গল্প হৃদয়হরণী পর্ব ১৩

 #হৃদয়হরণী

#কলমে সৌমিতা

#পর্ব-১৩


-তুই ভিজেছিস কেন??


-আর বোলো না মা,,,পাখিকে ডাকতে গিয়ে দেখি ও ভিজছে বৃষ্টিতে,, ওকে টেনে আনতে গিয়ে আমিও ভিজে গেলাম।


-ওওও ওই জন্যে একটু আগে পেখমকে দেখলাম ভিজে দৌড়ে চলে গেল চেঞ্জ করতে,,,ওর একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়,,,এক কাজ কর কফিটা নিয়ে যা ,,,দুজনে খেয়ে নিস,,ওর কিন্তু পরীক্ষা চলছে,,এই সময় ঠান্ডা লেগে জ্বর আসলে আর এক কান্ড হবে,,,(বলেই অনুপমা আবিরকে দুকাপ কফি দিয়ে বললেন,,)


-শোন তুই আগে গিয়ে চেঞ্জ করবি,,এই অসময়ে ভেজার জন্যে কিন্তু আবার মাথা ব্যথা করবে,,,যা এখন,,


-ঠিক আছে মা,,,এত চিন্তা করতে হবে না। (বলেই কফির ট্রে টা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল)

________________________________________


-পুরো ভিজে যাওয়ার ফলে পেখম বাধ্য হয়েই আবিরের ওয়াশরুমে যায় চেঞ্জ করতে কেননা ওর জামাকাপড় সব আবিরের ঘরেই ছিল,,, ও ভেবেছিল বৌমনির ঘরে যাবে কিন্তু তাতে আবার চারিদিকে জল জল হয়ে যাবে,,,বেশ অনেকক্ষণ শাওয়ার নেওয়ার পর একটা নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পড়ে বের হয় পেখম,,,


-ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে আবির ওর দিকে তাকিয়ে আছে ,হাত দুটো পকেটে গুজে,,,ও কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই, আবির ওর হাত ধরে ফেলে,,,তারপর পেখমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,,

-"পাখি কোথায় যাচ্ছিস"??


-,,,,,,,(নিশ্চুপ)


-কি হল আমি তোকে কিছু জিজ্ঞাসা করছি তো?? আমাকে এভয়েড করার কারণ কি??(গম্ভীর হয়ে )


-আবিরের এই গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে পেখম মনে মনে খুব ভয় পেল,কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ না করে বলল" আমি আপনাকে এভয়েড কেন করতে যাবো আবির দা"??


-আমার প্রশ্নের পিঠে কেউ পাল্টা প্রশ্ন করুক সেটা আমি পছন্দ করি না,,,


-তাতে আমার কি?? আমারও তো অনেক কিছু পছন্দ হয় না, তবুও তো সহ‍্য করি,,সব কিছু মেনে নি,,,


-কি সহ‍্য করো ,,,আর এই রকম ব‍্যবহারের কারণ কি??


-সেটা আপনাকে আমি বলতে বাধ্য নই,,হাত ছাড়ুন আবির দা,,(হাতের দিকে তাকিয়ে)


-এবার আর সহ্য করতে পারলো না আবির,,বেশ জোড়েই চিৎকার করে বলে ওঠে" আলবাদ উত্তর দিতে বাধ্য তুমি পাখি,,,আমাকে বেশি উত্তেজিত করে তুলো না,,আমার প্রশ্নের উত্তর দাও,,,


-কে আপনি??


