1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১০

 #পদ্মকাঁটা

কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

পার্ট-১০


থালায় ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, মুখে তুলতে পারছি না। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। বাইরে থেকে নিজেকে শক্ত দেখালোও মন পো'ড়ার গন্ধে মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হয়ে আছে৷ এগুলো একান্তই ব্যক্তিগত কষ্ট! কেউ এর ভাগ নিতে আসবে না। মা আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললো," খাচ্ছিস না কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?"


"না শরীর খারাপ না। এমনিতেই কিছু ভালো লাগছে না। খেতে ইচ্ছে করছে না।"


"এক্ষুণি তো বললি ভাত দাও।"


"বলেছিলাম কিন্তু এখন সত্যিই খেতে পারছি না। জোর করো না।"


খাবার ফেলে ঘরে চলে এলাম। মায়ের দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করলো না। তাকালেই তার হতভম্ব মুখখানি দেখতে হতো। যা আমার একদম পছন্দ নয়। জীবন মাঝেমধ্যে এমন সব অদ্ভুত খেলা দেখায় যে সহ্য করা যায় না। এই তীব্র য'ন্ত্র'ণার শেষ কোথায়?


খানিকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করলাম। ঘুমাতে পারলে হয়তো সামান্য একটু শান্তি পেতাম। কিন্তু ঘুম তো আসছে না৷ নাহ! এভাবে শুয়ে থাকা যাবে না। কোনো না কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। অলস মস্তিষ্ক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গল্পের বই পড়লে কেমন হয়? মন্দ হয় না। বাবার লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিয়ে আসতে হবে।


লাইব্রেরিটা বেশ বড়। ঘরের দু'পাশে পড়ার জন্য মাঝারি সাইজের দু'টো টেবিল রাখা৷ টেবিলের ওপর একটা করে ফুলদানি, তাতে রঙিন কাগজের ফুল। এই জিনিসটা দেখলেই বোঝা যায় বাবা কতটা শৌখিন মানুষ। 


মা জানালার পাশের টেবিলে বসে কিছু একটা লিখেছে। লিখছে খুব মনযোগ দিয়ে এবং বারবার চোখ মুছচ্ছে।

আমি ধীর পায়ে হেঁটে মা'য়ের কাছে গেলাম। স্বাভাবিক গলায় বললাম," মা! আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে?"


মা আমায় জড়িয়ে ধরলো। ভেজা গলায় বললো,"কষ্ট পায় না মা। কষ্ট পায় না।"


"আমার সত্যিই কিছু ভালো লাগছে না। ম'রে যেতে ইচ্ছে করেছে।"


"বেড়াতে যাবি? চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি। নদীর পাড়ে ঘোরাঘুরি করলে ভালো লাগবে। তুই একটু অপেক্ষা কর। আমি রেডি হয়ে আসি।"


মা চলে গেল। টেবিলের উপর একটা ডাইরি রাখা। মা তাহলে ডাইরি লিখছিল। মা'য়ের হাতের লেখা খুব সুন্দর। গোটাগোটা অক্ষর, লাইনগুলোও বেশ সোজা সোজা। চেয়ারে বসে পড়লাম। মা কিসব লিখছিল। পড়ে দেখি!


'মা হিসাবে আমি বেশ অযোগ্য একজন মহিলা। পদ্মর কোল থেকে ছোট্ট ডালিয়াকে এনে নিজের কোল জুড়ালেও কখনও ওর মা হয়ে উঠতে পারিনি। মেয়েটা আমার দোষেই শেষ হয়ে গেল। মা হয়ে কখনও ঠিকঠাক খেয়াল রাখতে পারলাম না। বাচ্চা মেয়েটা দিনের পর দিন নাটক সিনেমা দেখে মস্তিষ্ক নষ্ট করে ফেলেছে। আমি কোনদিন খোঁজ নিতে যাইনি। কি দেখছে? কি করছে? কোন ধরনের সিনেমায় আসক্ত? কিছুই না! আমি আমার মতো থেকেছি। ওর বাবা সাথে ঝগড়া করেছি, সিরিয়াল দেখেছি, নিজেকে সময় দিয়েছি। সবকিছুর মাঝে আমায় মা হয়ে ওঠা হয়নি। এটা কি ব্যর্থতা না? আজ কেন যেন মনে হচ্ছে এটাই চরম ব্যর্থতা! আমি মা হতে পারলাম না। জন্ম না দিলে কি মা হওয়া যায় না? হয়তো যায়। কিন্তু আমি পারলাম না।


