেন।"


আবরার কিছু বলল না।‌ নাজিয়া কান্না থামিয়ে বলল,


- "আমার দিদি আর ওর দাদা হাসবেন্ড ওয়াইফ। ডেলিভারির সময়ে দিদি মারা যায়, সেই কারনে ওহ আমাকে বেবি নিতে দিতে চাই না।"


ডক্টর অবাক হলেন। এখনকার যুগে যেখানে বাচ্চা না হলে পরিবারের অশান্তি হয় সেখানে স্ত্রীর লাইফ রিস্ক আছে বলে বেবি নিতে চাইছে না, এইরকম ভালোবাসা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।


- "দেখুন মিষ্টার জন্ম মৃত্যু বিধাতার হাতে লেখা। আপনি আপনার স্ত্রীর লাইফ রিস্কের জন্য বেবি নিতে চাইছেন না, বেবিটাকে ন'ষ্ট করে দিতে চাইছেন। বাবা হয়ে সন্তানকে শে'ষ করে দিতে আপনার কষ্ট হবে না!"


আবরার উত্তর না দিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দিল। বাবা হবে শুনে কতটা খুশি হয়েছে সেটা কাউকে বোঝাতে পারবে না, কিন্তু ওহ নাজিয়ার লাইফ রিস্ক নিতে চাই না। 


- "উপরওয়ালার উপর বিশ্বাস রাখুন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।বাড়ি যান, স্ত্রীর ঠিকমতো যত্ন নিন ইনশাআল্লাহ্ আপনার স্ত্রী সন্তান উভয়েই সুস্থ থাকবে।"

- "আসছি।"


আবরার নাজিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ডক্টর মনে মনে ওদের জন্য দোয়া করলেন, ওনার কাছে অনেক প্রেসেন্টই আসেন তবে আবরার ও নাজিয়ার মতো কাপল জীবনে খুবই কম দেখেছেন। ভালো থাকুক আবরার, নাজিয়া ও ওদের সন্তান।


আবরার নাজিয়াকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় আসে। দুজন দুজনকে অনেককিছুই বলতে চাইছে কিন্তু অদৃশ্য দেয়াল বারবার আটকে দিচ্ছে। আবরার অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পর সমস্ত দেয়াল সরিয়ে নাজিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নাজিয়াও আঁকড়ে ধরল আবরারের শার্ট। বেশকিছুক্ষন সময় কেটে যাবার পর নাজিয়া নিজের ঘাড়ে পানির অস্তিত্ব অনুভব করল, বুঝতে অসুবিধা হলো না আবরার কাঁদছে।


- "সরি নাজিয়া। জানি তুমি আমার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছে। জানো যখন শুনলাম আমি বাবা হবো, ঠিক কতটা খুশি হয়েছি বোঝাতে পারব না। কিন্তু যখনি সেই বীভৎস দিনের কথা মনে পড়ে যায় আমার‌ সাহস হয়নি তোমাকে ওই অবস্থায় দেখার, তাই হুট করে ওই কথা বলে ফেলেছি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি আমি থাকতে তোমার আর আমাদের সন্তানের কিছু হবে না।"


আবরার ওর নিজের কথা রেখেছে। ৯টা মাস নাজিয়ার আদর যত্নের কোনো অভাব হয়নি। দুটো মা, দুটো বাবা, দাদা, স্বামী সবার আদর যত্নে আছে নাজিয়া ও নাজিয়ার অনাগত সন্তান। আবরার নাজিয়ার সামনে নিজেকে খুব শক্ত দেখায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রতিনিয়ত টেনশান করে চলেছে, উপরওয়ালার কাছে প্রতিনিয়ত নাজিয়া ও সন্তানের সুস্থতা কামনা করছে। 


#চলবে...


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২৯

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২৯)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


- "আপনি!"


হাসিব মৃদু হেসে ওদের দিকে আগিয়ে গেল। নাজিয়া ও শ্রেয়া একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে, হাসিবের আগমন কেউই আশা করেনি।


- "অবাক হলে‌ আমাকে দেখে! অবাক হবারই কথা, আসলে আমিই বিনা নেমন্তন্নে চলে এসেছি।"


বিনা নেমন্তন্নে‌ চলে এসেছে! নাজিয়া ও শ্রেয়ার বিস্ময়ে মাত্রা আরো কিছুটা বাড়ল, হাসিব এইখানে কেন এসেছে! আবার কিছু ঝামেলা করবে না তো!


ওদের মনোভাব বুঝতে পেরে‌ হাসিব মৃদু হেসে বলল,

- "ভয় পাবার কিছু নেই। একজনের কথাতে ভেতরের ভালো মানুষটাকে বদলে ফেলে আবার খারাপ মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।"


নাজিয়ার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, শ্রেয়া অবাক চোখে হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসিব শ্রেয়ার হাতে গিফটের একটা প্যাকেট দিয়ে বলল,

- "আমার তরফ থেকে ছোট একটা উপহার, আর নতুন জীবনের শুভেচ্ছা রইল দোয়া করি ভালো থেকো।"


শ্রেয়া গিফটটা নিয়ে মৃদু হাসল। হাসিব নাজিয়ার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল,

- "এটা তোমার জন্য, সুখে থেকো আজীবন।"


নাজিয়া হাসিবের দিকে তাকাল, দুজনের চোখাচোখি হলো। হাসিবের চোখে নাজিয়া স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে যেটা ওর জন্য নিষিদ্ধ। নাজিয়া তাড়াতাড়ি নিজের চোখটা সরিয়ে নিল, হাসিব ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

- "আসছি ভালো থেকো।"


হাসিব চলে গেল।‌নাজিয়া ও শ্রেয়া অন্য গেস্টদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাসিব যাবার পথে পেছনে ফিরে নাজিয়ার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,

- "তোমার হাসির কারন হতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তোমার দুঃখের কারন হয়ে নিজেকে অপরাধী বানাতে চাই না। আমার জীবন সবটুকু সুখ উপরওয়ালা তোমাকে দিক, ভালো থেকো নাজিয়া।"


-----


অবশেষে সেই ক্ষন। আবরার-নাজিয়া ও শান্ত -শ্রেয়া মুখোমুখি বসে আছে কিন্তু মাঝখানে চাদর টানা। দুই ছেলেই একেবারে ভদ্র হয়ে আছে, বউদের দেখার কোনরকমের চেষ্টা করছে না। শ্রেয়া একটু নার্ভাস হয়ে আছে সেইজন্য নাজিয়া ওর হাতটাকে শক্ত করে ধরে বসে আছে। 


কাজিসাহেব প্রথমে শ্রেয়া ও শান্তর বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। শ্রেয়াকে কবুল বলতে বলার সময়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল হেনা ও ওর‌ টিম।


- "শান্ত'দা আমাদের দাবি না মানলে শ্রেয়া'দি কবুল বলবে না।"


আবির ওদেরকে ধমক দিয়ে বলল,

- "এই এখন সর, আগে বিয়েটা মিটুক তারপর সব হিসাব নিকাশ করবি।"


ধমক খেয়ে হেনা ও ওর টিম মুখটাকে কাঁচুমাচু করে ফেলে, এখন বেশি বাড়াবাড়ি করতে যাওয়া মানেই বড়োদের কাছে ধমক খাওয়া তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয়।


শান্ত ও শ্রেয়ার বিয়ে পড়ানোর পর, দ্বিতীয়বারের মতো নাজিয়া ও আবরারের বিয়ে পড়ানো হয়। অনেক ঝড় পেরিয়ে শান্ত ও শ্রেয়া একে অপরের সঙ্গে বেঁধে যায়, ভালো থাকুক ভালোবাসার।


---


বিয়ের সময়ে বড়ো অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পেরে হেনার টিমের মাথায় আরো কিছু শয়তানি বুদ্ধি চলছে। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর বাসর রাতের জন্য শ্রেয়া ও নাজিয়াকে নিজেদের ঘরে রেখে দিয়ে আসে। শান্ত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ওর উপর আক্রমন হয় হেনা ও ওর সঙ্গপাঙ্গদের।


- "জিজু এখুনি ২০হাজার টাকা দাও, নাহলে এইখানে দাঁড়িয়ে রাত কাটাও।"

- "দ্যাখো শ্যালিকারা আমি গরীব মানুষ এত টাকা কোথায় পাবো!"

- "নাটক কম করে তাড়াতাড়ি দিয়ে দে।"


কন্ঠস্বরের মালিককে দেখে সবার‌ চোখ কপালে। আবরার! শান্ত অবাক হয়ে বলল,

- "আবরার তুই?"

- "হ্যাঁ। তোর বউ আমার থেকে টাকা হাতিয়েছিল, এখন আমি তোর থেকে হাতাব।"

- "তুই না আমার বন্ধু! আর বন্ধু হয়ে এইরকম করবি?"

- "এখন আমি তোর শ্যালক। তাই আমাকে আমার প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দে।"


শান্ত বুঝল এদের থেকে ছাড় পাওয়া কষ্টের বিষয়। কিন্তু এতগুলো টাকা ওর কাছে এখন নেয়।


- "এতোগুলো টাকা আমার কাছে নেই তো।"

- "তোর কার্ডটা আমার কাছে জমা দে, যখন টাকা দিবি তখন কার্ড পাবি।"


শান্ত ভাবল আবরার ওকে বাঁচানোর জন্য এইরকম করছে, তাই খুশিমনে কার্ডটা আবরারের হাতে দিয়ে দিল। আবরার শয়তানি হেসে বলল,

- "টাকা না দেওয়া পর্যন্ত কার্ড আমার, ওই তোরা ওকে ছেড়ে দে।"


শান্তকে ছেড়ে দিল কিন্তু আবরারকে কি আদৌও ছাড়বে!

হেনা কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,

- "খবরদার আমাদের সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবে না, ফলটা কিন্তু ভালো হবে না।"


আবরার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিতেই ওদের টনক নড়ল।


- "এই আবরার'দা তো চলে গেল সবকিছু নিয়ে।না পেলাম শান্তদার টাকা আর না আবরার'দার টাকা।"


এতবড়ো ধোঁকাবাজী! হেনা রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়, বাকিরাও ভীষন ক্ষেপে গেছে আবরারের উপর। সুযোগ পেলে বেচারার খবর আছে।


আগামীকাল বৌভাতের অনুষ্ঠান, তারপরের দিন মেয়েরা নিজেদের বাপের বাড়ি ফিরবে আর বাকিরাও নিজেদের বাড়ি চলে যাবে। 


শ্রেয়া শান্তকে সালাম করতে গেলে শান্ত সালাম করতে দেয়নি, কারন ইসলামে পা ছুঁয়ে সালাম করা নিষিদ্ধ। শ্রেয়াকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে বলল,

- "স্ত্রীর স্থান স্বামীর হৃদয়ে। আর পা ছুঁয়ে সালাম করতে নেয় এইটা জানো না!"

- "হুমম ভুল হয়ে গেছে।"


শান্ত শ্রেয়ার কপালে ভালোবাসার চুম্বন দিয়ে বলল,

- "ভুলগুলো শুধরে নেবার দায়িত্ব নিলাম আমি, কথা দিলাম আমাদের মাঝে কখনো ভুল বোঝাবুঝি আসতে দেব না। সবসময়ে আগলে রাখব।"


শ্রেয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শান্তকে। অনেকটা লড়াই করার পর শান্তকে নিজের করে পেয়েছে, কখনোই হারাতে চায় না। শান্তও শ্রেয়াকে আগলে নিয়ে বলল,


- "তোমার সাথে মিশে যেতে চাই, দেবে কি সেই অধিকার।"


শ্রেয়ার সম্মতি পেয়ে শান্ত আর অপেক্ষা করল না। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দিতে থাকল ভালোবাসার মানুষটিকে। ভালো থাকুক শান্ত ও শ্রেয়া।


অন্যদিকে, বিয়ের শাড়ি, সাজগোজ পাল্টে সাধারন একটা সুতির শাড়ি পড়ে নাজিয়া বিছানায় বসে ঢুলছে। নাজিয়ার অবস্থা দেখে আবরারের চোখ কপালে, বউকে বউ সাজে দেখবে তা না বউ গিন্নি সাজে সজ্জিত হয়ে বসে আছে।


- "এই নাজু।"


নাজিয়া ধরফর করে সোজা হয়ে বসল। আবরারকে সামনে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

- "ওহ তুমি আমি ভেবেছিলাম কে না কে।"

- "তোমার সাজের এই দশা কেন?"

- "প্রচুর কষ্ট লাগছিল। মনে হচ্ছিল দম ফেঁটে যাবে তাই চেঞ্জ করে নিয়েছি। ভালো করেছি না!"


আবরার মুখটা ফ্যাকাশে করে বলল,

- "হ্যাঁ খুব ভালো করেছো। কত শখ করেছিলাম বউকে বউ সাজে দেখব। আমার বউকে আমি ছাড়া সবাই দেখেছে।"


নাজিয়া এতক্ষনে আবরারের বিষয়টা বুঝল। মজা নেবার জন্য বলল,

- "বিয়েতে অনেক ছবি তুলেছি, ওইখান থেকে দেখে নিও।"


আবরার মুখটা কালো করে বলল,

- "বউও মজা নিচ্ছে, কি যুগ আসলো।"


নাজিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। আবরার নাজিয়ার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিল, মেয়েটার মুখে এইরকম হাসি আজীবন লেগে থাকুক।


নাজিয়া হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

- "কি দেখছ!"

- "আমার হ্যাপিনেসকে।"


নাজিয়া মৃদু হেসে আবরারের বুকে মাথা রাখল। আবরার পরম যত্নে নিজের প্রিয়তমাকে আগলে নিয়ে চুলে ঠোঁটের পরশ দিয়ে বলল,

- "ভালোবাসি।"


৭দিন পর,


বৌভাত, বাপের বাড়ি ঘুরে আসার পর নাজিয়া পুরোপুরি সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রান আগের থেকে দূরন্ত হয়েছে, আবিরের মা নাতির সাথেই সারাটা দিন কাটান।


নাজিয়া রান্নাঘরে ছিল, তখনি শাশুড়ির কন্ঠস্বর শুনতে পেল,

- "এই নাজি দ্যাখ তোর ছেলে আমাকে মে'রে রাখছে না।"


নাজিয়া বসার ঘরে এসে দেখল প্রান আবিরের মায়ের চুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলা করছে আর হাসছে। নাজিয়া তাড়াতাড়ি প্রানকে সরিয়ে আনলো, আবিরের মা প্রান ফিরে পেলেন।


- "বাবু দিদুন হয় তো এইরকম কেউ করে!"


