গল্প শিশির_কণা পর্ব ১৬ সমাপ্ত

 #শিশির_কণা

শামসুল ইসলাম

(শেষ পর্বঃ)

- তিন কেজি পুঁটিমাছ!

- আমি শেষ!

এদিকে শিশিরের চিঠি দেখে আমার রাগে শরির জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে!

এত কাজকাম করবো কিভাবে একাএকা!

হঠাৎ দেখি শিশির ফোন করেছেন-

-" আসসালামু আলাইকুম।"

-" ওয়ালাইকুমুসসালাম, আমি জানি!  তুমি বাসায় চলে এসেছো।"

-" জ্বি, তো বাসার এহাল করেছেন কেন? আমি এত কাজ কিভাবে করবো!"

-" তোমার কাজ তুমি করো?"

-" কি! তা ছাড়া কে করকে?"

-"তুমি না পারলে বলো, আরেকটি বিয়ে করে আনছি।"

-" বিয়ে!! খুন করে ফেলবো! আর একবার উচ্চারণ করলে এইকথা।"

-" হাহাহা তাহলে বললে যে এত কাজকাম পারছো না?"

-" সব পারবো ইনশাআল্লাহ্‌।"

-" এইযে এবার লাইনে আসছে! বউ ?"

-" জ্বি বলুন!

-" খেয়ে আসছো?"

-" তোমাকে ছাড়া খাই?

-" না! তুমি একটু অপেক্ষা করো অতিদ্রুত চলে আসছি, একসাথে খাবো ইনশাআল্লাহ্‌।"

-" কোথায় আপনি এখন?"

-" বাজার করতে আসছি।"

-" বাজার তো বাসায় সব আছে?"

-" বাসায় এসে বলবো, এক জায়গাতে যেতে হবে আজ। "

-" কোথায়?"

-" বললাম তো এসে সব বলবো, তুমি ভাত মাখাতে থাকো এসে খাবো ইনশাআল্লাহ্‌।"

-" হিহিহি, আসুন আসুন ক্ষুধায় পেট চোঁচোঁ করছে।"


আমি  রুমের ভিতরে সবকিছু গোছগাছ করতে থাকলাম, কিছুক্ষণ পর শিশির বাসায় পৌঁছালেন।

অনেক বাজার সদাই করে নিয়ে হাজির, আমি অবাক হচ্ছি এতো বাজার!

-" এত বাজার সদাই কিজন্য? "

-" বললাম না আমার আবার বিয়ে?"

-" কি! বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু!"

-" হাহাহা এটা আমার শাশুড়িদের জন্য। "


আমি অবাক হচ্ছি এতো বাজার তাহলে আম্মুর জন্য!

-" এত টাকা খরচ করতে গেলেন কেন? এমনিতেই যাওয়ার সময় কিছু কিনে নিয়ে গেলেই তো হয়?"

-" এটাও সদকা, দান হিসাবে গৃহীত হবে।

হযরত আবু হুরাইরা (রা) কর্তৃক বর্ণিত,

“সর্বোত্তম দান হলো সুস্থ সবল অবস্থায় প্রচণ্ড মায়া ও ধনী হওয়ার উদগ্র বাসনা নিয়ে দরিদ্রের আশংকা খাকা সত্বেও দান করা”

আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন-

“ তোমরা যতোক্ষন পর্যন্ত তোমাদের প্রিয় সম্পদ হতে দান-খইরাত না করবে, ততক্ষণ কিছুতেই পুণ্য লাভ করবে না”


অন্যস্থানে বলেছেন-

“আর তাঁরা নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অপরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়।”


-" বুঝলাম!  আপনি দান করবেন! কিন্তু সেটা গরিব অসহায় এতিম মিসকিন ও মাদ্রাসায় দিন?"

-" দান প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার রয়েছে।


যেমন হাদিসের ভাস্যে……

“ গরীব মিসকিনকে দান করলে এক দানের সওয়াব মিলে আর আত্মীয়স্বজনকে দান করলে দুই দানের সওয়াব পাওয়া যায়। এক সওয়াব দানের জন্য আরেক সওয়াব আত্মীয়তা রক্ষার জন্য। তাঁরা হলো তোমার জন্য, তোমার নেকীর জন্য ও তোমার দানের জন্য সকল মানুষের চেয়ে উত্তম ব্যক্তি।”

( ইবনে কাসির ইফাঃ ২য় খন্ড)


-" সব বুঝলাম! বাসায় কেউ নেই তো কিভাবে জাবো আমরা?"

-" আম্মু আজ চলে আসবেন, কেন তোমার সাথে কথা হয়নি?"

-" গতকাল হয়েছিল, আজ হয়নি।"

-" শাকিল আর আম্মু চলে আসছেন আজ, নাগাত বিকালে আমরা ইনশাআল্লাহ্‌ যশোরে রওনা করবো।"

-" জ্বি ইনশাআল্লাহ্‌, চলুন খেয়ে নিই।"


শিশিরের সাথে খেতে বসলাম, তিনি বললেন-

-" এদিকে তাকাও?"

