1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ৭

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট -৭


রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। দিলু কাকা রিকশা ঠিক করতে গেছে। লোকটাকে বাবা, আব্বা অথবা আব্বু-এই জাতীয় কিছু বলে সম্মোধন করা উচিত। কিন্তু আমি তা করতে পারছি না। অভ্যাসের কারণেই পারছি না। বহুদিনের অভ্যাস হুট করে বদলে ফেলা যায় না। 


মিনিট দশেক দাঁড়ানোর পর একটা রিকশা পাওয়া গেল। দিলু কাকা ঝলমলে গলায় বললো," আম্মাজান উঠে আয়। এই নে তোর জন্য আইসক্রিম এনেছি।"


"আমরা কোথায় যাচ্ছি?"


"বাপ মেয়ের থাকার জন্য ছোটখাটো একটা বাসা ভাড়া করেছি। কয়েকদিন ওখানে থাকার পর গ্রামে চলে যাবো।"


"আমি স্কুলে যাব না?"


দিলু কাকা চুপ করে গেল। খানিকক্ষণ পর ইতস্তত করে বললো," আগের বাসার যাই। তারপর না হয় দেখা যাবে।"


" আজ আমার পরীক্ষা আছে। চাইলেও স্কুল কামাই করা যাবে না।"


উনি বিড়বিড় করে বললো,"ভালো ঝামেলায় পড়লাম।"


"বুঝিনি।"


"তোরে বলছি না আম্মাজান। স্কুলে যেতে কি স্কুল ড্রেস লাগবে?"


"বই, খাতা, ব্যাগ, কলম সবই লাগবে।"


" চিন্তা করিস না। আমি ও বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসবো। তুই একদম চিন্তা করিস না। বাপ থাকতে তোর কোন কষ্ট হবে না।"


ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। এভাবে হুট করে চলে আসাটা বোধহয় উচিত হলো না। মা বাবা নিশ্চয়ই মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। কাল রাতে গল্প পড়ার সময় হঠাৎ মনে হলো দিলু কাকা আমাকে বশ করে নিজের মেয়ে বানাতে চায়। আমি যদি বশিভূত হওয়ার নাটক করি তাহলে উনার পরিকল্পনা ধরতে পারবো। তারপর মা বাবাকে সব বলে দেবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানলাম আমি সত্যিই উনার মেয়ে। মা বাবা কি এই কথাটা অস্বীকার করতে পারতো না? চিৎকার করে বলতে পারতো না আমি তাদের মেয়ে? হয়তো পারতো না। পারলে নিশ্চয়ই বলতো। এভাবে চলে আসতে দিতো না।


দুই রুমের টিনের ঘর। একটা ঘরে গাবদা ধরনের জিনিসপত্রে ঠাসা। অন্যটা বেশ সুন্দর, ছিমছাম করে গোছানো। দিলু কাকা বললো," মা এইটা তোর ঘর। পছন্দ হয়েছে?"


"হুম। খুব পছন্দ হয়েছে।"


"মা'কে দেখবি? এটা তোর মা'য়ের ছবি।"


দিলু কাকা অসম্ভব সুন্দরী এক মহিলার ছবি দেখালো। তার ঠোঁটের ওপর কালো একটা তিল। অজান্তেই নিজের ঠোঁটের ওপর হাত চলে গেল। এটা তাহলে মা'য়ের কাছ থেকে পাওয়া। চোখ ভিজে উঠছে। এ জীবনে কখনও মা'কে ছুঁয়ে দেখা হবে না।


দিলু কাকা আমাকে স্কুলের সামনে ছেড়ে দিয়ে গেল। তার নাকি কাজ আছে। দেখলাম সেই কবিরাজের বাড়ির দিকে হাঁটছে। হয়তো তাকে ধন্যবাদ জানাতে যাচ্ছে। হঠাৎ কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকলো। পাশ ফিরে দেখি ডাক্তার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন৷ তিনি অত্যন্ত কোমল গলায় বললেন," স্কুলের ভেতর যাচ্ছো না কেন?"


"স্কুল শুরু হতে এখনও চল্লিশ মিনিট বাকি। আমি একটু আগে আগে চলে এসেছি।"


"একটু আগে না, বেশ আগে চলে এসেছো।"


ইতস্তত করে বললাম," আপনি এখানে কেন এসেছেন?"