প্রান কি বুঝল কে জানে, নাজিয়ার মুখে হাত বোলাতে বোলাতে হাসতে লাগল। 


আবরার অফিস থেকে ফিরতে নাজিয়া পানি এগিয়ে দিল। 


- "প্রান কোথায়?"

- "ঘুমাচ্ছে। জানো তোমার ছেলে আজ কি করেছে!"

- "কি করেছে?"

- "মামনির চুল ধরে মেরেছে। সাহস কত হয়েছে দেখছ।"


আবরার নাজিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

- "মায়ের মতো গুন্ডা হয়েছে।"

- "এই আমি গুন্ডা।"

- "না তো আমার বউ গুন্ডা।"


নাজিয়া কিছু বলতে গিয়েও ফিক করে হেসে ফেলল। আবরারও মৃদু হেসে নাজিয়ার কাঁধে নাক ঘষলো।


#চলবে...


গল্পটার আর ১-২টো পর্ব আছে, সকলের রেসপন্স চাই। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। 


আসসালামু আলাইকুম।

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২৮

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২৮)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


শান্ত বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে, আবরার নাজিয়ার সাথে দেখা করতে পারলেও ওহ কিন্তু শ্রেয়ার সাথে দেখা করতে পারেনি এমনকি কাল থেকে শ্রেয়া ফোনটাও রিসিভ করছে না। আর করবেই না কিভাবে ফোনটা ওর কাছে থাকলে তো। শয়তান কাজিনগুলো শ্রেয়া ও নাজিয়ার ফোন নিজেদের কাছে আটকে রেখেছে ওদের একটাই কথা, আগে প্রচুর প্রেম করছ আমরা কেউই বাঁধা দিইনি এখন দুইদিন প্রেম- ট্রেম বাদ। শ্রেয়া ফোন দেওয়া নিয়ে বকাবকি করলেও নাজিয়া লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি। শ্রেয়ার অনেক বলার পরেও ফোন ফেরত পায়নি এইটা নিয়ে বেচারীর ভীষন মনখারাপ।


হেনা শ্রেয়ার পাশে বসে বলল,

- "দ্যাখ শ্রেয়া'দি বরের সাথে আজীবন প্রেম করতে পারবি, কথা বলতে পারবি কিন্তু বল আমাদের কি আর এইভাবে একসাথে পাবি!"


শ্রেয়া রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,

- "তোদের মতো কাজিন থাকলে জীবনে আর শত্রুর প্রয়োজন হবে না।"


হেনা কিছুটা ভাব নিয়ে বলল,

- "তাহলে ভাব আমরা কতটা স্পেশাল।"


শ্রেয়ার ইচ্ছা করছে হেনাকে দুচারটে ধরিয়ে দিতে, এই মেয়েটাই সবার লিডার। কিন্তু প্রচুর আত্মীয় স্বজন আছে, এখন যদি হবু বরের সাথে কথা বলার জন্য বোনের সাথে মারামারি করে তাহলে আর কারোর সামধে মুখ দেখাতে হবে না। মানসম্মানের ভয়ে শুধু চুপ করে আছে।


হেনা শ্রেয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

- "সন্ধ্যায় সারপ্রাইজ আছে।"


সারপ্রাইজ! আবার কি সারপ্রাইজ দেবে কে জানে।


সন্ধ্যাবেলা,

নাজিয়া ও শ্রেয়ার হাতে মেহেন্দি পড়ানো হচ্ছে। ওইদিকে আবরার আর শান্ত মেহেন্দি পড়তে নারাজ। শান্ত তবুও বা রাজি হয়েছিল কিন্তু আবরার ওহ কিছুতেই পড়বে না।


- "আমি মেয়েদের মতো হাতে মেহেন্দি দিয়ে বসে থাকতে পারব নাহ, তোরা ফট এইখান থেকে।"


হেনা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,

- "মেহেন্দি না পড়লে বউয়ের দেখাও পাবে না।"


আবরার নড়েচড়ে বসে পাশে থাকা শান্তর দিকে তাকাল। 


- "বউয়ের দেখা পাবো না মানে?"

- "শুনে কি লাভ! তোমরা তো বলেই দিয়েছ মেহেন্দি পড়বে না।"

- "পড়ব না বলছিলাম কিন্তু এখন তো রাজি হতেও পারি।কি বলবি ভনিতা না করে বলে ফেল।"

- "আমরা ঠিক করেছি মেহেন্দি অনুষ্ঠানের পর সবাই মিলে ছাদে একটু আড্ডা দেব, এটা নিয়ে বড়োদের পারমিশনও নেওয়া হয়ে গেছে।সেখানে বর-কনেরাও থাকবে, কিন্তু তোমরা মেহেন্দি না পড়লে তোমাদের যাওয়া হবে না।"


আবরার হেনার দিকে বাঁকা হেসে বলল,

- "মেহেন্দি পড়লে বউয়ের হাত থেকেই পড়ব, সেটা যদি ম্যানেজ করতে পারিস তো মেহেন্দি করব। আর যদি ভাবিস আমাদের ছাড়াই আড্ডা দেবার প্ল্যান করবি তাহলে ছাদ থেকে সবকটাকে ছুঁড়ে নীচে ফেলে দেব।"


শেষের কথাটা রাগ নিয়ে বলল, এদের অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আবরার ভালো করেই জানত ওর কাজিনমহল এইরকম করবে তাই তো বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না।


হেনা সহ বাকিরা আর কিছু বলল না, কাল থেকে ওদেরকে কম জ্বালাচ্ছে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঝামেলা হয়ে যাবে আর তখন বকুনিটা ওরাই খাবে তাই চুপ থাকাই ভালো বলে মনে হলো।


রাতের খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ করার পর দুই বউকে নিয়ে হেনাদের টিম ছাদে উপস্থিত হলো। আড্ডা দেবার বিষয়টা নাজিয়া ও শ্রেয়া জানত না ওটা ওদের জন্য সারপ্রাইজ ছিল।


ছাদে এসে দুই বরকে দেখে ওরা সত্যিই সারপ্রাইজড হলো, যে কাজিনমহল ঠিক করে ফোনেই কথা বলতে দিতে নারাজ তারাই আবার ছাদে এনেছে এর পেছনে কিছূ মতলব নেয় তো!


নাজিয়া ও শ্রেয়াকে আবরার আর শান্তর মুখোমুখি বসানো হলো। বাকিরা ওদের পাশাপাশি গোল হয়ে বসল।হেনা বক্তৃতা দেবার মতো ভান করে বলল,

- "গাইস আমরা এখন ট্রুথ ও ডেয়ার খেলব। যাকে যা দেওয়া হবে তাকে কিন্তু সেইটা কমপ্লিট করতে হবে।"


কেউ দ্বিমত পোষণ করল না। ট্রুথ ডেয়ার শুরু হলো, প্রথমেই দান পড়ল আবরারের।


- "ডেয়ার।"


হেনা শয়তানি হেসে বলল,

- "তোমার ডেয়ার হচ্ছে এখুনি নিজের বেডরুম থেকে ঘুরে আসবে।"


আবরার বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,

- "এটা তো কোনো ব্যাপার না।"


আবরারের আরেক কাজিন টুসি বলল,

- "আরে আবরার'দা তোমার এই বেডরুম না, তোমার বাড়ির নিজস্ব বেডরুম।"

- "কি! এইটা কিভাবে পসিবেল?"


হেনা শয়তানি হেসে বলল,

- "ডেয়ার কমপ্লিট করতে না পারলে ১হাজার টাকা ফাইন।"


আবরার মুখ কুঁচকে ফেলল, ভালো মতোই বুঝল এরা পকেট ফাঁকা করার প্ল্যান নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তো বেডরুমে যাওয়া সম্ভব না তাই বাধ্য হয়ে ১হাজার টাকা দিতে হলো। আবরারের করুন মুখ দেখে নাজিয়ার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে কিন্তু সবার সামনে হাসতেও পারছে না।


পরের দান অন্য এক কাজিনের হলো। তাকে ডেয়ার দেওয়া হলো গান করার জন্য। এইভাবে খেলা চলার মাঝে শ্রেয়ার দান পড়ল, শ্রেয়া ডেয়ার নিতেই আবরার চেঁচিয়ে উঠল,

- "এই আমি ডেয়ার দেব।"


শ্রেয়া মনে মনে ঢোক গিলল। না জানি আবার কি বাঁশ দেয়।


- "শ্রেয়ার ডেয়ার হচ্ছে এখন এইমুহুর্তে শান্তকে আমাদের সবার সামনে প্রোপজ করতে হবে।"


বাকিরা চেঁচিয়ে উঠল, শ্রেয়া কিছুটা লজ্জা পেল। একটা মেয়ে হয়ে এতজনের সামনে প্রোপজ করতে হবে! সবাই শ্রেয়াকে করার জন্য বলছে, আবরার শ্রেয়া আর শান্তকে ওদের গোলের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়। শ্রেয়া শান্তর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থাকে তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,

- "আমার হাতটাকে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত তো অনেক আগেই নিয়েছ, নতুন করে হাত ধরার কথা আর বলব না। বারবার মুখে ভালোবাসি কথাটা বলার জন্যও অনেকখানি আবদার করব না, শুধু একটা জিনিস চাইব কখনো কোনো কারনে আমাকে অবিশ্বাস করো না। ভুল করলে রাগ না দেখিয়ে শুধরে দিও, প্রয়োজনে শাসন করো তবুও অবহেলা করো না আমি মেনে নিতে পারব না। অবশেষে বলব ভালোবাসতাম, ভালোবাসি আর আজীবন ভালোবাসব।"


সবাই হইহই করে উঠল। শান্ত নিজেও হতবাক। শ্রেয়ার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে হাতদুটোকে শক্ত করে ধরে বলল,

- "জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তোমার সাথে বাঁচতে চাই। কথা দিলাম, তোমাকে নিয়ে ছোট সুখের ঘর বাঁধব যেখানে কোনো ভুল বোঝাবুঝির ঠাঁই থাকবে না। আমিও বলব, ভালোবাসতাম, ভালোবাসি আর আজীবন ভালোবাসব।"


শ্রেয়া ইমোশনাল হয়ে শান্তকে জড়িয়ে ধরল। মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্দি করতে ভুলল না কাজিনমহল। 


আবরার শান্তর পিঠ চাপড়ে বলল,

- "ভাই পুরো ফাঁটিয়ে দিয়েছিস।"


শান্ত লাজুক হাসল। খেলা আবারো শুরু হলো, নাজিয়ার দান আসলে ওহ ডেয়ার নেয় কারন এদের বিশ্বাস নেয় কখন কি করতে বলে কে জানে।


হেনা কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,

- "আবরার'দার কি দেখে তোমার ভালো লেগেছিল?"

- "জানি না।"

- "জানো না! তবুও কিছু বলো কিছু তো একটা দেখে প্রেমে পড়েছিলে?"


নাজিয়া আবরারের দিকে একপলক তাকিয়ে হেনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

- "আমি তার প্রেমে পড়িনি বরং ভালোবেসেছি।"


ওওওওও কাজিনমহলের সবাই আবারো চেঁচিয়ে উঠল। শান্ত আবরারকে খোঁচা দিয়ে বলল,

- "আহা গো কত ভালোবাসা দেখেছিস!"


আবরার উত্তর না দিয়ে মৃদু হেসে নাজিয়ার দিকে তাকাল। মেয়েটা যে ওকে বড্ড ভালোবাসে এটা বুঝতে অসুবিধা নেয়।


এইবার ভাগ্যক্রমে দান পড়ল হেনার কাছে। আবরারের মুখে শয়তানি হাসি লেগে আছে। শয়তানি হেসে বলল,

- "কি নিবি বল! আর তুই যা ভীতু ডেয়ার নিতেই পারবি না।"


হেনা নাক ফুলিয়ে বলল,

- "নাও ডেয়ারই নিলাম।"


আবরারের মুখের হাসি আরো কিছুকা চওড়া হলো, বাঁকা হেসে বলল,

- "তুই এখন এই মুহূর্তে আমাদের সবার সামনে কান‌ ধরে ১০০টা উঠবস করবি।"

- "কি!"

- "ইয়েস। অনেক জ্বালিয়েছিস এইবার বোঝ।"


শ্রেয়াও বলল,

- "হ্যাঁ হেনা শুরু কর।"


কাঁদো কাঁদো মুখ করেও হেনা আবরার আর শ্রেয়ার মন গলাতে পারল না। কান ধরে উঠবস করতে লাগল, ওর গ্যাং এর বাকিদের মুখটা চুপসে গেছে। আবরার যে এইভাবে প্যাচে ফেলবে সেটা বুঝতে পারেনি। হেনা ২০টার মতো উঠবস খাবার পর আবরার ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

- "থাক আর করতে হবে না। এইবারের মতো ছেড়ে দিলাম, পরেরবার আমার সাথে লাগতে এলে সাবধানে আসবি।"


হেনা মুখ বেঁকিয়ে বলল,

- "তোমাকে দেখে নেব।"


আড্ডা ওইখানেই শেষ হয়ে যায়। পরেরদিন সকালে অনেক কাজ আছে তাই সবাই ঘুমাতে চলে গেল।


----


পরেরদিন, 


বিয়ের আয়োজন পুরোদমে চলছে। শ্রেয়া আর নাজিয়াকে বউ সাজানো হচ্ছে। আর ওদিকে শান্ত আর আবরাররাও রেডি হচ্ছে।


- "এই ভাই আমার কিরকম একটা লাগছে।"


আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,

- "কীরকম!"

- "অন্যরকম, প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে কি হবে?"

- "আরে চিল মুডে থাক কিছু হবে না।"

- "শালা তোর তো এইটা দুই নম্বর বিয়ে তোর আর কি টেনশান!"


আবরার ভাব নিয়ে বলল,

- "তাহলে ভাব আমি কতটা লাকি!"


আবরার আর শান্ত দুজনেই হেসে উঠল। সময় পেরিয়ে গেল, শ্রেয়া আর নাজিয়াকে স্টেজে বসানো হয়েছে। লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে, শ্রেয়া ও নাজিয়া স্মাইল দিতে দিতে গাল ব্যথা করে ফেলেছে।


শ্রেয়া নাজিয়াকে খোঁচা দিয়ে বলল,

- "এই আর কতক্ষন এইভাবে থাকব! বিয়ে কখন হবে?"