-মানে??(প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে পেখমের দিকে)


-মানে টা খুব পরিষ্কার আবির দা,,কে আপনি?? আমি কেন আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেবো?? আপনিও বা কেন এত প্রশ্ন করবেন আমাকে?? আমার কে হন আপনি?? বা আমি আপনার কে??(আবিরের চোখে চোখ রেখে কথা গুলো বলে পেখম,, তারপর চোখের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে যায়)


-পেখমের প্রশ্ন গুলো শুনে আবির মনে মনে ব‍্যথিত হয়,,মেয়েটা কি এখনো বোঝে না আবির কে ওর,,বা ও আবিরের কে,,,এইসব ভেবে আবির অন্তত গম্ভীর হয়ে পেখমের হাত ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে চলে যাওয়ার জন্য উদ্দত হয়,,,ঠিক দরজা পর্যন্ত গিয়ে পিছন ফিরে পেখমের দিকে তাকিয়ে বলে,,


-"তাকে আমি কখনোই বলবো না আমি তার কে? বা সে আমার কে? এই প্রশ্নের উত্তর তাকেই উপলব্ধি করতে হবে,,, আর যেদিন সে উপলব্ধি করতে পারবে,সেইদিন সে আমাকে কখনোই আর প্রশ্ন করবে না আমি তার কে? বা সে আমার কে"??


-কথা গুলো বলেই আবির ফিরে ব‍্যালকনিতে চলে যায়,, পেখম কিছুক্ষণ ঐ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে,,তারপর নীচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখে টেবিলের উপর দুটো কফির মগ ঢাকা দেওয়া আছে,,ও মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে কফি মগটা নিয়ে ব‍্যালকনিতে চলে যায়,,,


-ব‍্যালকনিতে গিয়ে দেখে আবির রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। আর বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওকে,, ও ব‍্যালকনির সেন্টার টেবিলের ওপর কফির মগটা সশব্দে রেখে দিল। তারপর কিছুক্ষণ ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো,,,আবির ওর উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,,


-কিছু বলবি? এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস,,,


-আসলে সরি আবির দা তখন কথা গুলো ওই ভাবে বলতে চাইনি।


-ঠিক আছে এখন যা,,


-আপনি একটু আগেও ভিজেছেন,,এখন আবার ভিজছেন,,,ঠান্ডা লেগে যাবে,, গিয়ে চেঞ্জ করে আসুন, কফি ঢাকা আছে,,ঠান্ডা হবে না।তারপর খেয়ে নেবেন,,, আসছি আমি(বলেই বেরিয়ে যেতে নিলে পিছন থেকে ভরাট পুরুষালী কন্ঠস্বরে আবির বলে ওঠে,,)


-"ব‍্যাঙ্গালোরে থাকি বলে এই না যে আমার কাছে অঢেল সময় পাখি। কখনো কখনো বাড়ি ফিরে খাবার গরম করতে ইচ্ছে করে না, তখন জল বিস্কুট বা কেক খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি এতটা ক্লান্ত থাকি আমি। ঐ খানে সব কিছু একা আমাকেই সামলাতে হয়। চব্বিশ ঘন্টা মেড কে ভরসা করা যায় না কারণ আমাদের ব‍্যবসার ক্ষেত্রে যেমন বন্ধু হয় অনেকে,ঠিক তেমনই নিজেদের অজান্তেই অনেক শত্রু হয়ে যায়।রান্নার লোকটা রান্না করে দিয়ে গেলেও উঠে গরম করতে ইচ্ছা করে না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, না এইবার যখন এসেছি, তখন আর একা ফিরে যাবো না,, প্রায় প্রায় কেক,বিস্কুট খেয়ে আর থাকা যাবে না,,, সঙ্গে করে পার্মানেন্ট একজনকে নিয়েই যেতে হবে"।


-আবিরের কথা শুনে খুশি হলেও পেখমের কোথায় যেন খুব কষ্ট হয়,,, মানুষ টা এত পরিশ্রম করে ওখানে,, আর ও কি না উল্টো পাল্টা ভাবে তাকে নিয়ে,,, ও দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে গিজার টা অন করে, তারপর আবিরের একসেট জামা বিছানায় রেখে নীচে চলে যায়।

