গল্প হৃদয়হরণী পর্ব ১৬

 #হৃদয়হরণী

#কলমে সৌমিতা

#পর্ব-১৬


-বাইরে মেঘ করে আছে ,,,না হচ্ছে বৃষ্টি আর না হচ্ছে হাওয়া,,, চারিদিকে কেমন গুমোট হয়ে আছে,,,অসহ্য কর পরিবেশ, ভ‍্যাপসা গরম,কিছুই ভালো লাগছে আবিরের,,,এখন রাত প্রায় দশটা বাজে,,ঘন্টা খানেক আগে এই লেকের পাড়ে এসেছে ও,,,বিয়ারের বতলে শেষ চুমুক দিয়ে সেটাকে আছাড় মাড়ে ,আর সাথে সাথেই বিকট শব্দে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে সেই বতলের ভাঙা অংশ,,,,তারপর জোড়ে একটা চিৎকার দেয়। হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে তক্ষনাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে আবির,,,, কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,,,,,,

_______________

-সদর দরজা দিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই সামনের পরিবেশ দেখে কোনো এক অজানা ভয়ে ওর পা দুটো ওখানেই থমকে গেল,,,সবকিছু বোধগম্য হলে চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল, আপনাআপনি হাত দুটোও মুঠ হয়ে এল,,,,পেখম তখনও বিষ্ময় কাটিয়ে উঠতে পারে  নি,,কেননা তার সামনে আর কেউ নয় ঋষি বসে আছে,,তবে কি ঋষির সাথে ওর দাদুন বিয়ে ঠিক করেছে,,,ওর মাথা ঘুরছে,মনে হচ্ছে এখনই পড়ে যাবে,,তখনই পিছন থেকে তীয়ার বলা কথা গুলো শ্রবণ হতেই ও চমকে উঠলো,,,দ্রুত দরজার দিকে তাকালো,,,,


-আরে দাদাভাই ভিতরে আয়,,ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন??(তীয়া)


-হমম চল(আবির)


-পেখমকে  ঋষির মা নিজের পাশে বসতে বললেন তারপর তিনি পেখমকে দু একটা প্রশ্ন করে ঋষিরবাবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে" আমার তো আমার হবু বৌমাকে খুব পছন্দ হয়েছে,, আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হয়,,তারপর ঋষির বাবা পেখমের দাদুন আর বাবার উদ্দেশ্যে বলে" আমার তো মন চাইছে পেখম মা কে এখনই সাথে করে নিয়ে যায়।এবার আপনারা বলুন,,,


-পেখমের দাদুন পেখমের পরিবারকে জিজ্ঞাসা করে ঋষিকে তাদের পছন্দ হয়েছে কি না??


-তখন  সবাই বলে হ‍্যাঁ আমাদের এই বিয়েতে কোনো অমত নেই।


-তাহলে শুভ কাজে আমরা দেরি করতে চাইছি না ভাই,,,ছেলে আমার এক মাস পরেই বিদেশে চলে যাবে,,,তার আগেই আমি এই বিয়েটা করিয়ে দিতে চাইছি,,,(ঋষির বাবা)


-তাহলে তাই হোক,,আমাদেরো কোনো আপত্তি নেই,, কিন্তু ওর পড়াশোনা??,(দেবেন্দ্র বাবু)


-সেই সব নিয়ে একদম ভাববেন না,, ও বিয়ের পরেও পড়বে,,,যতদূর পড়তে চাই আমরা পড়াবো,,,(ঋষির বাবা)


-আমরা আজকেই মেয়েকে আংটি পড়িয়ে আশীর্বাদ করে যেতে চাই,,,কি বলেন(পেখমের মা উদ্দেশ্যে ঋষির মা বলে)


- আমাদের কোনো সমস্যা নেই দিদি,,,আমার মেয়ের ভাগ্য ভালো যে ঋষির মতো এমন একটা ছেলেকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পাচ্ছে(মনোরমা)


