1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ৮

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট -৮


ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। দরজা জানালা বন্ধ। পর্দা টেনে দেওয়া। টিনের ঘর দিনের বেলা পুরপুরি অন্ধকার করা সম্ভব না বিধায় সামান্য আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। বিছানায় উঠে বসতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। হাত পা খুব শক্ত করে বাঁধা। কাউকে ডাকবো? কিন্তু কাকে? দিলু কাকা কোথায় আছে? সে আমার এই দশা করলো নাকি? ভয়ের চোটে ঘামতে শুরু করলাম, অনেক সিনেমা দেখেছি। আমার সাথে কি তেমন কিছু হবে নাকি হয়েছে? ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে।  নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। হঠাৎ দরজার খোলার শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি দিলু কাকা দাঁড়িয়ে আছে। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে লাইট জ্বালানো। ঝলমলে গলায় বললো, " ঘুম শেষ?"


"হ্যাঁ, শেষ। আমার হাত পা বেঁধে রেখেছেন কেন?"


"বাজারে গেছিলাম মা। কিছু জিনিস কেনার ছিল, ভাবলাম তুই একা থাকবি তাই।"


"এটা কেমন যুক্তি? একা থাকবো বিধায় হাত-পা বেঁধে রাখবেন?"


" রেগে যাস না মা। ভেবেছিলাম জেগে উঠলে তুই চলে যাবি। বাপের মন তো! ভুল হয়ে গেছে মা।"


বিরক্তি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। লোকটা বলে কি? মাথায় সমস্যা নাকি! ঘুম থেকে জেগে উঠলে চলে যেতে পারি বিধায় হাত পা বেঁধে রেখে গেছে। বাচ্চা ভালানো কথা!


"এই দেখ তোর জন্য জামা নিয়ে এসেছি। গোসল সেরে এটা পরে বাইরে আয়।"


সবকিছু অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। লোকটার ভাব-গতিক সুবিধার ঠেকছে না। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম,"কয়টা বাজে এখন?"


"দশটা বাজে।"


"দশটা বাজে মানে? দশটার সময় এমন দিনের আলো থাকে নাকি?"


"সকাল দশটা বাজে। তুই কাল বিকেলে ঘুমিয়েছিস তো তাই বুঝতে পারছিস না।"


মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। এতো লম্বা সময় ঘুমিয়ে ছিলাম কেন? মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। কিসব হচ্ছে বুঝতে পারছি না। ডাক্তার সাহেবের কাছে যেতে হবে। হয়তো উনি এসবের খুব চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।


"দেরি করিস না। গোসল সেরে আয়।"


বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ালাম। ঘর টিনের হলেও পাকা বাথরুম। টাইলস বসানো। ঝর্ণার সিস্টেমও আছে৷ বরফ শীতল পানি। বেশ আরাম করে গোসল শেষ করলাম। গায়ে পানি ঢালার পর শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। 


দরজার ওপাশ থেকে দিলু কাকা বললো," গোসল শেষ হলো তোর? পরোটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।"


"হুম প্রায় শেষ। কাপড় বদলে আসছি।"


নতুন ড্রেসটা খুব বিশ্রী ধরনের। পাতলা কাপড়ের ছেঁড়া ফাড়া পোশাক। তাতে বাজে বাজে ছবি আঁকা। দেখলেই বমি আসে। মানুষের রুচি কত জঘন্য হলে এমন পোশাক কিনতে পারে! ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠলো। অন্য কোনো কাপড় সাথে আনিনি, উপায় নেই দেখে ওইটাকে পরতে হলো। ভেজা তোয়ালেটা ওড়নার মতো করে পরে নিলাম। দরজার খুলতেই দেখি দিলু কাকা দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি? লোকটা কি করতে চাইছ?


