গল্প শেষটা_সুন্দর পর্ব ২১

 #শেষটা_সুন্দর 

#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)

#পর্ব___২১ (বোনাস পার্ট)


'আপনার দাদু মহিলা মানুষ হয়ে সিগারেটও খেয়েছে?'


'হুঁ! সিগারেট দাদুর ভীষণ পছন্দের।'


নির্ঝরের ভাবলেশহীন উত্তরে তরী ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল। ফ্লোরে পড়ে থাকা নিজের জামা কাপড় বাঁচিয়ে নির্ঝরের দিকে এগিয়ে এলো। চোখ পাকিয়ে বলল,


'মৃত মানুষ সিগারেট খেতে এসেছে?'


'হুঁ। কেন, তোমার মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি? এই বিশ্বাস করো আমায়?'


তরী হাসতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল। স্বাভাবিক ভাবে বলল,


'আহা! এমন কিছু না। শুধু খটকা লাগছে। মৃত মানুষ কি সিগারেট খেতে পারে?'


'হাউ ফানি! কেন পারবে না? মরে গেলেই কি মানুষের শখ, আহ্লাদ মিটে যায়? সিগারেট খাওয়া একটা শখের বিষয়। আমার পরিচিত এক বান্ধবী শুধুমাত্র শখের বশে সিগারেটে একটান দিতে চেয়েছিল। সুযোগ পায়নি বলে এক পর্যায়ে মানসিক রোগী হয়ে গেছিল।'


'এতো জীবিত মানুষের কথা বলছেন। অবশ্যই মৃত মানুষ সিগারেট খেতে পারে না।'


নির্ঝর চোখ উল্টে বলল,


'এমন কনফিডেন্স নিয়ে বলছো যেন দু চার বার মরে দেখেছো। মৃত মানুষের খাবার দাবার সম্পর্কে সব জেনে বসে আছো তুমি?'


'বাদ দিন। এটা বলুন যে আপনার দাদুকে কি শুধু আপনি একা দেখতে পান?'


'ঠিক বলেছ। একা দেখতে পাই! আরে দাদু শুধু আমার জন্য আসে। দাদু আমায় ভীষণ ভালোবাসে। রাতে বলছিল যে আমায় নাকি ভীষণ মিস করে। আমিও তাকে ভীষণ মিস করি। দুজনেই প্রচুর দুঃখে ছিলাম। সুখ দুঃখের আলাপ করলাম। এক পর্যায়ে দুঃখ কমানোর জন্য ধোঁয়া ছাড়লাম শুধু।'


নির্ঝরের এই নির্বিকার ভাবে বলে যাওয়া মিথ্যের ঝুড়ি তরীর বেশ ভালো লাগছে। সে গম্ভীর কন্ঠে বলল, 


'তা আপনার দাদু কি আমায় তার সতীন মনে করে? আপনার লাগেজ স্পর্শ করলো না। কিন্তু আমার সবগুলো জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কি অবস্থা করেছে! তাকে এক্ষুণি ডাকুন তো। বলুন যে আমার লাগেজ পুনরায় গুছিয়ে দিয়ে যেতে। না হলে খুব খারাপ হবে।'


নির্ঝর মাথা নেড়ে বলল,


'রাত ছাড়া তো দাদুকে পা-ওয়া যায় না। আজ রাতে এলে গুছিয়ে দিয়ে যেতে বলবো। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করো।'


'হাউ বজ্জাত! আমাকে বোকা মনে হয় আপনার কাছে?'


আচমকা নির্ঝর একলাফে বসা থেকে উঠে পড়লো। তরীর মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে লাল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর তরীকে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তরী গলা উঁচিয়ে বলল, 


'আমার কাপড়চোপড় এভাবে রেখে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সবগুলো আগের মতো গুছিয়ে রাখুন। নইলে কিন্তু......'


দরজার কাছে গিয়ে নির্ঝর দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন ঘুরে তরীর দিকে এক নজর তাকিয়ে ছিটকিনিতে হাত রাখলো। ভেতর থেকে দরজা লক করে ঘুরে দাঁড়াতে তরীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বুকের ভেতর শীতল একটা ঝড় বয়ে গেল। কাল রাতে কথা না শোনার জন্য এখন শাস্তি দিবে না তো? নাহ! 


সে আমতা-আমতা করে বলল, 


'সকাল হয়ে গেছে দেখছেন না? এখন দরজার ছিটকিনি লাগানোর সময়?'


'হাউ ফানি! দরজার ছিটকিনির সাথে সকালের কি সম্পর্ক তরীরানি?'


'দরজা খুলুন। আমি বই নিতে এসেছি।'


'দরজা খোলা যাবে না। বুঝতে পারোনি? ইংরেজিতে বলবো?'