- "কে জানে। দাঁত বার করতে করতে আমার গাল ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।"


ওদের দুজনের কথার মাঝে একটা চেনা কন্ঠস্বর শুনে দুজনে মাথা তুলে তাকিয়ে চমকে উঠল। শ্রেয়া ও নাজিয়া একসাথে বলে উঠল,

- "আপনি!"


#চলবে...


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।‌আজকের পর্ব আপনাদের কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না।


আসসালামু আলাইকুম।

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২৭

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২৭)

#তানজিলা_খাতুন_তানু


- "এই বউ আমাকে বিয়ে করবে!"


আচমকা এইরকম কথা শুনে নাজিয়া হকচকিয়ে তাকাল। কন্ঠস্বরটা আবরারের কিন্তু কথাটার অর্থ ঠিক ধরতে পারল না, তাই জিজ্ঞেস করল


- "এইসব কি বলছ?"

- "কি বলছি!"

- "বউকে বলছ বিয়ে করার কথা, মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে!"


আবরার মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,

- "মাথা খারাপ আমার নই বাড়ির সবার হয়ে গেছে।"

- "মানে?"

- "সবাই মিলে ঠিক করেছে শান্ত আর শ্রেয়ার সাথে সাথে আমাদেরও বিয়ে দেবে।"


বিষয়টা বুঝতে নাজিয়ার একটু সময় লাগল, যখন বুঝল তখন কি রিয়াকশন দেবে বুঝতে পারল না। লজ্জা পাবে! খুশি হবে, নাকি আবরারের মতো বিরক্ত হবে!


আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,

- "আমাদের গল্পটা অবশেষে পুর্নতা পেল বলো।"

- "হুম।"


----


বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। যেহেতু দুটো বিয়ে একসাথে হবে তাই সবাই মিলে ঠিক করে একটা রির্সোট ভাড়া করা হয়েছে। রির্সোটটা শ্রেয়া ও আবরারের বাড়ির মাঝামাঝি পজিশনে নেওয়া হয়েছে, যাতে চার পরিবারের আত্মীয় স্বজন সহজেই আসতে পারে। আবির বিয়ের সমস্ত আয়োজন দক্ষ হাতে সামলাচ্ছে, বড়ো দাদা বলে কথা তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব।


হলুদের অনুষ্ঠানের ড্রেস থিম সবুজ রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র বর-কনের ড্রেস হলুদ রঙের থাকবে, এখন সবাই একরঙের ড্রেস পড়ে কোনটা আসল বর-কনে সেটাই বুঝতে পারা যায় না।


শ্রেয়া সম্পূর্ণ রেডি অনুষ্ঠানের জন্য। শ্রেয়া হলুদ ও লাল রঙের কম্বিনেশনের একটা শাড়ি পড়েছে, সাথে হলুদ ফুলের গহনা। আর নাজিয়া! 


নাজিয়া শাড়িটা কোনরকমে পড়ে প্রানকে সামলাতে ব্যস্ত। হঠাৎ করেই প্রান বাবু ক্ষেপে গেছে, কিছুতেই কারোর কাছে থাকছে না তাই নাজিয়া সাজগোজ ছেড়ে ছেলেকে সামলাচ্ছে।


বেশকিছুক্ষন পর, প্রানকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে নাজিয়া রেডি হয়ে নিল। নাজিয়ার শাড়িটা হলুদ ও সবুজের কম্বিনেশনে সাথে ফুলের গহনাটাও দুই কালারের। সব মিলিয়ে শ্রেয়া নাজিয়া দুজনকেই খুব সুন্দর লাগছে।


অন্যদিকে,


- "এই ভাই বউকে দেখব না!"


আবরারের জ্বালায় অতিষ্ঠ শান্ত। এই ছেলে কবে থেকে এতটা বউ পাগল হলো কে জানে, খালি কথায় কথায় বউ আর বউ।


- "এই তুই একটু চুপ করবি! সব কথাতে বউ বউ করিস কেন?"

- "বিয়েটা কর, তারপর বুঝবি বউ কি জিনিস।"

- "আবার বউয়ের কথা!"


আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

- "এই তুই যাবি না তো! আমি একাই নাজিয়ার সাথে দেখা করে আসছি বাই।"


শান্ত আবরারের হাত টেনে ধরে বলল,

- "আরে রাগ করছিস কেন? আমি কি একবারো বলেছি যাবো না!"


আবরার শয়তানি হেসে বলল,

- "লাইনে আসো বাছাধন। এতক্ষন কি বলছিলিস! আমি বউ বউ করি। আমার বউ হয়েছে তাই বউ বউ করছি কিন্তু আপনার এত দরদ কেন হবু বউয়ের প্রতি।"


শান্ত বুঝল আবরার ওকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর প্ল্যান করছে, তাই বলল,

- "সরা কান ধরছি। প্লিজ একটাবার শ্রেয়ার সাথে দেখা করার সুযোগ করে দে।"

- "নো চান্স। বিয়ের আগে নো দেখাদেখি।"


শান্ত কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

- "তুই আমার বন্ধু হয়ে এইটা করতে পারবি!"

- "এতক্ষন তুমি আমাকে বউ নিয়ে বলার জন্য ক্ষ্যাপাতে পারো, আর আমি এইটা করতে পারব না! তুই থাক আমি দেখা করে আসি।"


আবরার শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। শান্ত মুখটা করুন করে আবরারকে কয়েকটা গালি ছুঁড়ে দিল।


আবরার ভাব নিয়ে মেয়েদের সাইটে পা বাড়াতেই ওর কাজিন হেনা ওর হাতটা টেনে ধরল। 


- "কি হলো হাত টানছিস কেন?"

- "কোথায় যাচ্ছো এইদিকে?"

- "তোকে বলতে হবে কেন? হাতটা ছাড় বলছি।"

- "সেটা তো‌ হবে না।এইদিকটা গার্ল সাইড তোমার ওখানে যাওয়া বারন।"


আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,

- "আমার একটু দরকার আছে ছাড় বলছি।"

- "তোমার দরকার মানে তো নাজিয়া ভাবির সাথে দেখা করা, কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। বিয়ের আগে দুজন দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ।"


আবরার মনে মনে বেজায় চটছে, কিন্তু তবুও মুখে হাসি রেখে বলল,

- "তোকে কে বলল আমি নাজিয়ার‌ সাথে দেখা করতে যাচ্ছি?"

- "আমি বোকা না ওকে, আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি এইদিকে কি করতে যাচ্ছো।"

- "কি করতে যাচ্ছি?"

- "নাজিয়া ভাবির সাথে দেখা করতে কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।"

- "আরে আমি তো শ্রেয়ার কাছে যাচ্ছি, সর সামনে থেকে।"


হেনা নাছোড়বান্দা কিছুতেই যেতে দেবে না, আবরার ওর সাথে কথাতে না পেরে বলল,

- "কত দিলে রাস্তা ছাড়বি বল।"

- "খুব বেশি না, ২দাও তাতেই চলবে।"

- "শয়তানের নানি" (বিরবির করে)


হেনা কথাটা ঠিক করে শুনতে পায়নি তাই জিজ্ঞেস করল,

- "কি বললে?"

- "কি বলেছি সেটার খোঁজ না করে, টাকাটা কি নিবি!"

- "হ্যাঁ দাও তাড়াতাড়ি।"

- "দেব তো বটে কিন্তু একটা শর্ত আছে।"

- "কি শর্ত!"

- "নাজিয়ার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।"

- "তাহলে আরো ১বেশি লাগবে।"


অন্যসময় হলে আবরার হেনার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ত, কিন্তু এখন বউয়ের সাথে দেখা করাটা জরুরি তাই সবকিছু সহ্য করে যেতে হচ্ছে। কথাতে বলে না, হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাতেও লাথি মারে।


আবরার হেনাকে ৩হাজার টাকা ঘুষ দেবার বিনিময়ে বউয়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেল। নাজিয়া তো কিছুই বুঝতে পারছে না, হেনা কেন ওকে আলাদা করে সাইডে নিয়ে আসল।


নাজিয়া হেনাকে জিজ্ঞেস করল,

- "আরে হেনা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?"

- "তুমি এখানে একটু ওয়েট করো, আমি আসছি।"


হেনা নাজিয়াকে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে যায়। নাজিয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, তখনি ওর চোখটা কেউ একজন চেপে ধরল। আচমকা এইরকম হওয়াতে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু চিরচেনা গায়ের গন্ধ আর স্পর্শে বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না মানুষটা আসলে কে!


- "তুমি এইখানে!"


আবরার নাজিয়ার চোখ ছেড়ে দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

- "ইয়েস, বউকে দেখতে আসলাম।"


নাজিয়া আবরারকে ভেংচি দিয়ে বলল,

- "ঢং দেখলে বাঁচি না, যতসব।"


আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ঘষতে লাগল। নাজিয়া আবরারের পেটে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,

- "আরে কি হচ্ছে ছাড়ো, কেউ চলে আসবে তো।"

- "কেউ আসবে না, আর আসলেও কি আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি।"

- "আহ্ কত ভালোবাসো।"

- "অনেক ভালোবাসা গো।"


আবরার নাজিয়াকে ছেড়ে দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল,

- "আমার বউকে পুরো হলুদ পরী লাগছে, নজর না লাগুক।"

- "তোমার নজর তো লেগেই গেছে।"


আবরার নাজিয়ার কথা শুনে দাঁত বের করে বলল,

- "আমার নজর লাগলে কিছু হবে না, তুমি তো শুধু আমার।"


নাজিয়া মৃদু হাসল, আবরারের পাগলামী দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। ছেলেটা এত বউ পাগল কবে হলো!


----


হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, সবাই শ্রেয়া আর নাজিয়ার গায়ে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। আবরার আর নাজিয়া দের হলুদের জায়গা আলাদা করা হয়েছে, প্রথমে আবরারদের হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে নাজিয়াদের হলুদ ছোঁয়ানোর কাজে ব্যস্ত সবাই। আর আবরাররা এখন কাজিনমহলের হাতে বন্দি...


 আবিরের মা শ্রেয়ার গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

- "খুব সুখে থাকিস।"

- "দোয়া করো মামনি।"


শ্রেয়াকে হলুদ ছোঁয়ানোর পর আবিরের মা নাজিয়ার গায়ে হলুদ দিয়ে বলল,

 - "অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে তার জন্য মাফ চাইব না। তবে একটা জিনিস চাইব, আমার পরিবার'টাকে আজীবন আগলে রেখো।"


নাজিয়া ওনার হাতটাকে শক্ত করে ধরে বলল,

- "আমি আমার সবোর্চ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব। আপনি শুধু আমার ও আমাদের জন্য দোয়া করবেন।"

- "সবসময়েই করি।"


একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়াল, আবির শ্রেয়া আর নাজিয়ার কপালে হলুদ দিয়ে বলল,

- "দোয়া করি আমার দুইবোনই যেন সুখের চাদরে মোড়া থাকে।"


নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,

- "তোমার মতো দাদা থাকলে প্রতিটা বোনই সুখে থাকবে।"


----


আবরার আর শান্তকে হলুদে ভূত সাজিয়ে দিয়েছে ওদের কাজিনগুলো।আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,

- "আরে আর কত মাখাবি, এইগুলো তুলতে গেলে তো আমি শেষ।"


হেনা আবরারের মুখে আরো কিছুটা হলুদ মাখিয়ে দিয়ে বলল,

- "আরে দুইবার বিয়ে করছ, একটু বেশি করে না মাখলে হয় নাকি।"

- "যতসব।"


আবরার রাগে একাই স্টেজ থেকে উঠে চলে যায়, কাজিনমহল ওর কান্ডে হেসে উঠল। এতদিনে ব্যাডাকে জব্দ করতে পেরেছে এতে কাজিনমহলের খুশির শেষ নেয়।


অনুষ্ঠান হইহই করে শেষ হয়ে যায়। নাজিয়া নিজের বরাদ্দকৃত রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। এখানে সবাই আছে কিন্তু নাজিয়ার খুব কাছের একজন মানুষ নেই। ছোট থেকে যার সাথে বেড়ে উঠা, সময় কাটানো সুখ -দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, মনখারাপের সঙ্গী হওয়া, আনন্দগুলো একসাথে কাটানোর মানুষটাই নাজিয়ার জীবনের এতবড়ো দিনে মানুষটা ওর পাশে থাকতে পারল না। হয়তো কোথাও না কোথাও আছে, আর ঠিকই দেখে চলেছে নাজিয়াকে। 


নাজিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে অশ্রুভেজা চোখে বলল,

- "একা একা খুব ভালো আছিস তাই না! জানিস দিদি আজ তুই থাকলে কত আনন্দ করতিস, হইচই করে নিজের দেবর আর বোনের বিয়ে দিতিস। আজ তুই নেয়, তবে আমাদের মনে ঠিকই আছিস। যেখানেই থাকিস খুব ভালো থাকিস, আর দোয়া করিস।"


#চলবে...


আজকের পর্বটা আপনাদের কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২৬

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২৬)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


শান্তর মা ছেলের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

- "এই তোর বন্ধু এইসব কি করছে? আমাদের মান-সম্মান ডোবাবে নাকি!"


শান্ত কিছু বলতে পারল না। ওহ নিজেই বুঝতে পারছে না, আবরারের এইরকম ব্যবহারের কারন কি!


শ্রেয়ার বাবা সহ বাড়ির বড়োরা উপস্থিত হয়ে শান্তর‌ পরিবারের‌ সাথে আলাপ করতে লাগলেন। কিন্তু শান্তর সেইদিকে নজর নেয়, বারবার ওদিক সেদিক উঁকি দিয়ে আবরারকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছে।


আবির শান্তর পাশে বসে নিম্নস্বরে বলল,

- "কি ব্যাপার এদিক ওদিক তাকাচ্ছ, বউয়ের জন্য তর সইছে না বুঝি!"


শান্ত চিন্তিত কন্ঠে বলল,

- "একচুয়ালী সেটা নাহ। আবরার ভেতরে কোথায় চলে গেল অনেকক্ষণ হলো তাই খুঁজছিলাম।"


আবির কিছু না বলে মৃদু হাসল। দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা চলছে, সবাই রাজি। আবরার আর আবির আগে থেকেই সবাইকে সবকিছু বলে রাজি করিয়ে রেখেছিল, তাই আর হিটলার হিটলার গিরি করতে পারল না।


কিছুক্ষন কেটে যাবার পর, আবরার একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে আসলো। শান্ত বোঝার চেষ্টা করছে বাচ্চাটা আসলে কে!  শান্তর পরিবার একটু বিরক্ত হচ্ছে আবরারের কান্ডে, ওনারা রীতিমতো উশখুশ করছেন আবরারকে দু-চারটে কথা শুনিয়ে দিতে পারলে শান্তি হতো। অচেনা জায়গায় পাত্রী দেখতে এসে পাত্রপক্ষের কেউ এইভাবে কিভাবে ঘোরাঘুরি করে!!