খাবারের আয়োজন ভালো। পরোটা, গরুর গোশত, ঘন ডাল। একটা প্লেটে ফল কেটে সাজানো। অপরিচিত দু'জন লোক খাটে বসে আছে৷ দিলু কাকা বললো," উনারা তোর আংকেল হয়। সালাম দে মা।"


জড়ানো গলায় বললাম," আসসালামু আলাইকুম।"


লোক দু'টো উত্তর দিলো না। পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। সেই হাসি আমার কাছে ভালো লাগলো না। বিরক্ত গলায় বললাম," আমাকে আগে ডাকলে না কেন? স্কুলে যেতে পারলাম না।"


"যাবে তো মা। সমস্যা নেই। হেড স্যারকে আমি বলে দেবো।"


"আচ্ছা ঠিক আছে।"


লোক দু'টো সমানে হেসে যাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে ওদের একজন বললো," দরদাম ঠিক হয়ে যাক। ভারত পাঠাতে ছ'লাখ নেবো। বাকি গুলো আপনি হাতে পাবেন।"


"একটা বর্ডার পার করে দিতে ছয় লাখ! একটু বেশি হয়ে গেল না।"


"আপনার মাল অতো ভালো না। বুঝতেই পারছেন।"


অবাক হয়ে বললাম, কি বিক্রি করবে আব্বা?"


দিলু কাকা হাসলো। বিশ্রী গলায় বললো," পদ্মকাঁটার কাঁটাকে বিক্রি করে দেবো। ম'রার পরও কম জ্বালায়নি।"


"কে পদ্মকাঁটা?"


"কেউ না। ওরে বেঁধে ফেলেন। মাইয়া বহুত চালাক হইছে৷ ওঝা বললো যাদু নাকি কাজ করেনি। এই মাইয়া হুঁশে আছে।"


চোখের পলকে লোক দু'টো আমার হাত-পা বেঁ'ধে ফেললো। মুখে টেপ লাগাতে লাগাতে বললো," দিনের বেলায় এসব করছি। সমস্যা হবে না তো?"


"আরে না। কিসের সমস্যা হবে! আশেপাশে বাড়িঘর নেই। তয় তাড়াতাড়ি করেন।"


ঠিক সেই মুহূর্তে মা ঘরে ঢুকলো। মা'য়ের সামনে দু'জন পুলিশ ব'ন্দু'ক তাক করে আছে। মা হাসতে হাসতে বললো," দিলু ভাই। আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, পদ্মকাঁটারা ম'রে না। মানুষ বদলে বেঁচে থাকে।"


"তুই এখানে কিভাবে? তোকে ঠিকানা দিয়েছে কে?"


মা উত্তর দিলো না। আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বললো," তুই ঠিক আছিস মা?"


মা'কে জড়িয়ে ধরলাম। কেন যেন খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে!


টেবিলের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা চেয়ারে বাবা, মা আর আমি বসেছি। সামনের চেয়ারে দারোগা সাহেব থমথমে মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওই দু'জন লোকসহ দিলু কাকাকে জে'লের ভেতর আ'ট'কে রাখা হয়েছে। প্রথম দিকে শুধু হাতকড়া পরা ছিল। বাবা বললেন," দারোগা সাহেব এমন বি'ষা'ক্ত কেউটেসাপকে বাইরে রাখবেন না। এদের নিঃশ্বাসও বি'ষ ছড়ায়।" 

দারোগা সাহেব অমত করলেন না। সোজা হা'জ'তে পুরো দিলেন। 


মা বললো," ওদের খুব কঠিন শা'স্তি দেওয়ার ব্যাবস্থা করবেন। ফাঁ'সি টাসি জাতীয়।"


দারোগা সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন," সে না হয় ব্যবস্থা করবো। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন এমন হতে পারে?"


"এই দিলু লোকটা মোটেি সুবিধার না। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বউকে নিয়ে এখানে এসেছিল। তারপর থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকতো। ভীষণ বদ কিছিমের লোক!"


"এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।"


"পদ্ম বলেছিল।"


"পদ্ম কে?"


"ডালিয়ার জন্মদাত্রী মা। মহিলা খুব চালাক ছিলেন। সাথে পুলিশের চর। কোন এক নারী পা'চা'রকারী দলকে ধরতে দিলুর সাথে পরিচয় হয়েছিল। তারপর প্রেম ভালোবাসা বিয়ে। দিলু কথা দিয়েছিল ওই পথ ছেড়ে দেবে। কিন্তু কুকুরের লেজ কি আর সোজা হয়!"


বাবা অবাক হয়ে বললেন,"এসব কথা তুমি জানলে কিভাবে?"