তরী বেশ ঘাবড়ে গেল। কথা ঘোরানোর জন্য সহজ গলায় বলল,


'আমার ভাই কোথায়? ও রাতে আপনার সাথে ঘুমায় নি? '


'হুঁ! প্রথমে ঘুমাতে চেয়েছিল। ম্যাজিক দেখানোর কথা বলে সিগারেট আনিয়েছি ওকে দিয়ে। কিন্তু ম্যাজিক কাজ করেনি। মানে পুরো আধ ঘন্টায় চার চার বার সিগারেট রুমাল দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। মনে মনে অনেক দোয়া দরুদপাঠ করেছি। কিন্তু সিগারেট গোলাপে পরিণত হয়নি। রাগ করে তাফসি চলে গেছে আর কি! আমার মতো ঠকবাজের সাথে ঘুমাবে না সে।'


বলতে বলতে নির্ঝর তরীর দিকে এগোল। তরীর আর বুঝতে বাকি রইলো না কোন ম্যাজিকের কথা বলছে। নির্ঝর সামনে দাঁড়াতে সে টেবিলের কাছে সরে গেল। ততক্ষণে নির্ঝর ফ্লোর থেকে বেডশিট উঠিয়ে বিছানায় কোনোমতো বিছিয়ে রাখলো। বালিশ দুটো উঠিয়ে তরীর দিকে তাকালো। 


তরী দুটো নোটবুক আর খাতা, কলম বুকে জড়িয়ে বলল,


'আমি নিচে যাব। পড়তে হবে।'


নির্ঝর কোনো কথা শুনলো না। নিজে বাঁচলে পড়ার নাম! সে যদি না ঘুমিয়ে ব্রেন স্ট্রোক করে তাহলে তরীর এত পড়ে কি লাভ? সে এগিয়ে এসে তরীর হাত চেপে ধরলো। হুকুমের স্বরে বলল, 


'নো পড়াপড়ি! আগে আমার ট্রিটমেন্ট দাও।'


'আপনার আবার কিসের ট্রিটমেন্ট?'


'ঘুমের ট্রিটমেন্ট। ঘুম প্রয়োজন আমার। দেখছো না, আমার অবস্থা? যখন তখন হার্টে অ্যাটাক ঘটবে। বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে হার্ট অ্যাটাক আটকে রেখেছি। হাত সরালেই পটল তুলতে চলে যাব।'


নির্ঝরের সব কথা তরীর মাথার উপর দিয়ে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে সে শুধু চেয়ে রইলো। তাতে অবশ্য নির্ঝরের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে হাত ধরে তরীকে বিছানায় বসিয়ে দিল। তরীর পাশে বালিশ টেনে শুয়ে পড়লো সে। একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলল। আশ্বাসের হাসি হেসে বলল, 


'আমার পাশে বসে পড়ো। শব্দ করে পড়বে কিন্তু।'


'আমার পড়ার শব্দে ঘুম আসবে আপনার?'


'ডিঙিরাণী! এতগুলো মাস তোমার পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। গতকাল রাতে সে ব্যবস্থা ছিল না বলে সারারাত ঘুম হয়নি আমার। তাকিয়ে দেখো, তোমার পেছনে মোবাইল রেকর্ড চালু করে রেখেছি। আজ যা যা পড়বে সব রেকর্ড হবে। ভবিষ্যতে তুমি পাশে না থাকলে রেকর্ড শুনে ঘুমিয়ে পড়বো।'


নির্ঝর চোখ বন্ধ করলো। তার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে তরীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নির্ঝরের অজান্তেই সে নিজের হাসিটুকু মিলিয়ে নিল। বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে তাতে নজর দিল। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতায় শুধু চোখ বুলাল। হঠাৎ নির্ঝর বন্ধ চোখে তার ডান হাতটা ধরলো। তরী কিছু বলার আগে সে জড়ানো কন্ঠে বলল, 


'হাতটা কপালের উপর থাক শুধু। শব্দ করে পড়ো! কানে তো আসে না।'


তরী হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। বরঞ্চ নির্ঝরের এই স্পর্শ টুকু তার ভীষণ ভালো লাগছে। নির্ঝরের কপালে রাখা হাতটার দিকে এক পলক চেয়ে সে জোরে জোরে পড়া শুরু করলো। 


_______________


আজ রবিবার। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরছে। সেই ভোরবেলা থেকে বৃষ্টি। থেমে যাওয়ার নাম গন্ধ নেই। বৃষ্টির গতি একটু কমছে তো আবার পরক্ষণে বেড়ে চলেছে। ভেজা বেলকনি দিয়ে বাহিরটা পরখ করে তরীর মন খারাপ হয়ে গেল। আজ তার প্রথম পরীক্ষা। বোর্ড পরীক্ষা। অথচ আজকের দিনেই মেঘমল্লার সাহেবকে এত অভিমান করতে হবে? এত জল ঝরাতে হবে? মন খারাপ নিয়ে সে রুমে ঢুকলো। 


রুমে ঢুকতে নির্ঝরকে নজরে এলো তার। তার দিকে পেছন ঘুরে আছে। টেবিলে রাখা ফাইল চেক করছে। এডমিট কার্ডসহ সবকিছু নেওয়া হয়েছে কি না! তরী নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। নির্ঝরের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে নির্ঝরের আপাদমস্তক দেখে চলল। নির্ঝরের পরণে নীল শার্ট আর কালো প্যান্ট! শার্টের হাতা কনুইয়ের কাছে ফোল্ড করা। পাতলা লোমযুক্ত ফর্সা হাত অনেকটা অনাবৃত। সেই মোহনীয় বাম হাতে কালো একটা ঘড়ি! তরী হাঁ করে চেয়ে রইলো যেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যমানব তার চোখের সামনে। 


কিছু সময় পর নির্ঝর ফাইল হাতে ঘুরে দাঁড়াল। তরীকে পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে হকচকিয়ে গেল। অবাক হয়ে বলল, 


'তুমি!'