ডাইরিতে আরো কয়েক লাইন লেখা ছিল, পড়তে পারলাম না। তার আগে মা বললো,"কি করছিস? এদিকে আয়। বেশি দেরি করলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।"


"আসছি মা, কাপড়টা বদলে আসি।"


মা'য়ের হাত ধরে নদীর পাড়ে হাঁটছি। শান্ত নদী স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে। নদীর এই স্নিগ্ধতা আমায় স্পর্শ করতে পারছে না। 'কোন আগুনে মন পু'ড়ে'ছে' গানের এই লাইনটা মাথায় মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ধরা গলায় বললাম," না তুমি কি ডাক্তার সাহেবের চিঠি পড়েছিলে?"


মা সহজ গলায় বললো," না, মেহেদী আমায় পড়তে নিষেধ করেছিল।"


"ওহ! জানো মা, উনি খুব খারাপ মানুষ। আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ মানুষ উনি।"


মা অবাক হয়ে বললো," খারাপ হবে কেন? আমার কাছে তো ছেলেটা বেশ ভালোই মনে হলো। মেহেদী না থাকলে ওই দিলুর হাত থেকে তোকে বাঁচাতে পারতাম না।"


"দিলুর হাত থেকে বাঁচিয়ে কি লাভ হলো মা? উনি নিজেই তো আমায় একটু একটু করে মে'রে ফেলছে! এর চেয়ে দিলু কাকা মা'র'লে কষ্ট কম হতো।"


মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। হয়তো আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে। বাচ্চা মেয়ের মুখে এমন কথা মেনে নিতে পারছে না। আমিও আর কিছু বললাম না, গভীর বিষাদে চোখে পানি চলে এলো। আমার জীবনটা কি আর একটু সুন্দর হতে পারতো না?


বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। দিনের আলো ম'রে এসেছে। পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে গেছে। হাত-মুখ ধুয়ে গল্পের বই নিয়ে বসলাম। আজ-কাল গোয়েন্দা গল্প পড়তে খুব ভালো লাগে। বই পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মা এসে ডেকে তুললো। জড়ানো গলায় বললো," চল, আমাদের যেতে হবে।"


"রাত কয়টা বাজে? এখন আবার কোথায় যেতে হবে?"


"রাত বেশি হয়নি, সবে নয়টা বাজে। তনিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওকে খুঁজতে যাব।"


"তনিমাকে পাওয়া যাবে না কেন? সে আবার কোথায় গেল? মা শোনো, আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।"


"বোকার মতো কথা বলিস না ডালিয়া। তনিমার মা কল দিয়েছিল। ওরা খুব কাঁদছে, তোর বাবাকে আর আমাকে যেতে বলেছে।"


"তোমাদের যেতে বলেছে তোমরা যাও। আমাকে ঝোলাঝুলি করছো কেন?"


মা কড়া গলায় বললো," চুপচাপ রেডি হয়ে নাও। তোমার বাড়াবাড়ি অনেক সহ্য করেছি। আর না।"


কাঁদোকাঁদো মুখে মা'য়ের দিকে তাকালাম। উনি আমার  নিজের মা হলে এমন কড়া কথা বলতে পারতো? পারতো না নিশ্চয়ই!


প্রায় সারা রাত খোঁজা-খুঁজি চললো। তনিমাকে কোথাও পাওয়া গেল না। দারোগা বাবু গম্ভীর গলায় বললেন," চিন্তা করবেন না। চলে আসবে। চব্বিশ ঘন্টার আগে মিসিং কে'স নেওয়া হয় না। আপনারা অনেক করে বললেন বিধায় আসলাম।"


আমি বললাম," আমরা বললাম আর আপনি চলে এলেন? এমনটা তো আগে কখনও শুনিনি।"


"তোমার বয়সে দুনিয়ার সবকিছু শুনে ফেললে তো সমস্যা মা। তোমাদের বলায় সব পুলিশ আসতেন না। তারা চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করে তবেই কাজ শুরু করতেন। এসেছি কারণ আমারও তনিমার বয়সী একটা মেয়ে আছে। এই কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারছি।"


"ওহ! দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না।"


দারোগা সাহেব সুন্দর করে হাসলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন,"ঠিক আছে মা। তুমিও মনে কষ্ট নিও না।"


উনার হাসি আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। কারো হাসির সঙ্গে সুক্ষ্ম মিল পাওয়া যায়। কে সেই ব্যক্তি? ডাক্তার সাহেব!