________________________________________


-রাতে খাওয়ার সময় অনুপমা বলেন"আবির এ-কদিন তো পেখম তোর ঘরে শুয়ে ছিল,, তা আজকে কোথায় থাকবে,,,আমি ওকে গেস্টরুমে শুতে দিতে চাইছি না,,আর এদিকে তীয়ার ঘরের এসি টাও খারাপ হয়ে গেছে,,


-কোনো ব‍্যাপার না মা পাখি আমার ঘরেই থাকুক,,আমি গেস্টরুমে চলে যাচ্ছি,,,


-না না আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। কাকিমনি বৃষ্টিতে ভিজে এমনিতেই ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে,,আমি বরং বৌমনির ঘরেই থাকবো,,,উনি উনার ঘরেই থাকুক।


-ঠিক আছে,,, আবির তোকে আর স্টু দেবো,,


-হ‍্যাঁ মা একটু দাও,,বাটার আর মিষ্টি টা আজকে একটু বেশি দিয়েছে রেখা দি,,,


-আজকে রেখা রান্না করে নি,,,পেখম করেছে,,,


-ওও তাই তো ভাবি আজকের রান্নার টেস্ট অন‍্যরকম কেন??


-আপনার যদি পছন্দ না হয়,, আপনি তাহলে স‍্যুপ খেতে পারেন,ওটা কাকিমনি রান্না করেছে,,, 


-হ‍্যাঁ দাঁড়া তোদেরকে এনে দিচ্ছি বলেই অনুপমা রান্নাঘরে গেল,,অনুপমা যেতেই আবির বলে,,


-"তার হাতের রান্নাকে কখনোই আমি খারাপ বলতে পারি না,, কারণ সেই রান্নার মধ্যে রয়েছে অনেকটা ভালোবাসা। আর আমি তো তাকে আগেই বলেছি সে যা রান্না করে তাতেই আমি মিষ্টতার স্বাদ পায় এমনকি ব্ল‍্যাক কফিতেও"।


-আবির এই নে স‍্যুপ,,


-মা আমার পেট ভর্তি, তবুও তুমি অল্প করে দাও। পাখির দাদু কেমন আছে এখন,,


-এখন একটু ভালো আছে,,মনোরমা সন্ধ‍্যের দিকে ফোন করেছিল ওরা কালকে বাড়ি ফিরছে আর পেখমের দাদুন আর ঠাম্মাম কেও সাথে করে নিয়ে আসছে,,আমি বলেছি ওরা যেন কাল কে আমাদের বাড়িতেই দুপুরের খাবার খায়,,,কাল থেকে আবার বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে,,পেখম তোকে কালকে বাড়ি যেতে হবে না।


-সেটা বললে হয় নাকি কাকিমনি,, তুমি বরং আমাদের বাড়ি গিয়ে কয়েকদিন থাকবে চলো,,,


-আমি গেলে আবিরের কি হবে পাগলী,,


-মা তোমরা কথা বলো ,আমি উঠছি আমার কিছু মেইল চেক করতে হবে।


-আবির চলে গেলে আবার গল্পে মেতে ওঠে অনুপমা ও পেখম। আবির  উপরে উঠতে উঠতে এইসব দেখে আনমনে বলে"তাকে এবার আমার কাছেই রাখার ব‍্যবস্থা করতে হবে"।

________________________________________


-এখন গভীর রাত,প্রায় একটা বাজে,,পেখম খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে,,রাতে আর আবিরের সাথে ওর দেখা হয়নি ,অথচ মানুষটি তার পাশের ঘরেই বিচরণ করছে,,,