তরীর হুশ ফিরলো। আলগা করে রাখা ঠোঁটজোড়া একত্রে করলো। জিহবা দিয়ে একবার ভিজিয়ে নির্ঝরের সামনে থেকে সরে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাবের পিন ঠিক করা শুরু করলো। নির্ঝর তাড়া দিয়ে বলল, 


'দেরি হয়ে যাচ্ছে তরী। চলো রওনা দেয়া যাক।'


'হয়ে গেছে আমার। আচ্ছা বলুন তো। বেছে বেছে কেন নীল রঙের শার্টটাই আপনার পরতে হবে আজ?'


'কেন এটা ভালো লাগছে না?৷ চেঞ্জ করবো?'


তরী আয়না দিয়ে নির্ঝরের দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলল। এত সুশ্রী একটা মুখ, সুদর্শন একটা মানুষ তার একমাত্র বর ভেবে মন পুলকে ভরে গেল। একটুপর পেছন ঘুরে নির্ঝরের দ্বিধাদ্বন্দে ডুবে থাকা মুখের দিকে চেয়ে বলল, 


'আজকের মতো থাক। চলুন তাড়াতাড়ি।'


দুজন একত্রে নিচে নামলো। নির্ঝর আগে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো। তরী সবার থেকে দোয়া নিয়ে কিছুক্ষণ পর তার বাবার হাত ধরে গাড়ির কাছে এলো। নির্ঝর গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসতে বললো। শেষ বারের মতো ফাইল চেক করে বিসমিল্লাহ বলে গাড়ি স্টার্ট দিল।


তরীর কলেজ সে চিনে। সেই কলেজ থেকে পাঁচ মিনিট দূরের আরেকটা কলেজে তরীর সিট পড়েছে। গতকাল নির্ঝর গিয়ে রোল নম্বরসহ সিট দেখে এসেছে। আজ সরাসরি তরী গিয়ে বসে পড়বে।


বাকি রাস্তা টুকু তেমন কথা বলল না তরী। নির্ঝর তাকে গম্ভীর গলায় অনেক উপদেশ দিল। সে শুধু মাথা নেড়ে হু হাঁ করলো। তরীর ভয় কমানোর জন্য নির্ঝর তাকে অনেক কথা বললো। একটু সহজ করার জন্য, হাসানোর জন্য অনেক মজার মজার কথা বললো। কিছুতেই কিছু হলো না। তরী মুখ ভার করেই রাখলো। 


ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে আধ ঘন্টা পর তারা হলে পৌঁছে গেল। গেটের সামনে প্রচুর গাড়ি। মানুষ তেমন নেই। প্রচুর বৃষ্টি বলে ভীড় কম। ছাত্র ছাত্রীরা ভেতরে ঢুকছে। অভিভাবক প্রবেশ নিষেধ। নির্ঝর গাড়ি থেকে নেমে ছাতা মাথায় দিয়ে তরীর পাশে এলো। দরজা খুলে তাকে ছাতার ভেতর নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। গেটের কাছাকাছি এসে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। তরীর চিন্তার ভাঁজ পরা মুখের দিকে চেয়ে স্মিত হাসলো। গভীর মায়া নিয়ে সে তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ধরা গলায় বলল,


'একদম ভয় পাবে না ডিঙিরানি! কোনো প্রেশার নিয়ো না। আমার ফেল্টুস বউ পছন্দ। কারণ বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনীদের বলার মতো গল্প হয়ে যাবে। এবার একটু হাসো তো?'


এই প্রথম সামনের মানুষটার মুখের উপর থেকে সব পর্দা সরে গেল যেন। তার মন অবধি পৌঁছাত পারলো তরী। এক নিমেষে মন পড়ে ফেলতে পারলো। সিক্ত নয়নে মুচকি হেসে ফেলল সে। ডান হাত উঁচু করে মাথায় রাখা নির্ঝরের হাতটা স্পর্শ করলো। 


তরীর হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে নির্ঝর গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। মাথা ঝেরে পানির ফোঁটা ফেলে দিল। তারপর অস্পষ্ট কাচ দিয়ে দেখলো তার জীবন তরী গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। স্বপ্ন ছোঁয়ার পথে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কেন জানি নির্ঝরের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বিড়বিড় করে তার জানা সমস্ত দোয়া দরুদ পাঠ করা শুরু করলো। 


(চলবে....)


নির্ঝর বলতে চায়, 'বলো তরী!'

আমি লিখি, 'বলো হরী!'

মানে গল্প লেখার সময় তরীর জায়গা বার বার হরী লিখতে থাকা আমি। 🙂

0 Comments:

Post a Comment