-বিমলা যাও ঋষির জন্যে যে আংটি টা কিনে এনেছিলাম সেটা নিয়ে আসো,,,(নরেন্দ্র বাবু)


-বাবা তুমি আংটিও কিনে রেখেছো,,,(দেবেন্দ্র)


-হ‍্যাঁ, কারণ আমার বিশ্বাস ছিল তোরা ঋষিকে অপছন্দ করবি না,,, আর আমার দিদিভাই এত সুন্দর যে কেউ ওকে পছন্দ না করে থাকতেই পারবে না,,,


-আর সেটাই আমার কাল হয়ে এলো(কথাটা আবির বিড়বিড় করে বলল)


- বাবা আমি বলছিলাম কি একবার পেখমের কাছে থেকে জেনে নিন ওর এই বিয়েতে কোনো আপত্তি আছে কিনা??(তীয়া)


- কোনো আপত্তি নেই তীয়া,, আমি ওর মা,,,ওর সাথে আমার এই বিষয় নিয়ে অনেক আগেই কথা হয়ে গেছে,,,(মনোরমা)


 -মুহূর্তের মধ্যে পেখম আর ঋষির আংটি বদল হয়ে গেল,,,বিয়ের ডেট ঠিক হলো দু সপ্তাহ পর,,,সবাই মিষ্টি মুখ করলো,,,


-এতক্ষণ যা  হল পেখমের যেন তাতে কোনো রকম হেলদোল নেই,,,ও যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে,,,কাউকে কিছু বলতে না পারার কষ্টে নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে ওর,,,বারবার আড়চোখে আবিরের দিকে তাকাচ্ছে পেখম,, আর ততবারই আবিরের রক্ত-লাল চোখ দেখে ভিতরে ভিতরে দুমড়ে মুছরে যাচ্ছে ও।


-আবির তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন,,,বস এখানে,,, মা আবিরকে মিষ্টি দাও,,,পেখু যা ঋষিকে তোর ঘর আর ব‍্যালকনি দেখিয়ে নিয়ে আয়,,,(পুলক)


-তার দরকার নেই পুলক,,,কথা গুলো এখন জমানো থাক,,,পেখম তুমি যাও,,,এখন আমরা তিন বন্ধু মিলে আড্ডা দেবো,,(ঋষি)


-পেখম ওদের কথা মতো চুপচাপ উঠে গেল ,কারণ ও এখানে থাকতে পারছিলো না,,,দমবন্ধ লাগছিল,,,কান্না পাচ্ছিলো,,,,

____________________________________________


-অনুপমা তুমি আমাকে আগে কেন বলোনি,,, আবির বারণ করলো আর তুমি শুনে নিলে,,,(অশোক)


-আমি এত কিছু বুঝিনি,, রাত বারোটা বাজতে চললো ,,কিন্তু আবির এখনো বাড়ি ফিরছে না ,,,আমার ভীষণ ভয় করছে,,,তুমি কিছু করো,,,


-অনু তুমি জানো না তীয়া আর আবির এরা দুজন আমার কি,,,এদের যদি একটা টোকাও পড়ে গায়ে ওদের আগে ব‍্যাথা পায় আমি,,, আর আজ আমার ছেলের জীবনে এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেল,, পেখম যদি দেবেন্দ্রর মেয়ে না হতো ,,আমি একবারের জন্যও ভাবতাম না,,দরকার পড়লে তুলে আনতাম নিজের ছেলের জন্য,,, কিন্তু ও আমার সবথেকে কাছের বন্ধুর মেয়ে,,আমি কি করে কি করবো ভেবে পারছি না,,,দেবেন্দ্র কে যদি আমি দু দিন আগে আবিরের জন্যে পেখমকে চাইতাম,,তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও আমাকে ফিরিয়ে দিতো না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে,,, ওরা যে একদিনের মধ্যেই পেখমের আশীর্বাদ করে যাবে ও বিয়ের ডেট ফিক্সড করবে কি করে জানবো,,,আর সব থেকে বড়ো কথা হলো মেসোমশায়,, উনি নিজের জীবন দিয়ে দেবেন তবুও নিজেকে কথায় অটুট থাকবেন,,, কথার খিলাপ করবেন না,,, এখন দেবেন্দ্র রাজি থাকলেও সব হাতের বাইরে,,,তুমি যদি আমাকে আগে একটু জানাতে,,,,,


-আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে কথা বলবো কিন্তু তার আগেই,,,(কাঁদতে কাঁদতে)


-হ‍্যাঁ তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল,,, আবিরের একটা ভুলের জন্য,,, আর আমি তেমন কিছু করতে পারবো না কারণ ওখানে আমার মেয়েটা আছে,,,আমি চাইনা ওর সংসারে কোনো অশান্তির সৃষ্টি হোক,,,,(ওদের কথার মাঝেই আবির বাড়িতে ঢুকলো,,,আবিরের অবস্থা দেখে অনুপমা কেঁদেই ফেললেন,,চুল গুলো এলোমেলো,, ইন করা শার্ট বেরিয়ে এসেছে,,, চোখ গুলো লাল আর ফোলা,,মাকে কাঁদতে দেখে আবির বলে ওঠে,,)


- আমি ঠিক আছি,,,খিদে নেই,, এখানে না দাঁড়িয়ে যাও ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো তোমরা,,,(বলেই উপরে চলে গেল,, অশোকের খুব কষ্ট হচ্ছে ছেলের এই রকম অবস্থা দেখে,,, ও মনে মনে ঠিক করলো এই নিয়ে দেবেন্দ্রর সাথে একবার কথা বলবে,,,দরকার পড়লে ভিক্ষা চাইবে পেখমকে নিজের ছেলের জন্য)

__________________________________________


-পেখম সেই কখন থেকে ব‍্যালকনিতে আবিরের জন্যে অপেক্ষা করছে,,, রাতে না খেয়েই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ও। মনোরমা জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল মাথা ব্যথা করছে খাবো না,,আসলে আজ ওর গলা দিয়ে ভাত নামবেই না।


-যেখানে প্রতিটা সময়ে ও আবিরকে অনুভব করেছে,,,সেখানে হঠাৎ ঋষিকে কি করে মেনে নেবে ওও,,,পারবে না মানতে,,,এইসব কথা ভাবার মধ্যেই দেখলো আবির ব‍্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আছে,,, ও কিছু বলার সাহস পেলো না,,, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো আবিরের দিকে চেয়ে,,,,কিছুক্ষণ পরে দেখলো আবির চলে যাচ্ছে,, ও সাহস করে একবার ডাকলো "আবির দা",,,,


-পেখমকে ব‍্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবির ঘরে চলে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই পেখমের ডাকে ওর পা দুটো থেমে যায়,, কিছুটা সময় পার করে পিছনে ফিরে তাকায়,,, আবিরের রক্ত লাল চোখ দেখে পেখমের চোখ জ্বালা দিয়ে ওঠে,,নিজেকে সামলে কিছু বলার আগেই, পেখমের অন্তর কাঁপিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় আবির বলে ওঠে,,,


- don't you dare to talk to me পাখি,,,


-আবিরের এই রকম ক্রোধের সামনে কখনো পড়েনি পেখম,, তাই আজ মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,,, মুহূর্তের মধ্যে চোখ দুটো দিয়ে অঝরে ঝরতে থাকলো বারিধারা,,,, আর সাথে সাথেই ঝঙ্কার তুলে সেই গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠের অধিকারী বলে ওঠে,,,


- কখনোই আর এই সাহস প্রকাশ করো না পাখি,,,তুমি আমার অনুভূতি কে অপমান করেছো,,আমাকে অপমান করেছো,,তা না হলে পারতে না তাদের সামনে যেতে,,সবার মুখের উপর বলেই দিতে যে পারবে যেতে তুমি কোনো ছেলের সামনে,,আর না পারতে আমার দেওয়া শাড়ি গয়না পড়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে,,, এইগুলো পড়ার আগে তোমার একবারের জন্যেও কি আমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠেনি?? এখন আমার সত‍্যিই আফসোস হচ্ছে,, শুধুই মনে হচ্ছে নিজের অনুভূতির সাগরে আমি একজন ভুল মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম ভালোবা,,,,না না ভুল সব ভুল,,,সে কখনোই আমার ছিল না,,,(বলেই চলে গেল ব‍্যালকনি থেকে,,আর পেখম সে কান্নায় ভেঙে পড়ে ব‍্যালকনিতে বসে পড়ে)