"ডালিয়া খোঁজ নিতে এসেছিলাম। কাল ওদের বাসার ঠিকানা জানা হয়নি। মোবাইল নম্বর বন্ধ। তাই ভাবলাম স্কুলে আসতে পারে।"


"আপনি সব রোগীর প্রতি এমন যত্নশীল নাকি বিশেষ বিশেষ রোগীর প্রতি?"


"কেন বলো তো?"


"কিছু না, এমনি জানতে চাইলাম। আমার বেলায় তো খোঁজ নেননি তাই।"


ডাক্তার সাহেব হাসলেন। মৃদু গলায় বললেন," আমার সাথে এক কাপ কফি খাওয়া যাবে? যদিও স্কুলের বাচ্চাকে এমন প্রস্তাব দেওয়া মানানসই না। তবুও বললাম।"


"আমি মোটেও বাচ্চা মেয়ে নই।"


"রাজি থাকলে ওই ক্যাফেতে গিয়ে বসতে পারি?"


"চলুন।"


ডাক্তার সাহেব কোণার দিকের একটা টেবিলে বসলেন। ওয়েটার ছেলেকে ডেকে কফি অর্ডার দিলেন। সহজ গলায় বললেন, " বসো। এতো ভয় পাচ্ছো কেন?"


চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম," আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না।"


অথচ খেয়াল করলাম আমার গলা কাঁপছে। ডাক্তার সাহেব বললেন," দেখো, তোমাকে এসব কথা বলা মানায় না। বয়স হিসাবে তুমি খুব ছোট।"


 তীক্ষ্ণ গলায় বললাম," আমি একদম বাচ্চা না। বারবার বয়স নিয়ে কথা বলা বন্ধ করুন।"


"হ্যাঁ, তুমি বাচ্চা না। তোমার চিন্তা ভাবনা বড়দের মতোই। নানান রকম নাটক সিনেমা দেখার কারণে প্রেম নামক জিনিসটা তোমার মস্তিষ্কের আশি ভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে।"


"কিসব বাজে কথা বলছেন?"


"আমি কি সত্যি বাজে কথা বলছি? তুমি আমায় নিয়ে কিছুই ভাবোনি?"


"না। আপনাকে নিয়ে কি ভাববো?"


উনি একটু মিইয়ে গেলেন। উঠে দাঁড়িয়ে চশমা ঠিক করতে করতে বললেন," তাহলে হয়তো আমি ভুল বুঝেছি। যাইহোক দুঃখিত। তুমি কিছু মনে করো না। আমার খুব দরকারী একটা কাজ আছে। এখনই মনে পড়লো। তুমি বসে কফি খাও। লাগলে অন্য কিছুও খেতে পারো। আমি বিল দিয়ে যাচ্ছি।"


"আপনি এমন ছটফট করছেন কেন? শান্ত হয়ে বসুন।"


উনি বসে পড়লেন। কঠিন মুখে বললেন," 'প্রথম দেখায় ভালোবাসা' এ জাতীয় কথায় আমি একদমই বিশ্বাস করি না। এতো বছরের জীবনে কোন মেয়েকেই প্রথম দেখায় পছন্দ করতে পারিনি। ভালো লাগেনি। কিন্তু সেদিন প্রথম তোমায় দেখলাম যার সবকিছু আমার ভালো লাগলো। ভাবলাম সাহিত্যের এই৷ কথাটা মিথ্যে না। আগ বাড়িয়ে বাসার ঠিকানা রেখে দিলাম। মেয়েদের পিছনে ঘোরা আমার স্বভাব না। তবুও তোমার স্কুল খুঁজে বের করেছি। অবশ্য এর অন্য একটা কারণ ছিল।"


"কি কারণ ছিল?"


"সেদিন তনিমার সাথে আমার ওভাবে কথা বলা তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছে। তুমি স্বীকার করো না না-ই করো। এটা সত্যি। তুমি চাইলেই তোমার সব অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তোমার বয়স খুব অল্প। প্রচুর নাটক সিনেমা দেখো। কারো থেকে সামান্য আঘাতে খুব বড় ভুল করে ফেলা অসম্ভব কিছু না।"


"আপনি কি ম'রে যাওয়ার কথা বলছেন?"


"হ্যাঁ, ওই ধরনেরই। তুমি ভাবতে পারো আমি তনিমা পছন্দ করেছি বা কিছু, সেই ভুলটা ভাঙার জন্যই তোমার খোঁজ করেছি।"


"আমি জায়গায় অন্যকেউ থাকলেও কি একই কাজ করতেন?"


