1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১২

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে: #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট-১২


রাতের অন্ধকার পৃথিবীকে গ্রাস করে নিয়েছে। ঘন কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে ধরনীর বুক। সেই অন্ধকার থেকে বাঁচতে মানুষের কত আয়োজন। কারেন্ট নেই, ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের ভেতর বড় বড় মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। যার যার হাতে মোবাইলের আলো। সে আলো অন্ধকার কাটাতে পারছে না বরঞ্চ বিদঘুটে পরিবেশে সৃষ্টি করেছে। মেঝে কাঁদায় ভরে গেছে। লোকজন অহেতুক হাঁটাহাঁটি করছে। দু'টো বাচ্চা কাঁদছে। ফিসফিসানি। এমন পরিবেশের মধ্যে সবাই খেতে বসলো। বুড়ো মতো এক ভদ্রমহিলা সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। হাতে করে প্লেট নিয়ে গিয়ে তার কাছ গিয়ে খাবার আনতে হবে। সবাই তাই করছে। মা আমার কাছে এসে বললো,"এখন খাবি তুই? খিদে পায়নি তোর?"


"না, আমি এখানে খেতে পারবো না। বাড়ি যেতে চাই। বাবা কোথায়? বাবাকে বলো বাড়ি যাব।"


"শওকত সাহেবের সাথে আছে। দারোগা বাবুর সাথে কথা বলছে।"


"ওহ আচ্ছা। ওই ঘরে নাকি? তাহলে আমি গিয়ে বাবাকে বলে আসছি।"


"অন্ধকারে কোথাও যেতে হবে না। এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। ম'রা বাড়ি। কত মানুষ এসেছে।"


"আচ্ছা।"


মা ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। আমি একটু সরে গিয়ে দেওয়ালের পাশে দাঁড়ালাম। লোক চলাচলের পথে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। খেয়াল করলাম অল্প বয়সী একটা ছেলে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মোমের আলোয় তার মুখ বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটা স্পষ্ট গলায় বললো," তুমি ডালিয়া না?"


"হ্যাঁ। আপনি কে?"


"আমি তনিমার মামাতো ভাই। তুমি আমাকে চিনবে না।"


"ওহ!"


"তনিমার মুখে তোমার কথা অনেক শুনেছি। তোমায় দেখলে তো বোঝাই যায় না যে তুমি ক্লাস সেভেনে পড়ো!"


"তাহলে কি মনে হয়?"


"এসএসসি পরীক্ষা দিবে বা কলেজে পড়ো। বয়সের তুলনায় দেখতে বয়স্ক লাগে।"


"হবে হয়তো। অনেকদিন আয়না দেখা হয় না।"


"তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো।"


ভালো করে ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম। মুখের ওপর ছায়া পড়েছে। সে হাসছে। সরু গলায় বললাম,"আপনার আর কোন কথা আছে? না থাকলে আমাকে বিরক্ত করবেন না।"


ছেলেটা মোটেও বিব্রত হলো না। স্বাভাবিক গলায় বললো, "তুমি দেখি রেগে যাচ্ছো। আমি তো রেগে যাওয়ার কথা বলিনি।"


"না একটুও রাগছি না। আমি সবার ওপর রাগ করি না।"


"বিশেষ মানুষের ওপর রাগ করো?"


"হ্যাঁ তাই। প্লিজ আপনি এখন এখান থেকে যান। আসুন।"


ছেলেটা শব্দ করে হাসলো। হাসতে হাসতে বললো," আমার নাম শরিফুল ইসলাম। এবার কলেজে ভর্তি হয়েছি। এসএসসিতে খুব ভালো রেজাল্ট। সাইন্স থেকে জিপিএ পাঁচ। গোল্ডেন এ প্লাস!"


আমি একটু সরে দাঁড়ালাম। ছেলেটাকে আমার একটুও সুবিধার মনে হচ্ছে না। সেধে সেধে কথা বলতে আসবে কেন? আর আসলেও এতো আহ্লাদি গলায় কথা বলার কি আছে। ভেবেছিলাম শরিফুল চলে যাবে। কিন্তু সে গেল না। আমার কাছাকাছি এগিয়ে এসে বললো," তুমি এতো বিব্রত হচ্ছো কেন? কি এমন বলেছি আমি?"