__________________________________________


-পুলক ঘরে ঢুকেই দেখে তীয়া ব‍্যালকনির মোড়াতে বসে আছে,,, ও হাফ প্যান্ট আর একটা স‍্যান্ডো গেঞ্জি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। প্রায় আধ ঘন্টা পর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে তখনো তীয়া ঐ এক ভাবেই বসে আছে,,, তোয়ালেটা ব‍্যালকনির দড়িতে মেলে দিয়ে তীয়ার গায়ে হাত দিয়ে ডাকে,,,


-আচমকা পুলকের এই ভাবে ডাকাতে তীয়া চমকে ওঠে,,, ওকে চমকাতে দেখে পুলকের ভ্রু যুগল আপনাআপনি কুঁচকে গেল,,


-কি হয়েছে তীয়া?? তোমাকে এই রকম দেখাচ্ছে,,,


- না কিছু না,,, একটা হিসেব মেলাতে পারছি না পুলক,,


-কি আমাকে বলো,,,


- না কিছু না,,, শুনলে আপনি কি ভাবে রিয়‍্যাক্ট করবেন,,, আর আমি নিজেও জানি না আমার ধারণা ঠিক কি না,,


-তুমি যদি বিষয়টা আমাকে না বলো,তাহলে আমি জানবো কি করে,,,বলো আমি রিয়‍্যাক্ট করবো না কথা দিলাম,,,


-পুলক,,মানে ,আমার মনে হয়,,


-কি বলো,,


-পুলক আমার মনে হয় পেখু আর দাভাই একে অপরকে ভালোবাসে,,,


-তীয়ার কথায় কিছুটা অবাক হয়ে পুলক বলে" তোমার ধারণা ভুল,,আমার চোখের সামনে তো তেমন কিছু পড়েনি"


-কিন্তু আমার পড়েছে পুলক,,,আমাদের এত তাড়াতাড়ি পেখমের বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা উচিত হচ্ছে না,,,


-তোমার কথা মতে যদি ওরা একে অপরকে ভালোই বাসবে ,তাহলে আমাদের কেন বললো না,,আর আজ যেটা হলো ,,তখন কেন পেখু বা আবির কিছু বললো না??


- বলার মতো কি সত্যিই কোনো স্কোপ ছিল পুলক?? আমরা ভাবতে পেরেছি যে পেখুর বিয়ে আজকেই ঠিক হয়ে যাবে,,, বা দাদুন সব আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছে,,,,,হয়তো ওরাও বুঝতে পারেনি,,,ও না না বুঝতে পারবে কি করে পুলক পেখম তো জানতোই না, ইভেন আমরাও জানতাম না যতক্ষণ না দাদুন বলেছে,,,


- এটা তো বড়ো একটা ভুল হয়ে গেল তীয়া,,, কারণ দাদুন ভীষণ একরোখা,,, সে যেটা একবার বলবে সেটা সে করবেই,,, এক্ষেত্রে আমি বা তুমি কিছুই করতে পারবো না যতক্ষণ না আবির বা পেখম কিছু বলছে,,,আর জানি না বলে কোনো লাভ আছে কি না,,, আমার তো পেখমের উপর রাগ হচ্ছে,,, ও কেন আমাকে বললো না একবার,,, ও যদি একটা বার আমাকে বলতো আমি কথা এতদূর এগোতেই দিতাম না,,,


চলবে,,,

নেক্সট পর্ব লিংক👇

https://wwp.ailony.com/redirect-zone/e7dc6d73

0 Comments:

Post a Comment