শ্রেয়ার বাবা আবিরের উদ্দেশ্যে বললেন,

- "আবির শ্রেয়াকে নিয়ে আসতে বলো তো একটু।"

- "জ্বি মামা।"


আবির উঠে ভেতরে চলে যায়। শ্রেয়ার বাবার চোখ পড়ে আবরারের উপর, মৃদু হেঁসে বলল,

- "আরে আবরার কখন আসলে? সেই কখন থেকে তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম।"

- "এই তো কিছুক্ষন আগে আসলাম।"


সবকিছু শান্তর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আসলে এইখানে হচ্ছেটা কি!!


ওইদিকে,


নাজিয়া শ্রেয়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শ্রেয়া প্রচন্ড নার্ভাস।


- "এই নাজিয়া আমার খুব ভয় লাগছে।"

- "আরে ভয় কিসের। শান্ত'দা আর ঐর পরিবারই তো।"

- "তবুও আমার অনেকটা টেনশন হচ্ছে।"

- "কুল থাকো।"


আবির দরজায় নক করল,

- "এই নাজু শ্রেয়াকে নিয়ে বসার ঘরে আয়।"

- "চলো ডাক পড়ে গেছে।"

- "ভয় লাগছে।"

- "চলো তো।"


নাজিয়া শ্রেয়াকে জোর করে বসার ঘর পর্যন্ত নিয়ে এসে বসিয়ে দেয়। শান্তর চোখ কপালে, এইখানে নাজিয়া!! শান্ত মনে মনে বলল,

- "নাজিয়া আবরার এইখানে, আসলে হচ্ছেটা কি!"


 শান্তর সাথে ওর এক আন্টিও এসেছিল তার চোখ আটকায় নাজিয়ার দিকে।শ্রেয়ার সাথে শান্তর মা কথা বলে, তারপর শ্রেয়া আর শান্তকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পাঠানো হয়।


ছাদে চারজন দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত শ্রেয়ার সাথে কথা ধা বলে আবরারের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,


- "এই সত্যি করে বল তো কেসটা কি! তুই আমাদের সাথে আসলি তারপর হাওয়া হয়ে গেলি। তারপর ফিরলি একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। আবার শ্রেয়ার বাবাও তোকে চেনে, নাজিয়াও এইখানে। বল‌ কেসটা কি?"


আবরার হা হা  করে হেসে উঠল, শান্তর রাগ বাড়ছে এতটা সিরিয়াস মুমেন্টে ওহ হাসছে কিভাবে?


----

বিয়ের আলোচনার একটা পর্যায়ে শান্তর আন্টি জিজ্ঞেস করল,

- "শ্রেয়ার সাথে যে মেয়েটা এসেছিল সে কে হয় আপনাদের?"

- "নাজিয়া আমার বোনপোর বউ।"

- "বউ!" 


একটা বড়ো ঝটকা খেলেন উনি। আশা করেছিলেন নাজিয়াকে নিজের বউমা বানাবেন কিন্তু কপাল খারাপ।


শ্রেয়ার বাবা মুচকি হেসে বললেন,

- "হ্যাঁ নাজিয়া আমাদের আবরারের বউ। আপনারা তো আবরারকে চেনেন।"


ওনারা অবাক হলেন, আর অবাক হবারই কথা আবরারের পরিচয় ওনাদের কাছে অজানা ছিল। আবরার এই বাড়ির ছেলে সেই কারনেই এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল।


সবাই আবার ভুল টপিক শ্রেয়াও শান্তর বিয়েতে ফিরে গেল। ওইদিকে, আবরারের উপরে বেজায় ক্ষেপে গেছে শান্ত। ছেলেটা যত ক্ষেপে যাচ্ছে আবরার ততই ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে মাঝখান থেকে নাজিয়া আর শ্রেয়া মজা নিতে ব্যস্ত।


শান্ত বিরক্ত হয়ে বলল,

- "ভাবি তুমি তো অন্তত বলো কেসটা কী।"


নাজিয়া নিজের হাসিটাকে চেপে রেখে বলল,

- "তোমাদের দুজনের মধ্যে হচ্ছে আমি এইখানে থার্ড পারসন হতে পারব না।"


শান্ত মুখটা বিকৃতি করল, ওরা দুজন না থাকলে আবরারকে কয়েকটা গালি দিয়ে দিত। কিন্তু ওদের সামনে দিতেও পারছে না, ইচ্ছা করছে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে।


আবরার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল,

- "শ্রেয়ার ফুপাতো ভাইকে যদি কখনো সামনে পাস তুই কি করবি?"


শান্ত মুখ দিয়ে কিছু শব্দ ব্যবহার করতে গিয়েও গিলে নিল। তারপর বিরক্ত হয়ে বলল,

- "খু'ন করতে পারলে শান্তি পেতাম।"


আবরার নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে, সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

- "আমিই শ্রেয়ার ফুপাতো ভাই।"

- "ওহ.... কি!!"


শান্তর চোখে মুখে বিস্ময়, শ্রেয়ার দিকে তাকাতে ইশারায় বোঝাল হ্যাঁ আবরারই সেই ব্যক্তি। ভাগ্যিস শান্ত স্ট্রং হার্টের মানুষ নাহলে নির্ঘাত হার্ট এ্যাটাক করে ফেলত কথাটা শুনে।


- "তুই সে! তাহলে এতদিন বলিস নি কেন?"

- "সারপ্রাইজ দেব বলো।"

- "বাই দ্যা ওয়ে, বাচ্চাটা কে?"

- "সারপ্রাইজ।"


শান্ত মুখটা বিকৃতি করে হাত জোড় করে বলল,

- "থাক ভাই আর সারপ্রাইজ দেওয়া লাগবে না তোর।"


সবাই হেসে উঠল। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এইটাই তো শান্তি।


-----


শান্ত আর শ্রেয়ার বিয়ের ডেট ফাইনাল করা হয়েছে সামনের মাসের ২৪তারিখ। দুই পরিবারের সকলের মতামত নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আবির এর মাঝে বলল,

- "আমার একটা প্রস্তাব ছিল।"

- "কি প্রস্তাব?" (শ্রেয়ার বাবা)

- "শান্ত আর শ্রেয়ার সাথে সাথে আবরার আর নাজিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানও আরেকবার করতে চাই।"


শান্তর পরিবার বিষয়টা বুঝতে পারলেন না, তাই শান্তর বাবা জিজ্ঞেস করলেন,

- "ওরা তো বিবাহিত তাহলে?"

- "একচুয়ালি আঙ্কেল ওদের বিয়েটা হুট করেই হয়েছিল, অনুষ্ঠান করার মতো সুযোগ ও পরিস্থিতি কোনটাই ছিল না তাই আমরা সবাই ওদের বিয়েটা আনুষ্ঠানিক ভাবে দিতে চাই। আপনাদের কোনো অমত না থাকলে তাহলে বিয়ের অনুষ্ঠানটা একসাথে করতাম।"

- "না অমত করার কি আছে, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।"


----


আবরার গালে হাত দিয়ে বসে আছে, আর আবির বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।


- "এই তুই এইভাবে গালে হাত দিয়ে বসে আছিস কেন?"

- "তো কি করব?"

- "বিয়ে হবে কোথায় নাচানাচি করবি তা না চুপচাপ বসে আছিস কেন?"

- "তুমি তো সব গন্ডগোল করে দিলে।"

- "আমি আবার কি করলাম!"

- "কি করলাম মানে! কোথায় ভাবলাম শান্ত আর শ্রেয়ার বিয়েতে আনন্দ করব। আমার সাথে করা সমস্ত অন্যায়ের শোধ তুলব কিন্তু না এখন আমাকেই বর হয়ে বসে থাকতে হবে।"


আবির ভ্রু কুঁচকে বলল,

- "তোর সাথে কে আবার কি অন্যায় করল?"

- "আমার বিয়ের সময় তোমরা কি করছ আমি কিন্তু কিছু ভুলিনি। দাদা বিয়েটা কি করতেই হবে!"


আবির বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে চলে গেল। ছেলেটা মনে হয় অতি খুশিতে পাগল হয়ে গেছে, যতসব।


#চলবে...


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।


সকাল সকাল গল্প দিয়ে দিয়েছি, সবার রেসপন্স চাই😚

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২৫

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২৫)

#তানজিলা_খাতুন_তানু


- "আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলে তুমি!"


নাজিয়া পেছন ফিরে বলল,

- "আসলে কি বলুন তো, আপনার মতো মানুষ কাউকে সত্যিকারের ভালবাসতে পারে এই বিষয়টা আমাদের মাথাতেই আসেনি। আপনাকে আপনার পথে মাত দেবার জন্যই এই পথ অবলম্বন করতে হয়েছে।"


হাসিব মলিন হাসল। তারপর বলল,

- "অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আমি তোমাকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার কারনে নিজেকে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু দ্যাখো তার আর কোনো প্রয়োজন পড়বে না।"


নাজিয়া হাসিবের মুখের দিকে তাকাল, ছেলেটার মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মনের ব্যথাগুলো। হয়তো সত্যি নাজিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছে। নাজিয়া পুনরায় চেয়ারে বসল, তারপর হাসিবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলতে শুরু করল,


- "জানেন ভালোবাসা মানে কি? ভালোবাসা হলো এমন একটা অনুভুতি যেটা না চাইতেও হয়ে যায়, হাজার বারন সত্ত্বেও আমাদের মনে অন্য মানুষের বসবাস হয়ে যায়। কাউকে ভালোবাসার প্রথমদিনের অনুভূতি'গুলো বড্ড সুন্দর, কিন্তু দিন যত আগিয়ে যায় অনুভুতি গুলো নানান কারনে বিষাক্ত হতে শুরু করে। কখনো হয় আমরা যাকে ভালোবাসি সে আমাদের ভালোবাসে না। আবার দুজন দুজনকে ভালোবাসলে পরিবারের মত থাকে না, মানে সমস্যা একটা না একটা লেগেই থাকে। ভালোবাসলে স্বার্থপর হলে চলে না, ভালোবাসতে জানলে ত্যাগ করতেও জানতে হয়। ভালোবাসা মানে অপর মানুষটিকে সুখী দেখা, তাকে ভালো থাকতে দেখা।"


হাসিব আহত গলায় বলল,

- "ভালোবেসে আমিও বদলে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি সেই সুযোগটা দিলে না।"

- "বাহ্ এই আপনার ভালোবাসা!"

- "মানে?"

- "আমাকে ভালোবেসে বদলে যেতে চেয়েছিলেন, আর আমাকে পাননি বলে বদলাবেন না খারাপ মানুষটাই থাকবেন! তাহলে আমাকে ভালোবাসলেন কোথায়?"


হাসিবের চোখে মুখে কৌতুহল। নাজিয়া কি বলতে চাইছে?


- "আপনি যদি আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকেন তাহলে একজন সৎ মানুষ হয়ে দেখান।অন্যের চোখের পানিতে কখনোই সুখী হওয়া যায় না।"


হাসিব মৃদু হেসে বলল,

- "তাহলে তো তুমিও কখনো সুখী হতে পারবে না।"

- "অভিশাপ দিচ্ছেন?"

- "না তোমার কথার প্রেক্ষিতেই বলছি।"


নাজিয়া মৃদু হাসল। আবরারকে পাবার লড়াইটা কম ছিল না, নিয়তির জোরে দুজন এক হয়ে হয়েছে আর সুখেও আছে। বিধাতা ছাড়া ওদের আলাদা করবে কে!


নাজিয়ার মুখে হাসি দেখে হাসিবের কৌতুহল আরো বেড়ে গেল।


- "তুমি হাসছ কেন?"

- "ভাগ্যের কথা ভেবে।ভাগ্যে‌ থাকলে কি না হয়, যেমন আমাকেই দেখুন না যার কাছে নিজের ভালোবাসার করব না বলে ৫বছর নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে হোস্টেলে গিয়ে থাকলাম শেষে ভাগ্যও তার সাথেই জড়িয়ে গেল।"

- "বুঝলাম না।"

- "কি গল্প অজানাই থাকুক, কখনো যদি দেখা হয় তখন না হয় আমাদের "এক আকাশ দূরত্ব" এর গল্পটা আপনাকে বলব। আজ আসি, ভালো থাকবেন আর পারলে ভালো মানুষ হয়ে উঠুন।"


নাজিয়া আর পেছন ফিরে তাকাল না। হাসিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মনে মনে খুব করে চাইছিল নাজিয়া একটাবার পেছনে ফিরে তাকাক কিন্তু সেটা হয়নি। নাজিয়ার কোনো পিছুটান নেয় তাই ফিরে তাকানোর কথাও আসছে না।


****


মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। সবকিছু এখন স্বাভাবিক ভাবেই চলছে, সবাই ভালোই আছে।আবির,আবরার নাজিয়া নিজেদের বাড়ি ফিরে এসেছে। আল ওইদিকে, শ্রেয়া আর শান্তর বিয়ের কথা চলছে। একটা নির্দিষ্ট দিনে শান্তর পরিবার শ্রেয়াকে দেখতে যাবার সিদ্ধান্ত হয়েছে।সেটা নিয়ে শান্ত আবরারকে খুঁচিয়ে চলেছে।


আবরার প্রানকে নিয়ে দুষ্টুমি করছিল, আর নাজিয়া পাশে বসে ওদের কান্ড দেখছে। তখনি আবরারের ফোন বেজে উঠল।

 

- "কে ফোন করেছে দ্যাখো তো।"


নাজিয়া ফোনটা নিয়ে দেখল শান্তর নম্বর। 


- "শান্ত'দা।"

- "ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দাও।"


ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দিতেই ওপাশ থেকে শান্তর গলা ভেসে আসলো।


- "হ্যালো ভাই।"


আবরার শয়তানি করে বলল,

- "এটা কোনো ভাইয়ের নম্বর না। আপনি কোন ভাই'কে খুঁজছেন?"

- "এই শালা শয়তানি বন্ধ করবি।"


আবরার ফিসফিস করে বলল,

- "এতদিনে ঠিক সম্বোধন করেছিস।‌ সাব্বাস।"

- "এই বলছিস? শুনতে পাচ্ছি না তো।"

- "কিছু না তুই বল।"

- "ভাই আমার খুব টেনশান হচ্ছে। কাল কি হবে?"