তাকালাম!

-" একরাতে চেহারার কি হাল করেছো?"

-" ইচ্ছা করে করিনি! আপনার জন্য হয়েছে এসব।"

শিশির চেয়ারটা কাছে এনে এক লোকমা ভাত মুখে তুলে  বললেন-" আর এমন কষ্ট দিবনা ইনশাআল্লাহ্‌, তোমার সাথে মজা করতে যেয়ে আমিও সারারাত কষ্ট পেয়েছি।"

শিশিরের আমার প্রতি অন্ধ ভালোবাসা দেখে আমার চোখে পানি চলে এলো, গত জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটা কথা মনে পড়তে লাগলো।

মণির কথায় আজ প্রমান হলো, মণি বলেছিলো-

-"আল্লাহপাক বলেছেন- 

“ নিশ্চয় কষ্টের পরে স্বস্তি আসে”

আজ আমি সেটা উপলদ্ধি করি, নিজের কাছে মনে করি পৃথিবীর সবথেকে শ্রেষ্ঠ সুখি মানবী আমি!


আমার চোখে পানি দেখে শিশির বললেন-

-" কি হলো প্রেয়সী!  কাঁদছো কেন?"

-" নাহ্! এমনি, এতো ভালোবাসেন কেন আমায়?"

-" হাহাহা পাগলি মেয়ের কথা শুনো! আমার দুইটা না পাঁচটা নাই একটামাত্র বউ!  তাকে ছাড়া কাকে ভালোবাসবো?"


আমি শিশিরের দুহাত ধরে বললাম-

-" আমাকে ক্ষমা করে দিন! আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।"

-" দেখদেখ পাগলি মেয়ে বলে কি! কষ্ট তুমি ইচ্ছা করে দাওনি বরং আমি নিজে সেধে নিয়েছি। তোমাকে না ফিরিয়ে কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পেয়েছি।"

আমি চোখমুখ মুছে বললাম-

-" আপনাকে ছাড়া আমার ঘুমও হয়নি।"

শিশির হাত বাড়িয়ে ভাতের লোকমা আমার মুখে গুঁজে দিয়ে বললেন-

-" তোমার যদি আমার বিরহে ঘুম না হয়, তাহলে তোমার বিরহে এ দোকানদারের কেমনে ঘুম হবে?"

-" হিহিহি, জানি আমি আপনিও ঘুমাননি।"

-" খুব ভালো, তো রাতে একটা ফোন দাওনি কেন?"

-" বাহারে!! বউ রাগ করে চলে গেছে সেটা বর মান ভাঙ্গাবে, তা না বর উল্টো দাবি করে বসে আছে। ইশ! সখ কতো!!!"


-" কণা তুমি কি জানো!  সর্বোত্তম স্বামী ও স্ত্রী কে?"

-" নাহ্!  জানিনা।"

-" সর্বোত্তম স্বামী সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রী কাছে সর্বোত্তম।"

আমি শিশিরের নাকে মৃদু নাড়া দিয়ে বললাম-

-" আপনি আমার কাছে সর্বোত্তম, নিঃসন্দেহ আমার বর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী।

আচ্ছা জানু! আমি কেমন স্ত্রী আপনার? "

শিশিরও আমার নাকে মৃদু টান দিয়ে বললেন-

-" পৃথিবীর সব থেকে উত্তম স্ত্রীর ভিতরে আমার তারছেড়া প্রেয়সী একজন।"

হিহিহি করে হাসলাম, তারছেড়া শব্দটি শিশিরের মুখের আমার কাছে অমিয় সুধার মতো লাগে।

এভাবে দুষ্টু মিষ্টি গল্পের মাঝে খাওয়া পরিসমাপ্তি করলাম দুজনে।

শিশির আমার সমস্তরকম কাজে সাহায্য করলেন। বারংবার মানা করেছি যে, আমি করছি! আপনি ঘুমান। কিন্তু কে শুনে কার কথা! তিনি বললেন স্ত্রীকে কাজে সাহায্য করাটাও নেকীর কাজ, তাহলে কেন অকারণে নেকীগুলো হাতছাড়া করবো?


আমরা দুজনে কাজকাম পরিসমাপ্তি করে, দুপুরের রান্নার জন্য প্রস্তুতি নিলাম।

আম্মুরা বাসায় চলে আসেন, আমি রান্নাবাড়া পরিসমাপ্তি করে খাওয়াদাওয়া শেরে যশোরের উদ্দেশ্যে শিশিরের সাথে রওনা করলাম।


★★★

বিয়ে হয়েছে আমাদের ১৫ বছর, আমি তিন সন্তানের জননী। দুই ছেলে এক মেয়ে।

বড়ো ছেলে আবু হানিফ  বয়স ১৩ ববছর। সে পবিত্র কোরআনের হাফেজ শেষ করে তাকে আস-সুন্নাহ ট্রাস্টে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি।