"বিব্রত হওয়ার মতো কিছুই বলেননি। তবে যা বলছেন আমি তা-ও শুনতে চাচ্ছি না। দয়া করে বিরক্ত করবে না।"


সে হাসলো। অসম্ভব কোমল গলায় বললো, "বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তবে তোমার স্বচ্ছতা আমার খুব ভালো লেগেছে। ভাগ্য থাকলে আবার দেখা হবে। কথাও হতে পারে।"


বিড়বিড় করে বললাম," আর কখনও দেখা হবে না।"


শরিফুল আবারও হাসলো। ছেলেটার হাসির রোগ আছে। তরল গলায় বললো," ভাগ্যের কথা কেউ বলতে পারে না।"


বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত একটা বেজে গেল। বাবা-মায়ের ব্যাপারটা বুঝতে পারি না। এতো রাত করে ফিরতে হবে কেন? ওখানেই থেকে গেলে পারে। গা কুটকুট করছে। এখন গিয়ে গা ধুতে হবে। বাথরুমে ঢোকার আগ মুহূর্তে বাবা এলেন। কঠিন মুখে বললেন," এতো রাতে গোসল করা যাবে না। হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ো।"


মেকি হাসি দিয়ে বললাম,"হাত পা ধুয়ে কাপড় বদলে আসবো। গোসল করবো না।"


"ভালো কথা। এতো রাতে গোসল করা একদম ঠিক কাজ না। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।"


"ঠিক আছে।"


"তোমার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি। অবশ্য তেমন জরুরি কিছু না। কথাগুলো সকালেও বলা যেত।"


"কি কথা?"


"দারোগা সাহেবের সাথে আমার কথা হয়েছে। উনি বললেন ডিপার্টমেন্টের সব কর্মচারীদের ফাইল থাকে। পদ্মর ফাইল আছে কি-না খুঁজে দেখবে।"


আমার চোখ দু'টো চকচক করে উঠলো। উত্তেজিত গলায় বললাম, " এতোদিন আগের ফাইল খুঁজে পাওয়া যাবে?"


"যাবে কি-না জানি না। উনি দেখবেন বলেছেন।"


"উনি আমাদের জন্য এতো কিছু করবেন কেন?"


"মানুষকে সাহায্য করাই উনার চাকরি। সবাই তো এক রকম হয় না। পুলিশের মধ্যেও ভালো মন্দ আছে।"


"তা-ও ঠিক। কাল সকালে থানায় যাবো? উনি কি যেতে বলেছেন?"


"খুঁজে দেখতে সময় লাগবে। আমাকে জানাবে বলেছে।"


"ওহ! আচ্ছা।"


"দিলুর ওই কাথাটাও বললাম।"


"কি বললেন উনি?"


বাবা কিছু বলার আগে মা আসলো। রাগী গলায় বললো," এতো রাতে এখানে কি করছো? মেয়েটাকে ঘুমাতে দাও। কত রাত হয়েছে খেয়াল আছে?"


বাবা মাথা চুলকাতে চুলকাতে চলে গেলেন। মাঝেমধ্যে এই লোকটা একদম ভেজা বেড়ালের মতো হয়ে যায়। মা'য়ের কথার ওপর কথাই বলে না। আবার দু'জনের তুমুল ঝগড়াও হয়। 


"তোর হাতে গামছা কেন? কাপড় নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? গোসল করবি নাকি?"


"না না। হাত-মুখে পানি দেবো।"


"তাড়াতাড়ি যা। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। তনিমার মা ওদের বাড়ি যেতে বলেছে।"


ইচ্ছে হলো মা-কে বলি- এতো দৌড়াদৌড়ি না করে ওখানে থেকে গেলেই তো পারো। কিন্তু না, বলা হলো না। মা দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল। 


অনেক সময় নিয়ে গায়ে পানি ঢাললাম। বিশ্রী রকমের অস্বস্তি লাগছে। গোসল না করলে ঘুম আসবে না। ইচ্ছে করছিল ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চা খেতে। শরীরটা ঝরঝরে লাগতো। কিন্তু এখন রান্নাঘরে যাওয়া সম্ভব না। মা টের পেলে আর রক্ষা থাকবে না। ও বাড়ি থেকে আসার আগে শরিফুলের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। শেষবার আমাদের রিকশা খুঁজে দিতে এসেছিল। তার চেহারা ডাক্তার সাহেবের মতো গম্ভীর সুন্দর না হলেও মায়া ছাড়ানো। হালকা ফুর্তি ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। রিকশা ছাড়ার সময় বেশ উঁচু গলায় বললো," আমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন কিন্তু।"


মা কঠিন মুখে বললো," এমন পরিস্থিতি তুমি এ কথা বলতে পারছো?"