-পড়তে পড়তে পেখমের হঠাৎ খেয়াল হয় ভূগোলের প‍্যাক্টিক‍্যাল খাতাটা আবিরের ঘরে রয়েছে,, এবং সেটা এখুনি ওর দরকার,,, কিন্তু এত রাতে ঐ ঘরে যাওয়া ঠিক হবে কি না ভেবে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে,,তারপর আবার উঠে আবিরের ঘরের সামনে যায়,,দরজার সামনে গিয়ে ও ভাবে হয়তো ভিতর থেকে লক করে রাখা।কিন্তু দরজায় একটু হাত দিয়ে বুঝতে পারে ,দরজা খোলা আছে,হালকা করে ভেজিয়ে রাখা। তবে কি আবির দা ঘুমান নি,,এইসব ভেবে অনেক অস্বস্তি নিয়ে ঘরের ভিতরে যায়।


-ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখে মৃদু আলো টা জ্বলছে,আর আবির আধশোয়া হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে,, পেখম টেবিলের উপর থেকে ওর প‍্যাক্টিক‍্যাল খাতাটা নিয়ে বেরিয়েই যাচ্ছিলো ,কিন্তু আবার কি মনে করে ফিরে আসে,, তারপর খাতাটা রেখে এসির রিমোট টা নিয়ে তাপমাত্রা একটু কমিয়ে দিলো,,তারপর পাতলা একটা চাদর আবিরের গায়ের উপর দিতে গিয়ে দেখে মাথার বালিশটা নীচে পড়ে আছে,,, ও তাড়াতাড়ি চাদরটা গায়ে দিয়ে দিলো তারপর আবিরের মাথাটা আলতো করে তুলে বালিশ টা রাখলো,তারপর আস্তে করে শুইয়ে দিলো,,আর তখনই আবির বলে ওঠে,,


-পাখি কেন ঘুমাতে দিচ্ছিস না?? আমি তোকে বলেছি মাথার নীচে বালিশ দিতে??(চোখ না খুলেই)


-না আসলে আমি ভাবলাম আপনার সমস্যা হবে বালিশ ছাড়া শুতে,,,আপনি ঘুমান নি??


-বালিশ টা আমি ইচ্ছা করেই সরিয়ে দিয়েছি। ঘুম আজ আর আমার আসবে না,,


-কেন?? আপনার শরীর ঠিক আছে তো??


-"না আমি একদম ঠিক নেয়,,সে কি জানে না এই কয়েকদিন ,এই ঘরেতেই তার বিচরণ ছিল,,,, এই ঘরের প্রতিটি জায়গায়, জিনিসে তার শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণ বিরাজমান সর্বক্ষণ। আর সেই মাতাল করা ঘ্রাণ আমাকে ধীরে ধীরে নেশাক্ত করে তুলছে,,আমি তার সেই ঘ্রাণ নিতেই ব‍্যস্ত এখন। আজকের মত ঘুম আমার গেল"।


-পেখম আর কোনো কথা না বলে টেবিলের উপর থেকে খাতাটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো,,আর তখনই আবির পিছন থেকে বলে ওঠে,,


-"বিছানার পাশের ক‍্যাবিনেট টা একটু খুলে দেখো ,ওখানে তোমার একটা প্রিয় জিনিস আছে, যাওয়ার সময় সেটা নিয়ে যাও আর হ‍্যাঁ দরজা টা লক করে দেবে"(বলেই চাদর মুরি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো)


-পেখম আস্তে আস্তে ক‍্যাবিনেটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, সেটা খুলে যা দেখলো তাতেই ওর মুখে হাসি ফুটলো,,ক‍্যাবিনেটের মধ্যে রয়েছে দুটো কদম ফুল আর একটি বেলী ফুলের মালা।হঠাৎ সেই চিরচেনা গম্ভীর কন্ঠস্বরে কেউ বলে উঠলো,


-"আমি তার মুখে সর্বক্ষণ এই হাসিটাই দেখতে চাই। এবার নিশ্চয়ই সে আমার উপর আর অভিমান করে নেই। এবার নিশ্চয়ই তার ঐ মায়াবী চোখের জল ঝড়িয়ে সে আমার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণের কারণ হবে না"।


চলবে,,,,


0 Comments:

Post a Comment