গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১১
#পদ্মকাঁটা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট- ১১
মৃ'ত মানুষকে কেউ-ই দুনিয়ার বুকে বেশিক্ষণ রাখতে চায় না। এই রাতেই তনিমাকে দাফন করা হবে। কয়েকজন লোক বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে এনেছে। শওকত সাহেবের নিজেদের বাঁশঝাড় নেই। কিনে আনা। কেউ কেউ আবার ক'ব'রের মাটি সরাতে ব্যস্ত। কয়েকজন মহিলা তনিমাকে গোসল করিয়ে সাদা কাপড় মুড়িয়ে দিয়েছে। প্রিয় মানুষকে শেষ বিদায় জানানোর দৃশ্যটা খুব একটা সুখকর নয়! হতেও পারে না।
তনিমার লা'শ নিয়ে যাওয়ার সময় চারদিকে থেকে কান্নার রোল উঠলো। আন্টি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। ধরাধরি করে তাকে ঘরের ভেতর নিয়ে যাওয়া হলো। ইচ্ছে করছিল আন্টির পাশে গিয়ে একটু বসে থাকি, খানিকক্ষণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলি- শোনো না, আমারও মা নেই। আমাদের কষ্ট কি এক?
তেমন কিছু বলা হলো না। লা'শ ক'ব'রে রাখার আগ মুহূর্তে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। লোকজন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেছে। আমি চুপচাপ বারান্দার কোণায় দাঁড়িয়ে রইলাম। কোথায় যাব? বৃষ্টির মধ্যে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।
বাবা এসে শান্ত গলায় বললেন," তোর মা'কে ডেকে নিয়ে আয়। বাড়ি ফিরতে হবে।"
বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত একটা বাজে। তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম, গায়ে পানি ঢালবো। বৃষ্টির কারণে পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। পানির শীতলতা বরফ ছুঁইছুঁই।
সাকেরা খালা রান্না চড়িয়েছে। আজ সে খুব ভোরে চলে এসেছে৷ কি এক নতুন রান্না শিখেছে, আমরা খেলে নাকি পা'গ'ল হয়ে যাব। বাবা বারান্দায় বসে আছে, চায়ের সাথে খবরের কাগজ। বোধহয় এই কম্বিনেশনটাই তার সবচেয়ে প্রিয়। আমি তার কাছে গেলাম। নিচু গলায় বললাম," বাবা, একটু থা'নায় যেতে চাই।"
বাবা সহজ স্বরে বললেন," হ্যাঁ, আমাকেও যেতে হবে। মেহেদী ছেলেটার সাথে দেখা করা প্রয়োজন। ছেলেটা ভীষণ ভালো।"
"ভালো মানুষ হলে তাকে জে'লে নিয়ে যাবে কেন? নিশ্চয়ই কিছু খারাপ আছে।"
"পৃথিবীতে সব খারাপ মানুষই জে'লে যায় না। দুয়েকজন ভালো মানুষও জেলে থাকে।"
"আমাকে নিয়ে যাবে?"
"হ্যাঁ, তুই যেতেই পারিস। সকাল দশটার দিকে যাচ্ছি। গেলে তৈরি থাকিস।"
"আমি ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করতে যাব না।"
বাবা অবাক হয়ে বললেন,"তাহলে কার সাথে দেখা করতে যাবি?"
"দিলু কাকার সাথে!"
বাবা চমকে উঠলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, "দিলুর সঙ্গে দেখা করতে চাস কেন? লোকটাকে কি তোর ভালো লাগে?"
"না বাবা, তাকে আমার ভালো লাগে না। বরং এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঘৃ'না তার জন্য।"
"তাহলে?"
"মা'য়ের ব্যাপারে জানতে চাই। তুমি জানো মা'য়ের ব্যাপারে?"
"তেমন জানি না। কখনও কথা হয়নি। যা শুনেছি তাই।"
ধরা গলায় বললাম," নিয়ে যাবে আমাকে?"
"যাওয়া যায়। দশটার দিকে তৈরি থাকিস। তোর মা'কে বলার দরকার নেই। শুনলে কষ্ট পাবে।"
তরল গলায় বললাম," কষ্ট পাবে কেন?"