"লা'শটা তো তনিমার না। আমার মন বলছে তনিমার কিছু হয়নি। পুলিশেরা যে লোককে ধরেছে তাকে দেখে মনেই হয় না সে খু'ন করতে পারে।"


"তুমি কি মানুষের মন পড়তে পারো নাকি?"


"মন পড়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখা নেই। তবে আমি পারি। এই যেমন আপনি আমার ওপর অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছেন। মুখে বলতে পারছেন না।"


মা চমকে উঠলো। সে চমক আমার চোখ এড়ালো না। তার মানে ছেলেটা মিথ্যে বলেনি৷ সত্যিই মা বিরক্ত হচ্ছিল। মা'য়ের ব্যাপারে শরিফুলের ধারনা সঠিক হলেও ডাক্তার সাহেবের ব্যাপারে ঠিক হয়নি। সে হয়তো শরীরের খু'ন করতে পারে না, তবে হৃদয়ের খু'ন করতে পারে। খুব যত্ন নিয়ে আমার হৃদয়কে খু'ন করেছেন।


সকাল দশটার দিকে থা'নায় গেলাম। আমাদের সাথে মা-ও এসেছে। ক'দিন ধরে স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। তনিমার মা বাবাও থা'নায় এসেছে। আন্টির ডিএনএ-র সাথে ওই লা'শের ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে। যদি ডিএনএ মিলে যায় তখন কি হবে? শওকত সাহেব নিশ্চয়ই ওনাকে ছেড়ে দিবেন না। আন্টিকে দেখে একটুও বিচলিত মনে হচ্ছে না। একদম নিশ্চিত হয়ে আছে। 

দারোগা সাহেব বললেন, " আপনারা সবাই চলে এলেন। আসার আগে একটু বলবেন না?"


শওকত সাহেব বললেন,"ঠিকই। জানিয়ে আসা উচিত ছিল।"


"সমস্যা নেই৷ আপনাদের আমি নিজেও আসতে বলতাম। এই রিপোর্টটা খুব জরুরী। এটা হাতে পেলে পরের অ্যাকশন নিতে পারি।"


"কি পদক্ষেপ নিবেন?"


"আমার ধারণা লা'শটা তনিমার না। অন্য কারো। তেমন হলে তনিমা কোথায় আছে খুঁজে বের করতে হবে। মেয়েটা বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে।"


"আচ্ছা বেশ। দেখুন কি করা যায়। আমার মেয়েটা যে কোথায় গেল!"

বলতে বলতে উনার গলা ধরে এলো। বাবা তার হাতের ওপর হাত রাখলেন। ভরসা দিয়ে বললেন," কিছু হবে না। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। তনিমার কিছুই হয়নি।"


"আল্লাহ ভরসা।"


দারোগা সাহেব বললেন," আমার মনে হয় তনিমাকে কি'ড'ন্যা'প করা হয়েছে। সেখানে ওই মেয়েটার লা'শ রেখে দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি সদর হাসপাতালের মর্গ থেকে কম বয়সী একটা লা'শ চু'রি হয়েছে। তাছাড়া পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে মেয়েটা ডেঙ্গু জ্বরে মা'রা গেছে। স্বাভাবিক মৃ'ত্যু। তনিমার তো তেমন কোন লক্ষন ছিল না।"


শওকত সাহেব শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন। জড়ানো গলায় বললেন," আল্লাহ রে! আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেন।"


আগামী বুধবার দিলু কাকার প্রথম শুনানি। কোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে। শুনেছি নিজের পক্ষে উকিল ঠিক করেছে। বাবাও কম দৌড়াদৌড়ি করছেন না। পুলিশ নিয়ে গিয়ে সেই ওঝাকে ধরে এসেছেন। সে-ও নাকি সাক্ষ্য দেবে। খোঁজ খবর চলছে।


চলবে

No comments

Powered by Blogger.