আগামীকাল শ্রেয়াকে দেখতে যাবার কথা, সেটা নিয়ে প্রচন্ড টেনশনে আছে শান্ত। শ্রেয়ার বাবা যদি বেঁকে বসে তো! 


- "কি আর হবে? যাবি খাবি কথা বলবি।"

- "আমার খুব টেনশান হচ্ছে কিন্তু।"

- "এত টেনশান করার কি আছে? কিছু হবে না।"

- "ওই হিটলার যদি না মানে তো।"


হিটলার! সেইটা আবার‌ কে? আবরার বুঝতে না পেরে বলল,

- "এই হিটলার'টা কে?"

- "ওই শ্রেয়ার বাপ। যন্ত্রর পিস মাইরি, মেয়ের রিলেশন আছে জানার পরেও বোনপোর সাথে বিয়ে দিতে চাইছিল।"


ওদের কথা শুনে নাজিয়া মুখ চেপে হাসছে। শান্ত এখনো আবরার আর শ্রেয়ার সম্পর্কের কথা জানেনা, ওরা সারপ্রাইজ দেবে বলে বলেনি। আবরার শান্তকে ইচ্ছা করে খোঁচা দিয়ে বলল,

- "তাহলে বিয়ে ভাঙল কিভাবে?"

- "শ্রেয়ার ফুপাতো ভাই অন্য একজনকে পছন্দ করত শেষে তার সাথেই বিয়ে হয়। ভাগ্যিস তার অন্য কেউ ছিল নাহলে আমি বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যেতাম।"

- "বিধবা!! ছেলেরা আবার বিধবা হয় নাকি?"

- "ঐই বাদ দে এইসব টপিক। আসল কথাতে আসি।"

- "বলুন দুলাভাই।"


শান্ত কপাল কুঁচকে বলল,

- "কে দুলাভাই? কার দুলাভাই?"

- "আরে তুই একটু আগে শালা বললি তাই বললাম।"

- "ওহ সেটাই বল। আচ্ছা শোন কাল তুই আমার সাথে শ্রেয়াদের বাড়ি যাবি।"

- "পাগল নাকি ভাই, আমি কি করতে যাবো।"

- "আরে তুই গেলে আমি একটু সাহস পাবো, প্লিজ চল না।"


আবরার নাজিয়ার দিকে তাকাল, নাজিয়া হ্যাঁ বলতে বলে। কিন্তু আবরারের মাথাতে তো অন্যকিছু ঘুরে চলেছে,তাই সে বলল,

- "যেতে পারি তবে কী দিবি বল।"

- "আমার বউ বাদে যা চাইবি তাই দেব। প্লিজ চল।"


আবরার হেসে উঠল, ওর জীবনে এই সময় গুলো আসেনি কিন্তু তবুও শান্তর এক্সসাইটেড দেখে বুঝতে পারছে ভালোবাসার মানুষটিকে পরিবার নিয়ে দেখতে যাবার অনুভূতি কেমন হয়।


পরেরদিন, যথাসময়ে আবরার, শান্ত ও শান্তর পরিবার শ্রেয়ার বাড়িতে উপস্থিত হলো। শান্ত প্রচন্ড নার্ভাস, সেটা নিয়ে আবরার মজা নিয়ে চলেছে। শান্ত আবরারের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বলল,

- "তোর কপাল ভালো তোর বিয়ে হয়ে গেছে,আর বিয়ের সময়ে আমি ছিলাম না। নাহলে আমার সাথে মজা করার শখ তোর মিটিয়ে দিতাম।"


আবরার হেঁসে উঠল, সেটা দেখে শান্ত ও ওর পরিবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। শান্ত আবরারকে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

- "এই তুই কি করছিস, আমার বিয়ে ভাঙবি নাকি?"

- "আরে চিল...


আবরার কথাটা শেষ করে শিষ বাজাতে বাজাতে ভেতরে চলে গেল। শান্ত আর ওর পরিবার হতভম্বের মতো তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, আসলে হচ্ছেটা কি!


#চলবে....


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।



গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২৪

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২৪)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


শ্রেয়া মৃদু হেসে বলল,

- "এই বছরটা আমাকে অনেককিছুই দিয়েছে। এমনকি আংশিক মৃ'ত্যুর স্বাদটাও পেয়েছি, এখন মনে হচ্ছে সেইদিন ম'রে গেলেই ভালো....


কথাটা শেষ করার আগেই শ্রেয়ার গালে থাপ্পর পড়ল। শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আর শান্ত! নিজের ভালোবাসার মানুষটির মৃ'ত্যু কামনা কি কেউ করতে পারে! না সহ্য করতে পারে! শান্তও পারল না। বসা থেকে উঠে গিয়ে শ্রেয়াকে আগলে নিল, শ্রেয়াও শান্তর কোমড় জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। অভিমানের কারনে সম্পর্কটা কিরকম ফিকে হয়ে গিয়েছিল।


- "মরার কথা বললে, ঠাটিয়ে গাল লাল করে দেব। তোমাকে মরতে দেব বলে কি এতকিছু করলাম।"


শ্রেয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

- "তো কি করব! তুমি তো আমার উপরে অভিমান করে কথায় বলছিলে না।"

- "অভিমান করাটা কি স্বাভাবিক না।"


শ্রেয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল। শান্ত মলিন কন্ঠে বলল,

- "জানো তোমার এড়িয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে ব্লক দেওয়া আমাকে ঠিক কতটা মানসিক অশান্তিতে রেখেছিল। প্রতিটা মুহূর্তে নিজের সাথে লড়াই করে চলেছিলাম, একটা কথা খুব করে বুঝেছিলাম তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। তোমাকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছিলাম, যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারিনি। যখন তোমার সত্যিগুলো জানতে পারলাম তখন তোমার উপরে বড্ড অভিমান হলো, তুমি যদি একটাবার আমাকে সবটা খুলে বলতে তাহলে এতকিছু সহ্য করতে হতো না।"

- "সরি। আসলে সেই পরিস্থিতিতে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেইটা বিচার করার ক্ষমতা আমার ছিল না।প্লিজ একটা শেষ সুযোগ দাও, কথা দিচ্ছি আর কখনো এইরকম করব না।"

- "আর সুযোগই দেব না এইরকম করার।"


শ্রেয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তাহলে কি শান্ত ওকে মাফ করবে না!


- "বলো বাড়িতে কবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো।"


শ্রেয়া চমকে উঠে শান্তর মুখের দিকে তাকায়, শান্তর মুখে হাসি। শ্রেয়া বলল,

- "সত্যি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে!"

- "হুম।"


শ্রেয়া নিজের প্রান ফিরে পেল। যাক অবশেষে শান্তর অভিমান ভাঙাতে পেরেছে এইটাই অনেককিছু।


***


আবরার আবিরকে খোঁচা দিয়ে বলল,

- "এই দাদা ওইদিকে কি হচ্ছে বল তো!"

- "আমি কিভাবে বলব! তুই যেখানে আমিও সেইখানেই আছি।"

- "আমার কিন্তু অনেক টেনশন হচ্ছে। ওই হাসিবকে নাজিয়া কিভাবে হ্যান্ডেল করবে কে জানে।"

- "টেনশান করিস না, নাজু ঠিক সামলে নেবে। তবে সামনে আমাদের কিন্তু অনেক কাজ।"


আবিরের কথার অর্থ আবরার বুঝল না। কাজ! কি কাজ? আবরার আবিরকে জিজ্ঞেস করল,

- "কি কাজ?"

- "আরে শান্ত আর শ্রেয়ার‌ বিয়ে লাগবে, আর আমরা ওর বড়ো‌দাদা তার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে না।"

- "হ্যাঁ সেটা তো বটেই। আমরা আমাদের বোনের বিয়ে ধুমধাম করে দেব, তবে শান্তর অভিমান এত সহজে ভাঙলে হয়।"

- "নারীর ভালোবাসার কাছে পুরুষের অভিমান ভাঙতে বাধ্য। শ্রেয়া ঠিক শান্তকে মানিয়ে নেবে তুই এত টেনশান নিস না।"

- "হু।"


----


নাজিয়া আর হাসিব দুজন দুজনের মুখোমুখি বসে আছে। হাসিব নাজিয়াকে দেখতে ব্যস্ত, আজ ওকে অন্যরকম লাগছে। চোখে চশমা নেয়, সাজটাও অনেকটাই আলাদা যেন এক অন্য নাজিয়া ওর‌ সামনে বসে আছে। অন্যদিকে নাজিয়া উশখুশ করছে, সত্যিটা আজকে ক্লিয়ার করতেই হবে কিন্তু তারপর হাসিব কি রিয়াক্ট করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।


- "কি নাজিয়া চুপ করে আছো কেন? কি বলবে বলছিলে।"

- "আসলে।"

- "আচ্ছা তোমারটা পড়ে শুনব, তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।"

- "কি নিউজ।"

- "আমি মাকে তোমার কথা বলছিলাম, মা বলেছে তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে।"


হাসিবের কথা শুনে নাজিয়ার চোখ চড়কগাছ। সর্বনাশ! এই ছেলে তো দেখি বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছে। না আজ যে করেই হোক সত্যিটা বলতেই হবে।


হাসিব নাজিয়াকে বলল,

- "তুমি তোমার বাড়ির ঠিকানা'টা দাও।"

- "তার আর কোনো দরকার নেয়।"

- "কেন?"

- "আপনার আর আমার বিয়ে হওয়া পসিবল না।"


হাসিবের কপালে ভাঁজ পড়ল। নাজিয়ার কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছে না, মেয়েটা কি সব বলছে!


- "কেন? কি সমস্যা।"

- "কারন আমি বিবাহিত।"

- "হোয়াট?"

- "হ্যাঁ আমি বিবাহিত আর আমার একটা ছেলেও আছে।"


হাসিব বিরক্ত হয়ে বলল,

- "নাজিয়া ফাজলামি বন্ধ করো, এইসব মজা আমার একদম পছন্দ না।"


নাজিয়া সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

- "আপনার সাথে আমি কোনো মজা করছি না। সত্যিটা বললাম।"


হাসিব এখনো‌ নাজিয়ার কথা বিশ্বাস করেনি, ওহ ভাবছে নাজিয়া ওর সাথে‌ প্রাঙ্ক করছে। তাই সিরিয়াস না হয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

- "ওকে। এটাই যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি নিজের স্বামী সন্তান ছেড়ে আমার সাথে রিলেশনে গিয়েছ কেন?"


নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল,

- "আপনাকে শাস্তি দেবার জন্য।"


এইবার হাসিবের কপালে ভাঁজ পড়ল। নাজিয়া কোন শাস্তির কথা বলছে! বিষয়টা কেন যেন হাসিবের কাছে আর মজা লাগল না, এইবার মনে হলো নাজিয়া সত্যি বলছে। তাই জিজ্ঞেস করল,

- "কিসের শাস্তি! কি অন্যায় করেছি আমি?"


নাজিয়া তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,

- "একটা মেয়ের প্রাইভেট ভিডিও করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার পরেও বলছেন কি অন্যায় করেছি!"


হাসিব চমকে উঠল। নাজিয়া বিষয়টা জানল কিভাবে? আমতা আমতা করে বলল,


- "কি সব বলছ তুমি? এইসব তু-মি কিভাবে জানলে?"

- "কেন অবাক হচ্ছেন আমি কিভাবে জানলাম? শুধুমাত্র আপনার জন্য শ্রেয়া'দি সুই-সাইড করতে গিয়েছিল। আর একটু দেরি হয়ে গেলে, মানুষটাকে আর বাঁচানো যেত না।"


হাসিব মাথা নিচু করে নিল। প্রথমদিকে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও নাজিয়ার সাথে পরিচয় হবার‌ পর নিজের অতীতের কাজগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে উঠছিল, মনে‌ হচ্ছিল অন্যায় করেছে। তার জন্য শ্রেয়ার‌ কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ফোনও করেছিল কিন্তু শ্রেয়াকে ফোনে পায়নি। কাল যখন নিজে থেকে শ্রেয়া এসেছিল তখন সবকিছু মিটিয়ে নতুন করে‌ সবকিছু শুরু করতে চেয়েছিল কিন্তু কি হলো?


নাজিয়া হাসিবের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,

- "আপনার সাথে আমার পার্সোনাল কোনো শত্রুতা নেই। শুধুমাত্র শ্রেয়া'দির ভিডিওটা ডিলিট করার জন্য আমি আপনার ক্লোজড হতে‌ বাধ্য হয়েছি। এটা সত্যি আমি বিবাহিত, আর‌ আমি আমার স্বামীকে খুব ভালোবাসি। আজকের পর আপনি আমার সাথে‌ যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না প্লিজ।"


হাসিব এইবার অধৈর্য হয়ে উঠল, 

- "হ্যাঁ আমি মানছি আমি শ্রেয়ার সাথে অন্যায় করেছি কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসি এই আমার জীবনের চরম সত্যি। প্লিজ নাজিয়া আমাকে এইভাবে ফেলে চলে যেও না।"

- "মাফ করবেন সেটা সম্ভব না। আমি আপনার জন্য আমার নিজের মানুষটাকে ঠকাতে পারব না। দোয়া করব, আপনার জীবনে সঠিক মানুষটার আগমন ঘটুক। ভালো থাকবেন।"


নাজিয়া বসা থেকে উঠে চলে যেতে যাবে তখনি হাসিবের একটা কথায় থমকে দাঁড়াল।


#চলবে 


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।



গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২৩

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২৩)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


শ্রেয়াকে এখন এইসময়ে অফিসে দেখে হাসিব নিজেও খুব অবাক হলো।


- "তুমি এইখানে?"

- "কেন? কি ভেবেছিলেন আমি আর কখনো এই অফিসে আসব না তাই তো?"


