1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ৯

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট-৯


ডাক্তার সাহেব দু'পাতা চিঠি লিখেছেন। উনার হাতের লেখা খুব সুন্দর। অক্ষরগুলো স্পষ্ট এবং গোছানো। ছাপা হরফের মতোই। চিঠির শুরুতে সম্মোধন। উনি লিখেছেন 'প্রিয় ডালিয়া'। লেখার পর তিনটা ডট দিয়েছেন। হঠাৎ আমার কেমন অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। পানি পিপাসা পাচ্ছে, হাত পা থরথর করে কাঁপছে, হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। ছুটে গিয়ে পানি খেলাম। দূর! এক গ্লাস পানিতে কি পিপাসা মেটে, আরো কয়েক গ্লাস খাই। পরপর তিন গ্লাস পানি পান করে বিছানায় বসে পড়লাম। খুব ক্লান্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে পড়ি। মা আমার ঘরে উঁকি দিলো। শান্ত গলায় বললো," আসবো আমি?"


"আসলে আসবে। অনুমতি নেওয়ার তো কিছু নেই।"


"ভাবলাম তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।"


"না জেগেই আছি। কিছু বলবে?"


"হ্যাঁ। বলবো তো নিশ্চয়ই। তোকে একজনের ছবি দেখাতে এলাম।"


মা একটা ছবি বের করলো। ছবিতে দু'জন মহিলা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তারা খুব হাসছে। মা বললো," এই মহিলাকে চিনিস?"


"হ্যাঁ, চিনি। মা!"


"কিভাবে চিনিস?"


"দিলু কাকা দেখিয়েছিল।"


"এই ছবিটা আমার কাছে ছিল। অনেকবার তোকে দেখাতে চেয়েছি। মন সাড়া দেয়নি। ভেবেছি তুই পরের মেয়ে হয়ে যাবে। আজ আর কোন বাঁধা নেই। দেখানোই যায়!"


খানিকক্ষণ মা'য়ের মুখে দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বললাম, "মা'য়ের ব্যাপারে কিছু বলবে?"


মা ভীষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই সহজ গলায় বললো," তোর মা ছিল পুলিশের আন্ডারকভার অফিসার। কোন এক নারী পাচারকারী চক্রকে ধরতে গিয়ে দিলুর সাথে পরিচয় হয়। দিলুকে তো দেখেছিস- দেখে শুনতে খারাপ না। বেশ ভালো দেখতে। আগে আরো সুন্দর ছিল, খুব  গুছিয়ে কথা বলতে পারতো। পদ্ম তার প্রেমে পড়ে গেল। নিয়মিত যোগাযোগ হতো দু-জনের। পদ্ম নিজের কাজ ভুলে গিয়ে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো। চক্রটা যখন ধরা পড়ে তখন পদ্ম দু-মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দিলুর সাথে গোপনে বিয়ে করেছে। পদ্মর মাথায় হাত। কি করবে! শেষ পর্যন্ত অল্পের জন্য দিলুকে নারী পাচারকারী চক্রের সাথে ফেঁসে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে নেয়। সাধারণ কে'সে ছয় মাসের জে'ল হয় দিলুর। তারপর দু-জনে এখানে চলে আসে। কিন্তু জীবন তো গল্পের মতো সুন্দর হয় না। ছ'মাস জে'ল খাটার কারণে দিলুর মনে পদ্মার ওপর ক্ষোভ জমে শুরু করে। প্রায়ই দু-জনের ঝগড়া হতো। সামান্য ব্যাপার মা'রা'মা'রি পর্যন্ত চলে যেত। মাঝেমধ্যে পদ্ম বলতো- সে বেঁচে না থাকলে যেন আমি ওর সন্তানের দায়িত্ব নিই। দিলুকে আজ-কাল ভরসা করতে পারে না। লোকটা খুব খারাপ। নিজের মেয়ে বউকেও পাচার করে দিতে পারে।"


মা থামলেন। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। আমি বললাম," দিলু কাকা তখন পদ্মকাঁটা বললো কেন?"


" তোর মা'য়ের আসল নাম সৈয়দা পদ্মা। প্রথম দিকে পরিচয় গোপন রাখতে দিলুকে নিজের নাম পদ্মকাঁটা বলেছিল।"


"কি অদ্ভুত নাম!"