ছোট ছেলে আবু হুরাইরা বয়স ১০, সে বর্তমানে আস-সুন্নাহে হিফজ করছে, আলহামদুলিল্লাহ ২৩ পারা চলে।

মেয়েটা সবার ছোট হুমায়রা, বয়স ৫ বছর। তাঁর জন্মের ৩ মাস পর সে বাবাহারা হয়, তাকে এখানো মাদরাসাই ভর্তি করিনি।

সামনে জানুয়ারিতে নুরানি বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিব ইনশাআল্লাহ্‌।

মণিকে আমার কাছে একেবারে রেখে দিয়েছি, মানে শাকিলের সাথে বিয়ে দিয়েছি আমি নিজ উদ্যোগে।

সে শিশিরের ব্যবসা দেখাশোনা করছেন, এবং আমার বাচ্চাদের সব খরচ বহনসহ নিজ পিতার মতো আগলে রেখেছেন।


আর শিশির!!!! 

শিশির আমাকে ছেড়ে আজ পাঁচ বছর হলো অভিমান করে চিরতরে জান্নাতে চলে গেছেন।

আগেই বলেছিলাম! শিশিরের কিডনির সমস্যা ছিলো, একটা লাগানো আরেকটা নষ্ট হয়ে গেছিলো। পরে লাগানোটাও নষ্ট হয়ে যায়, আমি আমার নিজের কিডনি একটা তাকে দিতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু তাঁর হায়াত না থাকার কারনে আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন।

যেদিন তাঁর জন্য কিডনি দিব,  তাঁর আগের দিন তিনি মারা যান!!

আমি সেদিন সারাদিন বেহুশ হয়েছিলাম, আমার হুশ ফিরতে দুদিন লেগে যায়।

আমার প্রিয়র মুখটি শেষবার দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

শেষ বিদায়ের সময় অনেক ডাক্তার দেখিয়েও হুশ হয়নি আমার।

তাঁর দাফনের পরের দিন দুপুরবেলা আমার হুশ ফিরেছিল, অনেক খুঁজেছিলাম। শিশিরকে তোথাও পায়নি।

আবু হানিফ আমার বড়ো ছেলে! সে এসে বললো -

-" মা মনি সবর করো, বাবা আমাদের এতিম করে পৃথিবী ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।"

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, শিশিরের স্মৃতি আমাকে কুরেকুকরে খাই।

এভাবে আমার ইদ্দোত ৪ মাস দশ দিন পুর্ন হলো।

আমার শাশুড়ি আম্মু আমাকে বললেন-

-"মা তুই আমার মেয়ের মতো ছিলি, আমার বড়ো ছেলে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। এখানো আমার আরেক সন্তান আছে শাকিল!  তাকে এখানো বিয়ে দিইনি, শাকিল গতরাতে বলেছিল তুই রাজি থাকলে তোর তিন সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাই।"

আমি কোনো উত্তর দিইনি চুপ ছিলাম, এদিকে মণির বয়স অনেক হয়ে গেছিলো, বিয়ে কপালে না রাখলে যা হয়।

মণির অনার্স মাস্টার্স সব শেষ, রেজাল্টও অনেক ভালো ছিলো কিন্তু সে চাকরিবাকরি কিছুই করিনি ইচ্ছা করে।

আমি আম্মুর সাথে সলাপরামর্শ করে শাকিলের সাথে মণির বিয়ে দিয়ে দিই।


হুমায়রা মণিকে বড়ো আম্মু ডাকে, আমাকে ছোট আম্মু। কারন শিশির মারা যাবার পর আমি পাগলিনীর মতো হয়ে যায়, যারজন্য মেয়েটাকে ঠিকমত খেয়াল করতে পারতাম না। সেই সময় থেকে আজ অবধি মণি নিজের সন্তানের মতো তাকে লালনপালন করে।


জীবনে ঘটে যাওয়া বীভৎস কাহিনী, যা সহজে ভুলতে পারিনা!

আমার জীবনের সমস্তরকম অস্তিত্ব জুড়ে শিশিরের বসবাস।

আজো এখানো মনে হচ্ছে শিশির কানের কাছে এসে ফিশফিশ করে বলছেন-

-" প্রেয়সী!  ওঠো, কিয়ামুল্লাইল পড়তে হবে। আবার খাওয়ার সময় মনে হয় এখনি কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বলবে, দেখি গাল হা করো খাইয়ে দিই।

এসব ভেবে চোখের অশ্রকণা ফলোয়ার মতো গড়িয়ে পড়ে।


আমার শিশির, আমার ছন্নছাড়া জীবন থেকে ভোরের “শিশিরকণা”র মতো এই কণার জীবন থেকে পূর্বাকাশে সূর্য উদিত হওয়ার সাথেসাথে ঝরে পড়লো।


সমাপ্ত

ভুলত্রুটি ক্ষমাপ্রার্থী।

ভালো লাগলে কমেন্ট করে জানাবেন।

0 Comments:

Post a Comment