হাসিব উত্তর দিল না। শ্রেয়া আবারো বলতে শুরু করল,

- "আচ্ছা আমি আপনার কি ক্ষতি করছিলাম যার জন্য আমার স'ম্মানহানি করার কথা চিন্তা করলেন? আপনি জানেন আপনার কারনে শুধুমাত্র আপনার কারনে আমি সুই-সাইড করতে গিয়েছিলাম, নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে সম্পর্ক শেষ করেছি। এতকিছুর পরেও আপনি আমাকে ছাড়ছেন না।"


শ্রেয়াকে অবাক করে দিয়ে হাসিব বলল,

- "আই এম সরি। তোমার সাথে এইরকম করাটা আমার ঠিক হয়নি, আর এই কয়েকদিনে একটা জিনিস বুঝতে শিখেছি 'কাউকে ভালোলাগা মানেই সেটা ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা আসে মন থেকে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কখন কে মনে জায়গা করে নেয় সেটা বোঝাও যায় না।' তোমাকে আমার ভালো লাগত আর সেটাকে আমি ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছিলাম, যদি সত্যি তোমাকে আমি ভালোবাসতাম তাহলে তুমি রিজেক্ট করার পর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওই অন্যায় কাজটা করতে পারতাম না।আমি সত্যি মন থেকে অনুতপ্ত।"


শ্রেয়া অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

- "আপনি সত্যি বলছেন?"

- "হুমম। আর ওই ভিডিওটা তুমি নিজের হাতে ডিলিট করো, এই নাও।"


হাসিব নিজের ফোন আগিয়ে দিল। শ্রেয়া তো একটার পর একটা ঝটকা খেয়েই চলেছে, মানুষটার মধ্যে এত পরির্বতন! 


- "কি হলো ডিলিট করো।"

- "আমি কিভাবে আপনাকে বিশ্বাস করব! হতেও তো‌ পারে আপনি অন্য কোথাও ভিডিওটা রেখেছেন।"

- "অবিশ্বাসও তো করতে পারবে না!"

- "মানে?"

- "আমাকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো কাজ আমি কিন্তু এখন করিনি। আর এইটা সত্যি তোমার ভিডিওটা শুধুমাত্র আমার ফোনেই আছে, তাই তুমি ডিলিট করে দিলে আমার কাছে আর্ কিছুই থাকবে না। আজকের পর আমি কখনোই তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করব নাহ। আর তুমি চাইলে আগের মতো অফিসে জয়েন করতে পারো।"


শ্রেয়া ভিডিওটা সম্পূর্ণ ডিলিট করে, হাসিবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

- "যদি সত্যি নিজের মানসিকতা বদলাতে পারেন সেটা আপনার জন্যই ভালো। আর চাকরির কথা বলছিলেন! সেটার প্রয়োজন পড়বে না, আমার হবু স্বামীর যা আছে তাতে আমি বসে খেতে পারব।"

- "দোয়া করি সুখী হও।"

- "থ্যাঙ্ক ইউ। আজ তাহলে আসি, আবার কোনদিন দেখা হবে।"


শ্রেয়া যেভাবে এসেছিল সেইভাবেই চলে‌ গেল, কারোর সাথে কথা না বলে। হাসিব নিজের ফোনের সমস্ত খারাপ কিছু ডিলিট করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর মৃদু হেঁসে বলল,

- "ভালোবাসা মানুষ'কে কতই না বদলে দেয়!"


----


শ্রেয়া ও হাসিবের কথোপকথন শুনে সবাই প্রচন্ড রকমের অবাক।যে ছেলেটা দুইমাস আগেও শ্রেয়ার সাথে রুমডেট করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল, আজ সেই ছেলেটাই শ্রেয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছে! এইটা সত্যি অবিশ্বাস্য। শ্রেয়া ভয়েস রেকর্ড অন করে রেখেছিল, যাতে হাসিবের ব্যাপারে কিছু প্রমান জোগাড় করতে পারে কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়ল না। হাসিব সবকিছু ডিলিট করে দিয়েছে, এইটা সবার কাছে খুশির খবর। নাজিয়া ও আবরার দেহে প্রান ফিরে পেল, আর নাটক করতে হবে না এইবার শান্তিতে সংসার করবে। কিন্তু তার আগে শান্ত আর শ্রেয়ার সম্পর্ক'টাকে স্বাভাবিক করতে হবে।


আবরার নাজিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ঘষল। 


- "কি মিষ্টার এত খুশি কেন আজ!"

- "ঝামেলা মিটছে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে!"

- "হুমম। তবে এখনো বড়ো দুটো কাজ বাকি আছে।"

- "কি কাজ?"

- "শান্ত'দা আর শ্রেয়া'দির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো আর দ্বিতীয় হলো হাসিব স্যারের‌ সাথে এই মিথ্যা সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা।"

- "হুম।"


---


আবরার শান্তর নম্বরে ফোন করল, ছেলেটাকে আবারো বোঝাতে হবে শ্রেয়ার সাথে সবকিছু ঠিক করে নেবার জন্য। কতটা কি পারবে জানে না, তবে চেষ্টা তো করতেই হবে।


- "হ্যাঁ আবরার বল।"

- "কোথায় আছিস তুই?"

- "এই তো বাড়িতেই আছি।কেন?"

- "বলছিলাম শ্রেয়ার‌ ব্যাপারটা নিয়ে কি ভাবলি?"


শান্ত উদাসীন কন্ঠে বলল,

- "ভাবিনি কিছু।"


আবরারের মেজাজ খারাপ হলো। প্রায় ২টো মাস কেটে যাবার পরেও শান্ত এখনো শ্রেয়াকে নিয়ে সিরিয়াস হচ্ছে না, এইরকম চলতে থাকলে একটা সময় গিয়ে সম্পর্কটাই যে নষ্ট হয়ে যাবে।


- "তাহলে আর‌ কি শ্রেয়ার অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিই?"

- "তুই বিয়ে দিবি কিভাবে!"

- "শালা আমার কথার খুঁত ভালোই ধরতে পারিস, কিন্তু আসল কাজটা করতে পারিস না।"

- "ভাই কি করব বল, শ্রেয়ার সাথে কথা বলার কথা শুনলেই আমার পুরানো সবকিছু মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়, কিভাবে বিনাদোষে আমাকে ইগনোর করেছিল, আমার ভালোবাসাকে অবহেলা করেছিল।"


আবরার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল,

- "আমার মনে হয় তোদের এই মিথ্যা সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। দুজন মুখোমুখি হয়ে সম্পর্কটার ইতি টেনে দে। বেকার অপেক্ষা করে কি লাভ, শ্রেয়ার বয়স বাড়ছে বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু ওহ তোর কারনে অপেক্ষা করে আছে। তুই সম্পর্কটা ভেঙে দে, তারপর ওহ বিয়ে করে নিক সংসার করুক।"


শান্ত উত্তর দিল না, উদাসিন হয়ে বসে রইল। অভিমান জিনিসটা বড্ড খারাপ, একবার চেপে বসলে কিছুতেই ছাড়তে চায় না।


-----


নাজিয়ার ফোনে হাসিবের ফোনকল আসে রাত ১০:১৪ মিনিটে। হাসিবের নম্বর দেখেই আবরারের মেজাজ হয়ে যায়, দাঁত দাঁত চেপে আবারো সবকিছু সহ্য করতে‌হবে ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাজিয়াও বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল, 


- "হ্যালো কেমন আছো?"

- "জ্বি ভালো। এখন কল করলেন! কিছু দরকার?"

- "তেমন কিছুই না। তবে তোমার সাথে কথা বলতে‌ ইচ্ছা করছিল তাই।"

- "আসলে আমি একটু ব্যস্ত আছি এখন।"

- "এতরাতে ব্যস্ত! কি করছো?"


নাজিয়া বিরবির করে বলল,

- "বরের সাথে রোমান্স করছি দেখবি আয়।"


হাসিব কথাটা বুঝতে পারল না, তাই জিজ্ঞেস করল,

- "কি বললে?"

- "তেমন কিছু না, বাচ্চাটাকে সামলাচ্ছিলাম আর কি।"

- "কোন বাচ্চা!"

- "ওই আমার বাচ্চা, না মানে বাড়ির বাচ্চাটা।"

- "ওহ।"

- "আচ্ছা কাল তো অফ ডে, বিকালের দিকে আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?"

- "আচ্ছা কোথায় দেখা করতে হবে সেটা বলো।"


নাজিয়া ঠিকানা বলে ব্যস্ত থাকার বাহানায় কলটা কেটে দেয়। ফোনটা কাটতেই আবরার জিজ্ঞেস করল,

- "কাল দেখা করতে চাইলে কেন?"

- "আমার মনে হয় ওনাকে বলে দেওয়া উচিত আমার সত্যিটা। কোনো মানুষকে অন্ধকারে রাখার অধিকার আমাদের কিন্তু নেয়।"

- "দেখো কোনটা ভালো হয়। আর কিছুক্ষণ আগে কি বলছিলে আমি বাচ্চা! তো চলো বাচ্চামি শুরু করে দিই।"

- "এই না, প্রান আছে উঠে পড়বে।"

- "আমার বাবাই তার মা বাবাকে ডিস্টাব করবে না, এসো‌ তো।"


আবরার নাজিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।


পরেরদিন বিকাল,


একই রেস্টুরেন্ট সবাই মুখোমুখি। একটা টেবিলে শান্ত -শ্রেয়া। একটা টেবিলে নাজিয়া -হাসিব আর একটা টেবিলে আবরার ও আবির প্রানকে নিয়ে বসে আছে। বাড়িতে কেউ নেয়, তাই বাধ্য হয়েই প্রানকে নিয়ে এইভাবে বের হতে হয়েছে। 


শান্ত নিজের মন মন কফি খেয়ে চলেছে, যেন সামনে কেউ আছে সেটাই দেখতে পাচ্ছে না। শান্তর এইরকম ভাবসাব দেখে শ্রেয়ার প্রচন্ড মনখারাপ হয়, মলিন গলায় বলল,

- "আমাকে কি একটাবার মাফ করা যায় না?"


শান্ত তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,

- "অনিইচ্ছাকৃত ভুলের ক্ষমা হয় কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না।"


শ্রেয়ার প্রচন্ড অভিমান হলো, ভালোবাসার মানুষটাও ওকে ঠিকমতো বুঝতে পারল না! শ্রেয়া মনে মনে ঠিক করে নিল, আজ আর শান্তর কাছে নিজের মাথা নোয়াবে না, হতেও তো পারে ওইরকম একটা বিষয়ের পর শান্তর শ্রেয়ার সাথে সম্পর্ক রাখতে রুচিতে বাঁধছে তাই সম্পর্কটা থেকে বের হতে চাইছে।


#চলবে....


সবাই রেসপন্স করবেন গল্পে প্লিজ।

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।



গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২২

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২২)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


হাসিব উত্তরের আশায় নাজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাজিয়া নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে কিন্তু ততবারই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। 


- "কি হলো নাজিয়া উত্তরটা দাও।"


নাজিয়া কাঁপা গলায় বলল,

- "আমি রাজি।"


হাসিবের মুখে হাসির রেখা দেখা গেল, নাজিয়ার দমবন্ধ লাগছে। মিথ্যা নাটক করে হোক আর যে কারনেই হোক আবরার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের সাথে প্রেমের নাটক করতে হবে এইটা ভাবতেই একটা বাজে অনুভুতি হচ্ছে। নাজিয়ার জীবনে আবরার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের স্থান আগেও ছিল না, আর কোনোদিন হবেও না। নাজিয়া শুধু এবং শুধুমাত্র আবরারের।


হাসিব খুশি হয়ে বলল,

- "আমি জানতাম তুমি আমাকে ফেরাতে পারবে না। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ এন্ড লাভ ইউ। আমি তোমাকে রানি করে রাখব আই প্রমিস।"


নাজিয়ার গা রাগে, ঘৃনায় রি রি করে উঠল। অন্য পুরুষের কাছ থেকে এইসমস্ত শুনে নিজের উপরেই ঘৃনা হচ্ছে, ইচ্ছা করছে হাসিবকে ঠাটিয়ে দুটো চড় দিতে কিন্তু নিরুপায়। শ্রেয়াকে কথা দিয়েছে, ওর সম্মানহানী হতে দেবে না, অপরাধীকে শাস্তি দেবে। নিজের ওয়াদা রাখতে এইসব কিছু সহ্য করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।


নাজিয়া হাসিবের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বলল,

- "স্যার আমি কি এখন বাড়ি যেতে পারি?"

- "কেন?"

- "আসলে একটু শরীরটা খারাপ লাগছে।"

- "খুব খারাপ লাগছে? আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।"

- "নাহ্ স্যার তার কোনো দরকার নেই, আমি একাই যেতে পারব।"

- "ওকে বাট সাবধানে যাবে।"

- "ওকে।"


নাজিয়া নিজের ডেস্কে থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হতে হতে আবরারকে কল লাগল। ফোনটা বাজার সাথে সাথেই রিসিভ হলো।


- "হ্যালো বলো।"

- "কোথায় আছো তুমি?"

- "এই তো বাড়িতেই আছি।"

- "একটু আসতে পারবে!"


আবরারের কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তিত গলায় বলল,

- "তুমি ঠিক আছো তো?"

- "হুমম। একটু আসো প্লিজ।"


আবরার বিছানা ছেড়ে উঠে শার্ট পড়তে পড়তে বলল,

- "আচ্ছা কোথায় আসব বলো।"


নাজিয়া ঠিকানা'টা দিয়ে রাস্তার ধারে ফুটপাতে বসে পড়ল। সবকিছু বড্ড এলোমেলো লাগছে ওর কাছে, এতদিন সবটা ঠিক ছিল কিন্তু এখন! হাসিব যদি ওর ক্লোজ হতে চাই তো! তখন নাজিয়া কি করবে? সবকিছুর চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে আবরার'কে ঠকানো হচ্ছে না তো!


আবরার যতটা তাড়াতাড়ি পেরেছে নাজিয়ার দেওয়া ঠিকানায় উপস্থিত হয়েছে। প্রিয়তমা'কে রাস্তার পাশে‌ ফুটপাতে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে আবরারের চিন্তা আরো বাড়ল। এক ছুটে নাজিয়ার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,

- "এই নাজু আর ইউ ওকে!"


নাজিয়া সামনে তাকিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষ, নিজের অর্ধাঙ্গকে দেখে যেন দেহে প্রান ফিরে পেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আবরারকে, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। আবরার নাজিয়াকে নিজের বুকের সাথে আগলে সবটা স্বাভাবিক হবার সময় দিল।


ভালোবাসার মানুষের সংস্পর্শে আসলে অশান্ত মনটা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। নাজিয়ার অশান্ত মনটাও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসল, আবরার সেটা বুঝে বলল,

- "চলো।"

- "কোথায়?"