মা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে বললো,"দুপুরে খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। খেতে আয়।"


আমি শুধু মাথা নাড়লাম। মুখে কিছু বললাম না। ডাক্তার সাহেবের চিঠিটা বের করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম।


প্রিয় ডালিয়া,


আশা করি সুস্থ আছো। পৃথিবীর কোন অনিষ্ট তোমায় স্পর্শ করতে পারেনি। আমিও বেশ ভালো আছি বলা চলে। তবে খানিকটা অস্থির হয়ে আছি। তোমায় কিছু কথা বলার আছে। কথাগুলো খুব জরুরি। সামনাসামনি বলতে পারলে ভালো হত। কিন্তু তা সম্ভব না বিধায় চিঠি লিখতে হলো। চিঠি-ফিঠির যুগ অনেক আগেই চলে গেছে। এসব নব্বই দশকের ব্যাপার। তবুও লিখতে বেশ ভালো লাগছে। যাইহোক, তুমি তো জানো আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়া তো মুখের কথা না। এর জন্য অনেক পড়াশোনার দরকার হয়। দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে মেডিকেল এন্ট্রান্স এক্সাম দিতে হয়। সেখানে চান্স পেলে এমবিবিএস করতে হয়। আমি এসব পড়ার পর আবার সাইকিয়াট্রি স্পেশালাইজেশনের এমডি করেছি। তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো? শোনো, তোমাকে আমার পড়াশোনার ফিরিস্তি শোনাচ্ছি না। আমার বয়স কত হতে পারে তা বোঝাতে চেষ্টা করছি। আমার পড়াশোনা এক বছর আগেই শেষ হয়েছে। বর্তমানে চাকরি খুঁজছি। আব্বু বললেন-বসে থেকে কি করবি? একটা চেম্বার খোল। কিছু রোজগার হবে। বাবার কথাতেই চেম্বার খুললাম। বড় মামা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কাজেই লাইসেন্স বের করতে তেমন অসুবিধা হয়নি। দৌড়াদৌড়ি যা করার মামা নিজেই করেছেন। 

বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই আমার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি।

অন্যদিকে তুমি খুব ছোট। স্কুলে পড়ো। আমাদের বয়সের ব্যবধান কম হলেও ষোল সতেরো বছর। এতো ছোট মেয়েকে কি করে বিয়ের প্রস্তাব দিই? সমাজ এই ব্যাপারটাকে কখনোই ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না। লোকজন বলবে আমি কচি মেয়ে পেয়ে সব ভুলে গেছি৷ হয়তো তোমাকেও নানান কথা শুনতে হবে। তাছাড়া সত্যি বলতে সতেরো বছর কম কথা না। অত্যন্ত নিয়মমাফিক চলাফেরা করি বিধায় আমার চেহারায় বয়স বোঝা যায় না। নিয়ম করে একবেলা শরীরচর্চা করি। খাবার-দাবারের বিষয়ও খুব সচেতন। প্রতিদিন সকালে এক কাপ করলার শরবতও খাই। বাদাম, কিসমিস, ছোলা একসাথে ভিজিয়ে সকালের নাস্তা করি। 

তুমি মনে কষ্ট নিও না। তোমাকে যা যা বলেছি সেগুলো বলা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু কি করবো বলো? নিজের মনকে আটকাতে পারিনি। প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েও কিভাবে এমন ছেলেমানুষি করে বসলাম জানা নেই। নিজের কাছে প্রশ্ন করেছি অনেকবার। কোন উত্তর পাইনি। 

আমি হয়তো তোমাকে বোঝাতে পারছি না। চিঠির কথাগুলো খুব গুছিয়ে লেখা উচিত ছিল। আমি পারিও। কিন্তু এখন পারছি না। কেন পারছি না তা-ও এক রহস্য! 

মন খারাপ করো না। তুমি অসম্ভব রূপবতী। আমার থেকে হাজার গুন ভালো কাউকে পাবে। আমার মতো খারাপ লোকের কথায় কিছু মনে করো না। ভুল করেও কোন উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নেবে না। জীবনে চলার পথে অনেক ভুল  মানুষের সাথে পরিচয় হয়। তাদের মনে রাখতে নেই। সব ভুলে নতুন করে ভালো থাকতে চাওয়ার নাম জীবন, আর ভালো থাকতে পারটা সফলতা। 


আজ আর নয়। ভালো থাকবে সবসময়। দোয়া রইলো। পারলে আমায় মাফ করে দিও।


ইতি

মেহেদী। 


চিঠিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেললাম। লোকটাকে নিজেকে কি মনে করে? আমায় এমন চিঠি লেখার অধিকার উনায় কে দিয়েছে? আমি ছোট এজন্য আমায় ছেড়ে চলে যাবে? কম বয়সী মেয়েকে কি বিয়ে করা যায় না? মা'য়ের মুখে শুনেছি তার নানা চল্লিশ বছর বয়সে পনেরো বছরের এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কি হয়েছে তাতে? কিচ্ছু হয়নি। 


চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। জীবনে এমন কষ্টের মুহূর্ত আর কখনোই আসেনি। একবার ইচ্ছে করলো কিছু একটা খেয়ে নিজেকে শে'ষ করে দিই। কি লাভ শুধুশুধু বেঁচে থেকে? কি আছে এখানে? আলনা থেকে ওড়নাটা হাতে নিয়ে খাটের ওপর দাঁড়ালাম। ফ্যান হাতে পাচ্ছি না। বিরক্ত হয়ে চেয়ার নিয়ে এলাম। ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে মনে পড়লো মা একটা চিরকুটও দিয়েছিল। ওটা তো পড়া হয়নি। তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এলাম। চিরকুটটা মেলে ধরে পড়তে আরম্ভ করলাম-


প্রিয় ডালিয়া,


জানি চিঠি পড়ে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছ। পাওয়াই উচিত! এ বয়সে আবেগ খুব বেশি থাকে৷ একবার কোন বিষয় মাথায় ঢুকলে তা পোকার মতো জেঁকে বসে। অবশ্য তুমি খুব শক্ত মেয়ে। নিজেকে সামলানোর যোগ্যতা তোমার আছে। মনে রাখবে যে তোমাকে ছেড়ে অন্য দিকে চলে যাবে সে অত্যন্ত ফালতু লোক। সে মহা মূল্যবান হিরা ফেলে চলে গেছে। এতে তার নিজেরই ক্ষতি হয়েছে। তোমার তো কিছুই হয়নি। ফুলের বাগানের পাশ দিয়ে অনেক প্রজাপতি উড়ে যায়। ফুলের আকর্ষণে তারা ছুটে ছুটে আসে। এটাই তো স্বাভাবিক। ফুলকে কখনও প্রজাপতির পেছনে ছুটতে দেখেছো? দেখোনি নিশ্চয়ই! তুমি শুধু ফুল নও গোটা একটা ফুলের বাগান। যার সৌরভ শুধু প্রজাপতিকে নয়, মানুষকেও আকর্ষণ করে। একটা বোকা প্রজাতির জন্য মন খারাপ করাটা কি ফুলের বাগানকে শোভা পায়? নাকি মানানসই?


তুমি অসম্ভব রূপবতী। সোনার পাত্রে উজ্জ্বল মুক্তোদানা। হিরার কিরণের মতো চমক তোমার। চাঁদের আলো পর্যন্ত তোমার রূপের কাছে ফিকে হয়ে যায়। তোমার টানাটানা চোখ, জোড়া ভ্রু, ঠোঁটের ওপরের ছোট্ট কালো তিল! এই অরূপা সুন্দরী রমনীকে কি এক অযোগ্য পুরুষের জন্য কষ্ট পাওয়া মানায়? যে তার কদরই করতে পারেনি। কখনোই মানায় না! তুমি কি পঁচা এঁদো ডোবার মাঝে ফুটে থাকা কচুরিপানার ফুলের জন্য ডানা ভাঙা প্রজাপতি হতে চাও নাকি হাজার ফুলে সুরভিত বাগান হতে চাও? সিদ্ধান্ত তোমার? তুমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাও- এই সিদ্ধান্ত অন্য কাউকে নিতে দিও না। চোখ বন্ধ করে দেখ সেখানে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। আগুন ছুঁয়ে দেখ তোমার হাত ঝলসে যাবে। তুমি কি নিজেকে শেষ করে এই আগুন, এই অন্ধকারকে আপন করে নিতে চাও? নির্মল বাতাসে দাঁড়িয়ে ফুলের শোভা উপভোগ করতে চাও না? এই সুন্দর পৃথিবীর বাহারি রূপ দেখতে চাও না? রাতের আকাশে হাজার তারার মাঝে চাঁদকে কতই না সুন্দর দেখায়! জীবন তো একটাই! ভুল মানুষের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সেই জীবনকে শেষ করে দেওয়ার কোন মানে হয় না। যে তোমার ছেড়ে চলে যেতে পারে, তার কিন্তু তুমি থাকা না থাকায় কিছুই যায় আসে না। সে কখনও তোমার ক'ব'রের পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করবে না। তোমায় হারিয়ে যে তার কোন কষ্টই নেই। কষ্ট নেই বিধায়ই তো সে তোমাকে ছাড়তে পেরেছে। যে তোমায় ছাড়তে পেরেছে তুমি তাকে ছাড়তে পারবে না? এত দূর্বল তুমি?


আর কিছুই লেখা নেই। ঠাসাঠাসি করে লিখতে গিয়ে এক অক্ষর অন্য অক্ষরের গায়ের ওপর উঠে গেছে। চোখ মুছে ফেললাম। আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেব না। সত্যিই তো! ডাক্তার সাহেব আমাকে ছাড়তে পেরেছে, তাহলে আমি কেন তার জন্য কষ্ট পাবো? আমি কোন কষ্ট পাবো না। বাথরুমে গিয়ে শীতল পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে অজু করলাম। মা'য়ের কাছে গিয়ে বললাম," ভাত দাও।"


চলবে

No comments

Powered by Blogger.