"মায়েরা সন্তানের ভাগ দিতে চায় না।"
দিলু কাকা থা'নায় নেই। তাকে জে'লে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক্তার সাহেব আছেন। শুকনো মুখে জে'লের ভেতরে বসে আছেন। উনি আমায় দেখে খুব বিব্রত হয়ে পড়লেন। মাথা নিচু করে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। আমি হাসলাম।
বাবা বেশ সময় নিয়ে ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বললেন। কোথায় কি হয়েছে জানতে চাইলেন। দারোগা সাহেব থমথমে মুখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুব বড় কোন ভুল করে ফেলেছে।
আমি গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ালাম। ধরা গলায় বললাম," আমাদের যেতে হবে।"
চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কান্না থামানোর কোন উপায়ই কি নেই? বাবা শান্ত গলায় বললেন, " কথা শেষ করি। তারপর জে'লের দিকে যাব।"
টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ চেপে ধরে মাথা নাড়লাম। আজ-কাল চোখ দু'টো খুব সমস্যা করছে। হুটহাট পানি চলে আসে।
দিলু কাকার সাথে দেখা করতে বেশ কাঠ-খড় পো'ড়া'তে হলো। দু'জনকে একসাথে সাক্ষাৎ করতে দেবে না। আবার আমাকে একাও যেতে দিবে না। শেষ পর্যন্ত বাবা অনেক বুঝিয়ে রাজি করলেন।
দু'দিনেই তার শরীর ভেঙে গেছে। চোখের নিচে কালচে দাগ। আমি দিলু কাকার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম," আমাকে মা'য়ের ব্যাপারে বলুন। আমি জানতে চাই।"
সে কোন উত্তর দিলো না। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো। বাবা বললেন," শোনো দিলু, আমরা ঝামেলা করতে আসিনি। বাচ্চা মেয়েটার সাথে তুমি যা করেছ, তা কখনও মেনে নেওয়া যায় না।"
দিলু কাকা বললো," আর কি ঝামেলা করবেন! যা করার তা তো করেই ফেলেছেন।"
"চাইলে এখনও অনেক ঝামেলা করা যায়। দীর্ঘদিন যাবত তুমি আমাদের বাড়িতে ছিলে, কাজেই তোমার ওপর চু'রির ট্যাগ লাগিয়ে দিতে তেমন সমস্যা হবে না।"
"ভয় দেখাচ্ছেন?"
"হু'ম'কি দিচ্ছি। ডালিয়া যেসব প্রশ্ন করে সেগুলোর ঠিকঠাক জবাব দাও। মেয়েটার তার মা'য়ের সম্পর্কে জানার অধিকার আছে।"
দিলু কাকা মা'কে খুব বাজে ভাষায় একটা গালাগাল দিলো। তারপর বিশ্রী ভঙ্গিতে বললো,"ডালিয়া আমার মেয়ে না। পদ্মর অ'বৈ'ধ সন্তান।"
তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, "এসব কি বাজে কথা বলছেন?"
"বাজে কথা বলবো কেন? বাজে কথা বলে আমার কি লাভ?"
" আপনার কি লাভ তা আপনি জানেন।"
" কোন লাভ নেই। তোর মা ছিল পুলিশের গোয়েন্দা। পুলিশে দেওয়ার জন্য আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করছিল। মাতারির মিথ্যে প্রেমের ঝালে ফেঁসে জীবনটা শেষ করে দিলাম।"
"আপনি মিথ্যে বলছেন।"
" ওই মাইয়া নাটক সিনেমার নায়িকাদের মতো ভাব করিস না।"
"আমি বেশিরভাগ সময় মুভি দেখে কাটাই। কাজেই আমার চরিত্রে নায়িকা নায়িকা প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক।"
" এতো ভাব নিয়ে কথা বলিস না। তেরো বছর বয়সী মেয়েকে এতো পাকনামি মানায় না।"
" তেরো বছর খুব কম বয়স নয়।"
দিলু কাকা হাসলো। গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু করে বললো," শোন, তোরে একটা কথা বলি। তোর মা সেদিন মা'রা যায়নি। আমি নিচের হাতে গলা টি'পে মে'রে ফেলেছিলাম।"
মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, "কেন মে'রেছিস আমার মা'কে?"