- "গেলেই দেখতে পাবে। চলো তো।"


নাজিয়ার বর্তমান অফিস ও ফ্ল্যাটের মধ্যে একটা পার্ক পড়ে। আবরার নাজিয়াকে নিয়ে সেইখানেই আসলো। পার্কের মধ্যে থাকা লেকের পাশে বসল দুজন। নাজিয়া আবরারের কাঁধে মাথা রেখে সময়টাকে উপভোগ করতে লাগল। দুজন ভালোবাসার মানুষ পাশাপাশি বসে আছে অথচ তাদের মুখে কোনো কথা নেয়, দুজন দুজনকে অনুভব করে সময়টাকে উপভোগ করতে ব্যস্ত।


এইভাবে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। আবরার নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল, নাজিয়া উদাসীন মনে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে নামমাত্র তাকিয়ে আছে, মাথায় অন্য কিছু ঘোরাঘুরি করছে।


- "নাজু।"


অনেকদিন পর আবরার নাজিয়াকে নাজু বলে ডাকল। একদিন নাজিয়া নিজেই এই ডাকে ডাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল কিন্তু আজ আর কোনো অধিকার আলাদা করে দিতে হয়নি। যেখানে পুরো মানুষটাই তার নিজস্ব সেখানে ডাকনাম বলাতে অধিকার দেওয়া লাগে কি!


- "হু বলো।"

- "কি হয়েছে? মনখারাপ কেন! হাসিব কি কিছু বলেছে?"

- "নাহ্। তবে আমার বড্ড ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হচ্ছে না কারোর মন নিয়ে খেলার অধিকার আমার নেই।"

- "মনখারাপ করো না। জানি আমাদের পথটা সঠিক না, কিন্তু এটা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। তোমাকে নিয়ে আমার কত চিন্তা হয়, অফিসে ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। ওই লোকটার সাথে তোমাকে রাখতে আমারও যে বড্ড ভয় করে।"


নাজিয়া আবরারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর মলিন গলায় বলল,

- "ভয় লাগে যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি তো!"


আবরার নাজিয়ার হাতকে নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,

- "কিছু হবে না। মৃত্যু ব্যতিত আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।"


নাজিয়া ঘাড় নাড়ল। মুখে আশ্বাস দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু ভয় দুজনের মনেই আছে। 


----


১সপ্তাহ কেটে যায়।

হাসিব আর নাজিয়ার সম্পর্ক আগের থেকে স্বাভাবিক। হাসিব নাজিয়াকে ফোন করে খোঁজখবর নেয়, গল্প করে। এইসব দেখে আবরার সামনে চুপচাপ থাকলেও মনে মনে ফুলছে। আর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক নিজের বউয়ের সাথে অন্যের প্রেমালাপ কার ভালো লাগে ভাই!


নাজিয়া আবরারকে একটু রাগিয়ে দেবার জন্য ফোনটা স্পিকারে দিয়ে বলল,

- "কি করছেন আপনি?"

- "এই তো বসে‌ বসে তোমার কথা ভাবছি।"

- "পাম দেবার আর জায়গা পাননি! বেকার কেন মিথ্যা বলছেন?"

- "আরে না গো সত্যি বলছি।"

- "আচ্ছা বিশ্বাস করলাম। তবে একটা কথা জানার ছিল।"

- "কি বলো।"

- "আমাকে কবে থেকে পছন্দ করেন?"

- "প্রথমদিন থেকে। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেইদিন থেকে তোমাকে আমার ভালো লাগে।"


আবরার আর সহ্য করতে না পেরে নাজিয়াকে দাঁড়ানো থেকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দেয়। আচমকা এইরকম হওয়াতে নাজিয়া আহ্ বলে চেঁচিয়ে উঠে।


হাসিব জিজ্ঞেস করল

- "কি হলো নাজিয়া? তুমি ঠিক আছো তো!"

- "হ্যাঁ। আপনি বলুন।"


হাসিব গল্প করতে শুরু করল, নাজিয়া একটা কথে উত্তর দিচ্ছে। আর ওইদিকে আবরারের দুষ্টুমির মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে। নাজিয়ার পেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে সাইড করতে লাগল, নাজিয়া ছাড়ার জন্য খোঁচা দিয়ে চলেছে কিন্তু আবরার তো ছাড়ার পাত্র না। নাজিয়ার পিঠ থেকে চুলগুলো সরিয়ে পিঠে ঠোঁটের পরশে দিতে লাগল। নাজিয়া পরেছে ফ্যাসাদে, না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে।


আবরারের দুষ্টুমির‌ সাথে না পেরে বলল,

- "হাসিব আমি আপনার সাথে পড়ে কথা বলব কেমন।"

- "এনি প্রবলেম?"


নাজিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

- "একটা বাচ্চা অনেকক্ষন ধরে জ্বালাচ্ছে, তাকে একটু সামলাতে হবে।"

- "বাচ্চা! বাচ্চা কোথা থেকে আসলো?"

- "আমাদের বাড়ির বাচ্চা। আচ্ছা তাহলে রাখছি বাই।"


নাজিয়া ফোনটা কেটে দিয়ে স্বস্তির‌ নিঃশ্বাস নিল। আবরার নাজিয়াকে বিছানায় ফেলে মুখে ভালোবাসার পরশ দিতে লাগল।


- "এইগুলো কি হচ্ছে?"

- "আদর হচ্ছে, তুমি বুঝবে না।"

- 'তাই!!"

- "হুমম। এখন চুপ করে থাকে, আমাকে আদর করতে দাও।"


দুজন ভালোবাসার আদর-চাদরে ভেসে গেল।


-----


পরেরদিন সকালটা স্বাভাবিক ভাবে হলেও অফিসের জার্নিটা স্বাভাবিক হলো না নাজিয়ার জন্য। আজ ওহ একা নয় শ্রেয়াও অফিসে যাবে। তাই আবরার আজ বের হতে পারবে না, প্রানকে সামলাবে।


প্রান প্রথম প্রথম কান্নাকাটি করলেও এখন গুড বয় হয়ে গেছে, আগের মতো বেশি আর কান্নাকাটি করে না একটু খাইয়ে দিলে চুপচাপ নিজের মতো খেলতে থাকে। তবে যখন ঝোঁক ধরে থামাতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হয়, তখন নাজিয়া ছাড়া কেউ সামলাতে পারে না।


নাজিয়া আর শ্রেয়া একসাথে বাড়ি থেকে বের হলেও অফিসে কিন্তু একসাথে ঢুকল না। নাজিয়া ঢোকার ঠিক ৩০মিনিট পর শ্রেয়া অফিসে ঢুকল। এতগুলো দিন পর শ্রেয়াকে দেখে সবাই খুব অবাক হলো। শ্রেয়া কাউকে কিছু না বলে সোজা হাসিবের কেবিনের দিকে পা বাড়াল। নাজিয়ার প্রচন্ড টেনশান হচ্ছে, এরপর কি হবে!


#চলবে.....


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।


📌আমার প্রতিলিপি পেজ "তানজিলা খাতুন তানু" অনুসরণ করে পাশে থাকুন 🧡

গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২১

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২১)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


- "মেয়েটার নাম ছিল শ্রেয়া। জানো খুব ভালো ছিল,কি সুন্দর ব্যবহার কিন্তু হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে।"


শম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাজিয়া বলল,

- "যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনি?"

- "করেছিলাম কিন্তু পায়নি।"

- "ওহ্।" 


তারপর শম্পা আর নাজিয়া দুজনেই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাজিয়ার একটা সাইনের দরকার ছিল, তাই হাসিবের কেবিনে টোকা মারল।


- "মে আই কাম ইন স্যার।"

- "হ্যাঁ নাজিয়া এসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।"

- "আমার জন্য! কিন্তু কেন?"

- "অফিস শেষে আমার সাথে একটু বের হতে পারবে?"

- "কেন স্যার?"

- "একচুয়ালী আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।"


নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল,

- "ওকে স্যার।"

- "তাহলে সবাই অফিস থেকে চলে যাবার পর তুমি আর আমি বের হবো একসাথে।"

- "আচ্ছা।"


অফিস শেষে সবাই বেরিয়ে যায়। নাজিয়া কাজ আছে এই বাহানায় অফিসে হাসিবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, হাসিব কেবিন থেকে বেরিয়ে নাজিয়ার ডেস্কের কাছে এসে বলল,

- "চলো তাহলে।"

- "চলুন।"


--


গাড়িটা একটা বিলাসবহুল ফাইভস্টার হোটেলের সামনে থামল। হাসিব নাজিয়াকে নিয়ে ভেতরে গেল, নাজিয়া চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে সেটা দেখে হাসিব বলল,

- "জায়গাটা পছন্দ হয়েছে?"

- "হুমম খুব সুন্দর জায়গা।"

- "আচ্ছা বলো কি খাবে।"

- "আপনি যা খাবেন তাই খাবো।"


হাসিব মৃদু কন্ঠে বলল,

- "তাহলে একটা ছোটখাটো হয়ে যাক!"


ওর কথার অর্থ নাজিয়া বুঝল না, তাই ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,

- "মানে?"

- "আরে মজা করে বললাম। খাবে নাকি মদ!"

- "ছিঃ এইসব আবার মানুষ খায় নাকি!"


হাসিব অভিজ্ঞ মানুষদের মতো করে বলল,

- "তাহলে কি আমি মানুষ না!"

- "না সেটা কেন হতে যাবেন? আমি তো বলেছি যারা মদ খায় তারা মানুষ না। এইসব আমার একদম পছন্দ না।"

- "আচ্ছা তাহলে আজ থেকে সব বাদ।"

- "কি!!"

- "আজ থেকে আমি আর কোনোরকমের নেশা করব না, প্রমিস।"


নাজিয়া চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল‌ হাসিবের দিকে, ওহ কি ভুল কিছু শুনছে!


- "আপনি আমার কথা শুনবেন কেন?"

- "বিকজ আই লাভ ইউ।"


নাজিয়ার বিস্ময়ে মুখটা হাঁ হয়ে গেল। 


- "স্যার আপনি এইসব কি বলছেন?"

- "স্যার না শুধু হাসিব, তোমার হাসিব।আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে দেখার পর থেকে আমি আর কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছি না, নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে।"

- "স্যার আপনি এইসব কি বলছেন? আপনি অফিসের বস আর আমি সাধারন একজন কর্মচারী।"

- "ভালোবাসা কি স্ট্যাটাস দেখে হয়?"


নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,

- "আমি ভেবে আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাব, আজ আসি।"


হাসিবকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নাজিয়া তড়িৎ বেগে উঠে চলে গেল। হাসিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

- "নাজিয়া আমাকে এক্সসেপ্ট করবে তো!"


---


নাজিয়া আড়ালে এসে প্রানভরে শ্বাস নিল। এতক্ষন মনে হচ্ছিল বাঘের ডেরায় বসে আছে, আর ক্ষুধার্ত বাঘকে বলছে আমাকে‌‌ খাবি! নাজিয়া হাসিবের কথাগুলো বিরবির করছিল আর মুখ ভেংচি কাটছিল তখনি পেছন থেকে ওকে কেউ জড়িয়ে ধরে, আচমকা এইরকম হওয়াতে প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে চেঁচাতে যাচ্ছিল। আবরার নাজিয়ার মুখটা চেপে ধরে বলল,

- "আরে বউ আমি, আমাকে কি গনপিটুনি খাওয়াতে চাও নাকি!"


নাজিয়া কনুই দিয়ে আবরারের পেটে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,

- "এইভাবে কেউ আচমকা ধরে! আমার তো এখুনি হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেত।"

- "কিছু হতো নাহ, আমি আছি তো।"


নাজিয়া আবরারকে জড়িয়ে ধরল। আবরার নিজের স্ত্রীর চুলে ঠোঁট ছোঁয়ালো, আজ ৮দিন পর দুজনের দেখা হলো তাই একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছে দুজন।


- "এই ছাড়ো এইটা পাবলিক প্লেস।"

- "ছাড়তে ইচ্ছা করছে না তো।"

- "চলো বাড়ি চলো।"

- "হুমম চলো।"


নাজিয়া ও আবরার ফ্ল্যাটে আসে। গত একমাস ধরে ওরা এই ফ্ল্যাটেই আছে, ফ্ল্যাটটা শান্তর। দরজায় কলিং বেল বাজাতেই শ্রেয়া দরজা খুলে দিল।


নাজিয়া ভেতরে যেতে যেতে বলল,

- "প্রান কি করছে?"

- "এইমাত্র ঘুমাল। বাবা তোমার ছেলেকে সামলাতে আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।"


নাজিয়া মৃদু হাসল। শ্রেয়া ওকে আর আবরারকে পানি এগিয়ে দিল।


- "আবরার তুমি কখন আসলে?"

- "বউকে ছেড়ে আর কতদিন থাকব তাই চলে এসেছি।"


শ্রেয়া মলিন কন্ঠে বলল,

- "আমার কারনে তোমাদের কত কি সহ্য করতে হচ্ছে। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী তাইনা।"


আবরার শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

- "ধূর পাগলি তোর জন্য আমাদের কিছুই সহ্য করতে হচ্ছে না। আর বোনের জন্য এইটুকু করতে না পারলে আমরা কিসের দাদা!"

- "নাজিয়া ওই লোকটার আশেপাশে থাকছে আমার খুড ভয় লাগছে, ওহ যদি নাজিয়ার কিছু ক্ষতি করে দেয় তো!"


আবরার মলিন হাসল, চিন্তা তো ওরও হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেয় হাসিবকে মাত দিতে হলে এইভাবেই দিতে হবে।


নাজিয়া শ্রেয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

- "চিন্তা করো না আমার কিছু হবে না। তুমি বরং শান্ত'দার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করো, ছেলেটা কিন্তু এখনো তোমার উপরে অভিমান করে আছে।"

- "কি রাগ ভাঙাব, আমার সাথে তো‌ ঠিকমতো কথাই বলে না।"

- "রাগ অভিমান বেশি বাড়তে দিস না, সম্পর্কটা দূর্বল হয়ে পড়বে।"


শ্রেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

- "চেষ্টা তো করছি কিন্তু শান্ত তো আমার সাথে কথাই বলছে না, কিভাবে কি করব!"