"হয়তো করতাম না। তাদের প্রতি আমার অনুভূতি কেমন হতো জানা নেই। আবার করতেও পারি। সঠিক বলতে পারছি না।"


আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে। কেন পড়ছে জানি না। শত চেষ্টা করেও আটকাতে পারছি না। উনি হাত বাড়িয়ে আমার গাল স্পর্শ করতে গেলেন কিন্তু করলেন না। হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন," তোমায় কি খুব কষ্ট দিয়ে ফেললাম? বিশ্বাস করো আমি কষ্ট দিতে চাইনি।"


আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম, "আমার জীবনের অনেক বড় একটা সত্যি আছে। আপনি জানলে আর কখনও আমায় এসব বলবেন না।"


"কি সত্যি? আমি কি জানতে পারি?"


"সেদিন যার সাথে আপনার ওখানে গিয়েছিলাম সে আমার আসল বাবা না। আমি সাধারণ একজন মালির মেয়ে।"


"বাবা কখনও আসল নকল হয় না। বাবা নামক শব্দটা খুব ভারী। সবাই এী বোঝা বইতে পারে না। এই যে রাস্তায় রাস্তায় এতিম ছেলে-মেয়েগুলো ঘুরে বেড়ায়। ওদেরও তো কেউ না কেউ জন্ম দিয়েছে। রাস্তার ঘুরে বেড়ানো পাগল মেয়েদেরও সন্তান হয়। তারা মা হয় কিন্তু কেউ বাবা হয় না।"


"বলার সময় অনেক বড় কথা বলা যায়। কিন্তু মেনে নেওয়া খুব কঠিন। আপনি কি আগের দিনের মতো করে আমায় বিয়ে প্রস্তাব দিবেন? আমি জানি দিবেন না।"


আমি উঠে দাঁড়ালাম। এই পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়লে চলবে না। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি করবো?


"তোমার বাড়ির ঠিকানা কি? এখন কোথায় থাকছো?"


"সোনাতলার ওখানে টিনের ভাড়া বাসায়। দিলু নামে খোঁজ নিলে দেখিয়ে দেবে।"


"আচ্ছা। ঠিক আছে৷ তুমি যাও। তোমার স্কুলের দেরি হয়ে যাব।"


আমি কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলাম। সবকিছু মিলিয়ে মাথায় কাজ করছে না। একটা ক্লাসেও মনযোগ দিতে পারলাম না। স্কুল শেষে দিলু কাকা আমায় বাসার নিয়ে এলো। এক গ্লাস দুধ হাতে দিয়ে বললো," সারাদিন স্কুল করে ক্লান্ত হয়ে গেছিস। এই দুধটুকু খেয়ে নে।"


অনিচ্ছা শর্তেও দুধটুকু খেয়ে নিলাম। শরীরটা একটুও ভালো লাগছে না। মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছে৷ এতদিনের ভালোবাসার প্রতিদান হিসাবে এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত হয়নি।


"কি ভাবছিস?"


"কিছু ভাবছি না। মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে।"


"ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। সারাদিন স্কুল করে ক্লান্ত হয়ে গেছিস।"


দরজার সামনে ডাক্তার সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। দিলু কাকা উনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, আপনি কে? এখানে কি চান?"


"জ্বি, আমি ডালিয়ার ডাক্তার। ওর খোঁজ নিতে এসেছি।"


দিলু কাকা অনিচ্ছা শর্তেও উনাকে ভেতরে আসতে দিলো। একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে বললো," ডালিয়া তুই ভেতরে যা। আমি দেখছি উনি কি বলে।"


এলোমেলো পায়ে ঘরের ভেতর চলে এলাম। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। মাথার ভেতর কেমন যেন চক্কর দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। শেষবার জ্ঞান হারানোর আগে শুনলাম ডাক্তার সাহেব দিলু কাকাকে বলছেন," আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।"


ঠিক শুনলাম নাকি ভুল জানি না। তবে মনটা আনন্দে ভরে গেল। উনি এই বাড়ি পর্যন্ত চলে আসবেন ভাবতে পারিনি।


চোখ খুললো অন্ধকার ঘরে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। হাত পা বাঁধা। কোথায় আছি আমি? 


চলবে

No comments

Powered by Blogger.