পরদিন বিকালে খরব এলো তনিমার লা"শ পাওয়া গেছে। তনিমাকে খুব বাজে ভাবে হ"ত্যা করা হয়েছে। সম্পূর্ণ মুখ থেলতে দিয়েছে। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। লা"শের পাশে স্কুলকার্ড দেখে তনিমাকে শনাক্ত করা হয়েছে। বাবা থমথমে গলায় বললেন," দেশটা শেষ হয়ে গেছে৷ ফুলের মতো বাচ্চা মেয়েটাকে কিভাবে মে'রে'ছে জা'নো'য়া'ররা!"


আমি বললাম," তনিমা ফুলের মতো সুন্দর বিধায় অমন করে মা'র'তে পেরেছে, কুৎসিত হলে আর মা'র'তে পারতো না। ফুল খুব সুন্দর৷ মানুষ সেই ফুল তুলে বাজারে বিক্রি করে, খোঁপায় পরে। হাতে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে। তারপর ফেলে দেয়। সোজা কথায় ফুলের সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে আমরা তাকে ন'ষ্ট করে ফেলি।"


"ফুল আর মানুষ এক জিনিস নয় ডালিয়া। গাছে থাকলেও ফুল একসময়ে ঝরে যায়।"


আমি কঠিন মুখে বললাম," মানুষও তো এক সময় ম'রে যায় বাবা। তাই বলে কি আমরা মানুষকে মে'রে ফেলবো?"


বাবা চমকে উঠলেন। হয়তো উনি এমন কথা আশা করেননি৷ বাবা মা'য়ের সাথে তনিমাদের বাড়িতে গেলাম। ম'রাবাড়ি যেতে আমার একটুও ভালো লাগে না। কান্নাকাটি লেগেই থাকে। অন্যদের চোখে পানি দেখলে নিজের চোখেও পানি এসে যায়। তনিমার লা'শ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পো'স্ট'ম'র্টে'ম করে ফেরত দেওয়া হবে। সাথে তনিমার বাবাকেও যেতে হয়েছে। ডিএনএ-র স্যাম্পেল দিতে হবে। মেয়ে হারা বাবা কি নিদারুণ কষ্ট! 


ওদের ফিরতে বেশ রাত হলো। শওকত সাহেব পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। কারো সাথে কথা বলছেন না। আন্টি উনার কাছে ছুটে গেলেন। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন," ও গো! আমাদের মেয়ে আর নেই। আমাদের তনিমা আর নেই।"


দারোগা সাহেব থমথমে গলায় বললেন, " কাল সকালের মধ্যে রিপোর্ট চলে আসবে। ইতিমধ্যে আমরা একজনকে গ্রে'ফ'তা'রও করেছি।"


বাবা বললেন," কাকে গ্রে'ফ'তা'র করেছেন?"


"একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে। তনিমাকে শেষবার উনার সাথে কথা বলতে দেখা গেছিলো। স'ন্দে'হের ভিত্তিতে তাকেই গ্রে'ফ'তা'র করা হয়েছে। জিজ্ঞেসবাদ চলছে। বাকিটা রিপোর্ট আসলে দেখা যাবে।"


ভীতু গলায় বললাম," কোন সাইকিয়াট্রিস্ট? কি নাম উনার?"


"মেহেদী হাসান। তনিমার সাথে তার আগেও যোগাযোগ ছিল। সে কথা সে নিজেই স্বীকার করেছে। আমাদের ধারণা ধ'র্ষ'নে'র পর ঘটনা চাপা দিতে হ'ত্যা করেছে। "


স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ডাক্তার সাহেব এমন কিছু করতে পারে না। উনি কখনও এমন করতে পারে না।


চলবে

No comments

Powered by Blogger.