- "চেষ্টা করতে থাক, ঠিক হয়ে যাবে।"


---


নাজিয়া ফ্রেশ হয়ে প্রানকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। এই সবকিছুর মাঝে ছোট প্রানকে সময় দিতে পারছে না, সারাদিন শ্রেয়ার কাছেই প্রান থাকে। 


১মাস আগে বাড়ির সবাইকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে নাজিয়া এইখানে আসে। আবিরের মা কিছুতেই রাজি ছিলেন না, বাধ্য হয়ে নাজিয়া ওনাকে সবটা বলেন। উনি নাজিয়াকে এত বড়ো রিস্ক নিতে বারবার বারন করেন, কিন্তু সবকিছু ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল ফেরার কোনো পথ নেয়। নাজিয়া ও শ্রেয়া শান্তর ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে, নাজিয়া শান্তকে শর্ত দেয় ওহ যতদিন এই ফ্ল্যাটে থাকবে ততদিন শান্ত এইখানে আসতে পারবে না। শান্ত অবাক হয় এইরকম কথা শুনে, তারপর ভাবে হয়তো নাজিয়া ভয় পাচ্ছে তাই আর কথা বাড়ায় না রাজি হয়ে যায়। 


আবরার প্রতি সপ্তাহে নাজিয়ার কাছে আসে, আবিরও মাঝেমধ্যে দেখা করে যায়। আর নাজিয়ার পেছনে একজন গার্ড সবসময়ে থাকে, সে সবকিছু আপডেট শান্তকে জানায়।প্ল্যানমতোই সবকিছু আগিয়ে চলেছে, দেখা যাক সামনে কি হয়।


আবরার ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল নাজিয়া প্রানকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। কি সুন্দর একটা মুহূর্ত, মা ছেলের ভালোবাসার দৃশ্য। আবরার দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্ধি করে নেয়।


- "এই কি করছো তুমি?"

- "মা ছেলের সুন্দর মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্ধি করে নিলাম।"

- "দেখি দাও।"


আবরার নিজের ফোনটা নাজিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল, নাজিয়া ছবিটাকে ভালো করে দেখতে লাগল।


- "কি সুন্দর হয়েছে, আমাকে পাঠিয়ে দাও তো ফোনের ওয়ালপেপার করব।"


আবরার মজা করে বলল,

- "আমার সবকিছুতেই প্রান ভাগ বসিয়ে দিচ্ছে।"


নাজিয়া চোখ পাকিয়ে বলল,

- "ওইটুকু একটা বাচ্চার সাথে হিংসুটেপনা করতে লজ্জা লাগে না!"

- "ছেলেকে হিংসা করব, এতটাও খারাপ বাবা আমি না।"


নাজিয়া হঠাৎ করেই আনমনা হয়ে গেল, নিসা থাকলে সবকিছু অন্যরকম হতো। হয়তোবা নাজিয়া আর আবরার এক হতো না, প্রান ওর‌ নিজের বাবা মায়ের কাছেই থাকত।


- "এই কি ভাবছ?"

- "দিদি থাকলে সবকিছু অন্যরকম হতো তাই না!"


আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

- "হয়তো। তবে মনখারাপ করো না, যেটা হয় আমাদের ভালোর জন্যই হয়।"

- "হুমম।"


আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,

- "এখন চুপ, আমি ঘুমাব বড্ড টার্য়াড।"


নাজিয়া মৃদু হেসে আবরারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।


***

আজকে অফিসে নাজিয়া একটু ভয়ে ভয়েই এসেছে। হাসিবের মুখোমুখি হতে হবে, এবং উত্তরটা দিতে হবে। নাজিয়া তো ওর উত্তর বলবে, কিন্তু তারপর কি হবে?


ভয়টাকে সত্যি করে পিওন জানাল হাসিব নাজিয়াকে ডাকছে। নাজিয়া নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে হাসিবের কেবিনে গেল।


- "কেমন আছো?"

- "আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি?"

- "আলহামদুলিল্লাহ। তা কালকের উত্তরটার কথা কিছু ভাবলে?"

- "আসলে স্যার....


#চলবে...


আপনাদের কি মনে হয় নাজিয়া কি উত্তর দেবে?

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

আসসালামু আলাইকুম।


গল্প এক_আকাশ_দূরত্ব পর্ব ২০

 #এক_আকাশ_দূরত্ব (২০)

#তানজিলা_খাতুন_তানু 


"এখন শ্রেয়া যদি নিজের মুখে সবটা বলে আর তোকে বিয়ে করতে চায় তো?"


শান্ত কোনো উত্তর দিল না দেখে আবরার বুঝল অভিমানের পাল্লাটা অনেকটাই ভারি হয়ে গেছে। যেটা ভাঙতে শ্রেয়াকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে।


- "অভিমান করেছিস ভালো কথা, তবে দেখিস অভিমানের পাল্লাটা এতটাও ভারি করে ফেলিস না যাতে ভালোবাসার মানুষটি হারিয়ে যায়।"


শান্ত তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,

- "যে যাবার সে তো যাবেই, জোর করে কি কাউকে আগলে রাখা যায়! আর যে থাকার সে ঠিকই থাকবে।"

- "উঁহু ভুল বললি, কখনো-সখনো পরিস্থিতির শিকার হয়ে মানুষ অনেক বড়ো‌ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। পরিস্থিতির কাছে হার মেনে ভালোবাসার মানুষটিকে ছেড়ে দেয়, দোষ না করেও দোষী হতে হয় সমাজ এবং ভালোবাসার মানুষটির কাছে। তাই বলব, যেটা করবি ঠান্ডা মাথাতে ভেবে করবি। ভুল করা খুব সহজ কিন্তু ভুলটা শুধরে নেওয়া খুব কঠিন।"


---


২দিন‌ পর,

আজ‌ আবারো সবাই একত্রিত হয়েছে। আবির আবরার শান্তর জন্য অপেক্ষা করছে। শান্ত কিছু কথা বলার জন্য আবিরকে ডেকে পাঠিয়েছে, সাথে আবরারকেও বলেছে‌ আসার জন্য। নাজিয়া ইচ্ছাকৃতভাবেই আসেনি, হয়তো নাজিয়া থাকলে শান্ত কথা বলতে দ্বিধা করতে পারে তাই ওরা একা যাওয়াটাই শ্রেয়।


- "সরি ফর লেট।"


শান্ত তড়িঘড়ি চেয়ারে বসতে বসতে বলল। আবির, আবরার দুজন ওর দিকে তাকাল শান্ত ঘামছে, দেখে মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে এসেছে।


- "পানি খা একটু।"

- "হু।"


শান্ত পানিটা খেয়ে কিছুটা দম নিল। তারপর আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,

- "ভাবি আসেনি?"

- "নাহ্। কেন?"

- "ভাবিকে আমার একটা হেল্প করতে হবে।"

- "কি হেল্প?"


শান্ত আবির আবরারকে সবটা বুঝিয়ে বলল। আবির সবটা শুনে চিন্তিত গলায় বলল,

- "বিষয়টা একটু বেশি রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না?"

- "একটু তো রিস্ক আছেই, দ্যাখ আবরার আমি আমার প্ল্যান বলেছি এখন সিদ্ধান্ত তোর আর ভাবির।"


আবরার আবিরের দিকে তাকাল, আবির চোখের ইশারায় বোঝাল শান্ত মাথায় চিন্তা করার জন্য।


শান্ত আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,

- "চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিস।"


আবরার কিছু না বলে নাজিয়ার নম্বরে কল লাগাল।


- "হ্যালো।"

- "হ্যাঁ বলো।"

- "কোথায় আছো তুমি?"

- "এই তো প্রানকে নিয়ে ঘরেই আছি।"

- "আশেপাশে কেউ আছে?"

- "নাহ্ বলো।"


আবরার নাজিয়াকে কিছু একটা বলল, নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,

- "আমি রাজি, আমার কোনো আপত্তি নেই।"

- "ওকে।"


আবরার কলটা কেটে শান্ত'র দিকে তাকিয়ে বলল,

- "নাজিয়া রাজি। তুই প্ল্যান সাজা...


***


একটা বড়ো অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাজিয়া। এই অফিসে জবের জন্য এসেছে। রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

- "ইন্টারভিউ'টা কোথায় হচ্ছে?"

- "সামনে গিয়ে ডানদিকে।"


নাজিয়া ধীর পায়ে এগিয়ে গেল, বড্ড টেনশন হচ্ছে যেভাবেই হোক চাকরিটা ওকে পেতেই হবে।অনেকেই জবের জন্য এসেছে, নাজিয়া একপলক সবার দিকে তাকাল। এত জনের মধ্যে চাকরিটা কি আদৌও পাবে!


একে একে নাজিয়ার পালা আসল। নাজিয়া নিজের চোখের চশমাটা পেছনের দিকে ঠেলে কেবিনের দরজায় নক করল,

- "মে আই কাম ইন স্যার।"

- "ইয়েস...


নাজিয়া দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল, ভেতরে তিনজন ছেলে বসে আছে। সবাই নাজিয়ার দিকে নজর দিল, পরনে সাধারন থ্রি-পিস, চোখে চশমা সব মিলিয়ে সাধারন একটা মেয়ে।


নাজিয়া নিজের ডকুমেন্টস জমা দিল, ওর নম্বর ভালোই ছিল। তিনজনের মধ্যে একজন বলল,

- "আপনার নম্বর তো ভালোই কিন্তু আপনার মাঝে অনেককিছুর কমতি আছে। আপনি নিশ্চয় জানেন স্মার্টনেস একটা জবের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।"

- "জ্বি স্যার। স্যার চাকরিটা আমার খুব দরকার, প্লিজ আপনারা একটু দেখুন। আর আমাকে একটু সময় দিলে আমি সবকিছু শিখে নেব।"


তিনজন নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করলেন। তারপর একজন বললেন,

- "আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন, আমরা জানাচ্ছি আপনাকে।"


নাজিয়া ঘাড় নাড়িয়ে বাইরে চলে গেল। তিনজন লোক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল,


- "মেয়েটার রেজাল্ট ভালোই আছে, রাখা যেতে পারে।"

- "কিন্তু মেয়েটা স্মার্ট না, আর আগে চাকরির কোনো অভিজ্ঞতা নেয়। এইরকম মেয়েকে কি নেওয়া ঠিক হবে? হাসিব তুই কি বলিস?"

- "আমার কাছে তো মেয়েটাকে ভালোই লেগেছে।না মানে বলছিলাম, তিনমাসের জন্য মেয়েটাকে রেখে দাও। তিনমাস পর পারফরমেন্স দেখে চাকরি ফাইনাল করবে।"

- "এটা খারাপ বলিস নি।তবে সেটাই হোক।"


নাজিয়াকে ডেকে সবটা জানিয়ে দেওয়া হয়।


- "তিনমাস মন দিয়ে কাজ করো, এই তিন মাসের কাজের উপরেই তোমার চাকরি নির্ভর করছে।"

- "থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।"


তিনজন স্যার নাজিয়ার সাথে হ্যান্ডশেক করে চলে গেল। তারা নাজিয়া'কে জানায় কাল থেকেই ওর জয়েনিং। 


------


পরেরদিন, সঠিক সময়ে নাজিয়া অফিসে উপস্থিত হয়। একজন মেয়ের সাথে ওর ভালোই পরিচয় হয়, মেয়েটার নাম শম্পা অনেকদিন যাবত এই অফিসেই কাজ করছে।


- "আচ্ছা এই অফিসের এমডি কে?"

- "এমডি তো হাসিব স্যার।"

- "ওহ।"


আরো কিছু টুকটাক কথা আলোচনা হতে থাকল, নাজিয়া অফিসের মোটামুটি সবার সম্পর্কে জানতে পেরেছে শম্পার কাছ থেকে। হাসিব স্যার কেবিনে আসার কিছুক্ষণ পর, একজন মোটামতো লোক দেখে মনে হচ্ছে পিওন টাইপের কিছু একটা কাজ করে। সে এসে বলল,

- "নাজিয়া'কে স্যার নিজের কেবিনে যেতে বলল।"


শম্পা নাজিয়াকে বলল,

- "যাও স্যার ডাকছে।"

- "হুম।"


নাজিয়া নিজের চশমাটা ঠিক করে পড়ে কেবিনের দরজায় টোকা মারল। হাসিব অফিসের মেইল চেক করছিল, দরজায় টোকা মারার শব্দে ভেতরে আসতে বলল।


- "স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?"


হাসিব নাজিয়াকে একনজর পুরো পর্যবেক্ষন করে বলল,

- "হ্যাঁ, বসো।"


নাজিয়া হাসিবের সামনে‌ বসতেই হাসিব মিষ্টি হেসে বলল,

- "আজকে তো প্রথমদিন তো কেমন লাগছে?"

- "খুব ভালো স্যার। আমি তো কাজ নিয়ে খুব এক্সসাইটেড।"

- "আই হোপ তুমি পারবে।"

- "নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব স্যার।"

- "ইয়েস, এই স্পিডটাই তো দেখতে চায়।"


কিছুক্ষন কথা বলার পর হাসিব ম্যানেজারকে ডেকে বলল,

- "নাজিয়াকে নিজের কাজগুলো বুঝিয়ে দাও। আর নাজিয়া বেস্ট অফ লাক।"

- "থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।"


-----


সময় পানির মতো এগিয়ে চলেছে, আজ নাজিয়ার অফিসে জয়েনিং এর ১মাস পূর্ণ হলো। নাজিয়া পুরোদমে নিজের বেস্টটা দেবার চেষ্টা করে চলেছে, আর কিছুটা সফলও হয়েছে। হাসিবের সাথেও একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সবকিছু মিলিয়ে নাজিয়ার জীবন ভালোই কাটছে। 


নাজিয়া রোজকার মতো অফিসে গিয়ে নিজের ডেস্কে আসতেই শম্পা বলল,

- "কি নাজিয়া কি খবর।"

- "এই তো সবকিছু আলহামদুলিল্লাহ, তোমার।"

- "আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। স্যারের সাথে দেখলাম ভালোই ভাব হয়েছে।"


নাজিয়া কিছুটা লজ্জা পাবার ভান করে বলল,

- "ওই আর কি।"

- "থাক আর লজ্জা পেতে হবে না।‌ লেগে থাকো, হয়ে যেতেও পারে।"

- "আরে দূর তুমি কি বলো না।"


শম্পা হেসে দিয়ে বলল,

- "বুঝি বুঝি সব বুঝি গো।"


নাজিয়া কথার টপিক অন্যদিকে নিয়ে যাবার জন্য বলল,

- "শম্পা'দি হাসিব স্যারের পার্সোনাল পি.এ নেয় কেন?"


শম্পার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিছুটা মনখারাপ করে বলে,

- "তুমি জয়েন করার ১মাস আগে পর্যন্ত একজন মেয়ে ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই মেয়েটা চাকরি ছেড়ে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।

- "নাম কি মেয়েটার?"

- "শ্রেয়া।"


#চলবে...


ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।