সে আমার কথার জবাব দিলো না। একজন পুলিশকে ডেকে বললো," এরা দু'জন আমার কেউ না। অহেতুক প্রশ্ন করে বিরক্ত করছে। ওদের বের করে দিন।"
বাবা সহজ স্বরে বললেন," বের করে দিতে হবে না। আমরা চলে যাচ্ছি।"
আমি আসতে চাচ্ছিলাম না। বাবা হাত ধরে টানতে টানতে রাস্তায় নিয়ে এলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, " দিলু তোকে রাগাতে চাইছে। তোর মা'য়ের মৃ'ত্যু হয়েছিল র'ক্তক্ষরণের কারণে। হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট করানো হয়েছিল।"
"ওহ!"
"তোর কষ্ট আমি বুঝতে পারছি মা। কিন্তু কি করার আছে?"
"কিছুই কি করার নেই? যদি ওই লোকটা সত্যি সত্যি মা'কে খু'ন করে? তাহলে তো ওর কোন শা'স্তিই হলো না।"
"এতো চিন্তা করে না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
"মিথ্যা স্বান্তনা দিও না। আমার সত্যিই কিছু ভালো লাগছে না।"
"মিথ্যা স্বান্তনা দিচ্ছি না। আমরা আবার কে'স করবো। পদ্মর খু'নের ব্যাপারে দিলু নামে মা'ম'লা করবো।"
"তেরো বছর পরে? আদো কি সম্ভব?"
"চেষ্টা করে দোষ কি?"
"তুমি আমার জন্য এতকিছু করবে?"
প্রতিত্তোরে বাবা হাসলেন। অসম্ভব কোমল হাসি। যেন তাতে এক সমুদ্র স্নেহ মেশানো।
মা রান্নাঘরে খুব ব্যস্ত। তনিমাদের বাড়িতে খাবার দেওয়া হবে। আলুদম, আম দিয়ে পাতলা ডাল আর মুরগির মাংস। সাকেরা খালা বাড়ি যেতে পারছে না। মুখ গোমড়া করে কাজ করছে। মা বললো,"এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন? কিছু লাগবে?"
"না, কিছু লাগবে না। ভালো লাগছে না।"
"বাইরে যাস না। কখন কোথা থেকে কি হয়ে যায়!"
"কি হবে?"
"তনিমাকে দেখছিস না। দিন কাল ভালো না। ঘরে থাক।"
কথাগুলো বলে মা নিজেই মিইয়ে গেল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে তরকারি বলক দেখতে লাগলো। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। মায়েরা এতো ভালো হয় কেন!
সন্ধ্যার দিকে তনিমাদের বাড়িতে গেলাম। শোকের পরিবেশ ম'রে এসেছে। কেউ আগের মতো কাঁদছে না। আন্টি সামান্য কাঁদলেও শব্দ করছেন না। রাতে খাওয়ার সময় দারোগা সাহেব এলেন। থমথমে গলায় বললেন, " পো'স্টম'র্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেছে।"
শওকত সাহেব ভাবলেশহীন গলায় বললেন," কি আছে তাতে?"
"যার লা'শ পাওয়া গেছে তার সাথে আপনার ডিএনএ মেলেনি।"
শওকত সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন, " তার মানে কি? কি বলতে চাইছেন আপনি?"
"আমার কথার দুইটা অর্থ হতে পারে। এক লা'শটা তনিমার না। আর দুই আপনি তনিমার বাবা না।"
শওকত সাহেব কাঁপতে লাগলেন। জড়ানো গলায় বললেন," এসব কি বলছেন?"
"দেখুন উত্তেজিত হবেন না। আমরা সম্ভাবনার কথা বলছি। সবকিছু তদন্ত করার পর জানা যাবে। তনিমার মায়ের ডিএনএ এর সাথে মিলিয়ে দেখা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেই সাথে অজ্ঞাত লা'শেরও খোঁজ চলবে।"
"এমন কি হতে পারে যে তনিমা বেঁচে আছে? ওর কিছু হয়নি"
" হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। ফিফটি-ফিফটি চান্স।"
শওকত সাহেব ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। ওনার চোখ জ্বলজ্বল করছে। আপন মানুষ ফিরে পাওয়ার আশাটা বোধহয় এমনই সুন্দর হয়। তনিমাকে ফিরে পেলে খুব সুবিধা হবে। ডাক্তার সাহেব জে'ল থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে। বাবার মতো আমারও মনে হয় উনি কোন দোষ করতে পারেন না। পারেন বিধায়ই কি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন? হবে হয়তো!
চলবে
No comments