"পদ্ম বলেছিল। দু'জনের কত-শত গল্প হতো।"


দারোগা সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। কঠিন মুখে বললেন," দিলুকে আপনার সন্দেহ হলো কেন?"


"ডালিয়ার জন্মের পর ওর মা মা'রা যায়। আমরা ওকে দত্তক নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই দিলু বিশ লাখ টাকা দাবী করে বসলো। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উনি টাকার জোগাড় করলেন। দিলুকে টাকা দেওয়া হলো। টাকা পাওয়ার পরপরই গ্রামের বাড়ি চলে যায়। তারপর বছর চারেক কোন খোঁজ খবর ছিল না৷ চার বছর পর হঠাৎ ফিরে আসলো। হাতে পায়ে ধরে আবার মালির চাকরি নিলো।"


দারোগা সাহেবের মুখ দেখে মনে হচ্ছে উনি প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছেন। মা'য়ের পেঁচানো কথা উনার ভালো লাগছে না। বাবা তরল গলায় বললেন, " আহা! সোজা ভাবে বলো না। তোমাকে দিলুর ব্যাপারে খবর দিলো কে?"


"ডালিয়ার ডাক্তার। ওই ছেলেটাই তো আমায় কল দিয়ে বললো পুলিশ নিয়ে দিলুর ওখানে যেতে ডালিয়া বিপদে পড়েছে।"


"কোন ডাক্তার? কি নাম?"


"সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার। মেহেদী হাসান নাম।"


"লোকটা নিজেই কেন আমাদের খবর দিলো না? আপনাকে বললো কেন?"


মা হতাশ গলায় বললো, "আমি জানি না।"


দারোগা সাহেব সন্দেহের চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাবা বললেন," আমাদের এখন বাড়ি ফিরতে হবে। আপনারা তদন্ত করুন। প্রয়োজন হলে বলবেন।"


"আচ্ছা বেশ। মেহেদী ছেলেটার নম্বর আছে? কোন ঠিকানা?"


"আছে। নম্বর আছে, চেম্বারের ঠিকানা আছে।"


"সেগুলো আমাদের কাছে দিয়ে যান। ওর ব্যাপারেও খোঁজ নিতে হবে।"


মা ডাক্তার সাহেবের ঠিকানা দিলেন। সম্পূর্ণ রাস্তা কারো সাথে একটাও কথা বললাম না। কি বলবো? কথা বলার মতো মুখ আছে নাকি?


বাড়ি ফেরার পর মা বললো," হাত-মুখ ধুয়ে আমার কাছে এসো। তোমার সাথে কথা আছে।"


ভয়ে বুক কাঁপতে লাগলো। মা অবশ্য বিশেষ কিছু বললো না। ভাবলেশহীন ভাবে একটা চিঠি হাতে দিয়ে বললো," মেহেদী লিখেছি। তোমাকে দিতে বললো।"


"তুমি তাকে কোথায় পেলে?"


"কাল রাতে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। এসে বললো- দিলু নামের লোকটাকে তার ভালো লাগছে না। যদিও তুমি তাকে বলেছো উনি তোমার নিজের বাবা তবুও ওর কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। আমি বললাম- কি সন্দেহ হচ্ছে তোমার?"

মেহেদী বললো," আমি উনার সাথে কথা বলতে গেছিলাম। উনি আমার কোন কথাই শুনলেন না। ঘাড় ধরে বের করে দিলেন। বাজে ভাষায় গালাগাল দিতে দিতে বললেন-তোরে এই জায়গার ঠিকানা দিয়েছে কে?"

আমি বললাম," এতে কি প্রমাণ হয়?"

মেহেদী বললো," দেখুন। আমি উনার কাছে ডালিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে গেছিলাম। কোন বাবাই বিয়ের প্রস্তাব শুনে এমন করতে পারে না।"

"হয়তো তোমাকে তার পছন্দ হয়নি।"

"উনি আমার নাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেনি। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল খুব ভয় পেয়ে গেছেন।"

"তুমি আমায় কি করতে বলো?"

"ডালিয়া যদি কাল স্কুলে না যায়, তাহলে আপনি পুলিশ নিয়ে ওখানে যাবেন। আমার মন খুব কু ডাকছে।"


মা চুপ করলো। তার চোখেমুখে আতঙ্কে ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।


চলবে

No comments

Powered by Blogger.