1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ৬

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট -৬


ডাক্তার সাহেবকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মেরুন রঙের একটা হাফ শার্ট পরেছেন। উঁচু করে চুল আঁচড়ানো, ডান হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। আমার কেমন লজ্জা লাগতে শুরু করলো। উনার দিকে তাকাতে পারছি না। ডাক্তার সাহেব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তনিমার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। আমি আড়ষ্ট হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে তনিমার সাথে কথা বলছেন। যেমনটা আমার সাথে বলেছিলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে একটুও ভালো লাগলো না। কষ্টে দম আটকে যাবার অবস্থা। মানুষটা এতো খারাপ কেন! আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।


ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে আন্টি বললেন," ডালিয়া ওভাবে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?"


ধরা গলায় বললাম," এমনি। এখানে দু'টো চেয়ার রাখা। আমার বসার জায়গা নেই।"


"তাহলে বাইরে গিয়ে বসতে পারিস। দেখলাম ওখানে বসার ব্যসস্থা আছে।"


আমি একটুও নড়লাম না। জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ডাক্তার সাহেব অসম্ভব কোলম গলায় বললেন," আপনাদের আর কিছু বলার না থাকলে আসতে পারেন। ডালিয়া তুমি একটু দাঁড়াও। তোমার সাথে কথা আছে।'


আমি কেঁপে উঠলাম। আমার সাথে কথা আছে মানে? কি কথা আছে? আন্টিও বেশ অবাক হলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, " ওর সঙ্গে কি কথা আছে?"


" ওর সমস্যার ব্যাপারে কথা বলবো। আপনারা থাকলে বলতে পারবে না কাল নিজের বাবার সামনেও বলতে পারেনি।"


আন্টি মাথা দোলালেন। তার চোখ-মুখে বিরক্তি ছাপ স্পষ্ট।


"এখন চেয়ার ফাঁকা আছে। তুমি বসতে পারো।"


"কি বলবেন আমাকে?"


"দেখ ডালিয়া, তোমার বয়সে এমন আবেগ থাকা খুব স্বাভাবিক। তারপর থেকে তুমি অনেক নাটক সিনেমা দেখো। তোমার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা উচিত।"


"কি বলতে চাইছেন আপনি?"


"তুমি কি বুঝতে পারছো না?"


"না পারছি না। একটুও বুঝতে পারছি না। আমি তনিমাকে এখানে নিয়ে এসেছি কারণ আমার মতো তনিমাও খারাপ স্বপ্ন দেখছে। এখানে আবেগ নিয়ন্ত্রণে কথা আসছে কোথা থেকে?"


উনি সহজ গলায় বললেন," তুমি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছ। কিন্তু তা তুমি স্বীকার করতে চাইছো না।"


"একদম না, একটুও না। আপনি বাজে কথা বলছেন। আমি আপনাকে পছন্দ করি না। প্রচন্ড রকমের অপছন্দ করি।"


"কথাটা বাজে হলে আমার কোন সমস্যা নেই। তবে তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। মনের ডাক্তার।"


ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে রইলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যি স্বীকার করার মতো কঠিন কাজ আর নেই।


"আমি যদি তোমার বাবাকে বিয়ে প্রস্তাব দিই। উনি কি মেনে নিবেন?"


"জানি না। মনে হয় মানবেন না। আমি খুব ছোট।"


"যেদিন মেনে নিবে, সেদিনই তোমার বাবার কাছে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেবো।"


"আপনি কিভাবে বুঝবেন বাবা কবে মেনে নিবে?"


"তুমি বলে দেবে। নাকি বলবে না?"


"হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বলে দেবো।"


ডাক্তার সাহেব অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তার মুখ হাসিহাসি। চোর ধরতে পারলে মানুষ এমন করে হাসে। এই ডাক্তার বিরাট ঘুঘু লোক। দুই কথায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ক্ষীণ গলায় বললাম," ভালো থাকবেন।"


সারাপথ তনিমাদের সাথে কোন কথা বললাম না। টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ চেপে ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটুও ভালো লাগছে না। কিচ্ছু না!


বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো রাতে। ততক্ষণে চারদিক গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে। দু'দিন ধরে মা বাবার মধ্যে ঝগড়াঝাটি হচ্ছে না। তারা নিজেদের মধ্যে হাসিখুশি আছে। বাবা সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরছেন। হাতে করে নানা পদের খাবার নিয়ে আসছেন। এমনিতে বাবা খুব শৌখিন মানুষ। নিজস্ব লাইব্রেরি আছে। একসময় পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। এখন অবশ্য তেমন পড়েন না। 


বাবার লাইব্রেরিতে গিয়ে একটা বই নিয়ে এলাম। গোয়েন্দা গল্প। অদ্ভুত সুন্দর নাম বইটার 'চাদরে জড়ানো চিরকুট'।

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম। গল্প শেষ না করে ঘুমানো যাচ্ছে না। 


সকালে ঘুম ভাঙলো দেরিতে। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে দিলু কাকার ঘরে গেলাম। অস্পষ্ট গলায় বললাম," আব্বা, আমি ফিরে এসেছি।"


দিলু কাকা বিছানায় শুয়ে মোবাইল দেখছিল। আমায় গলায় বাবা ডাক শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলো। হড়বড় করে বললো," আম্মাজান আমায় চিনতে পারছেন?"


"হ্যাঁ আব্বা। আমি তোমাকে চিনতে পারছি। তুমি ওদের গিয়ে বলো আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।"


দিলু কাকা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমিও উনার পিছন পিছন গেলাম। বাবা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। দিলু কাকা তার কাছে গিয়ে বললো," ভাইজান, আমার মেয়ে আমাকে চিনতে পারছে। সে আমার সাথে থাকতে চায়।"


বাবা চমকে উঠলেন। উত্তেজিত গলায় বললেন, " কে তোর মেয়ে? কে তোর সাথে থাকতে চায়?"


"ডালিয়া। আজ সকালেই বলেছে। জিজ্ঞেস করে দেখেন।"


বাবা অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। চিৎকার করে বললেন," ওকে কে বলছে তুই ওর বাবা? তুই বলেছিস? ভালো করে শুনে রাখ, তুই ওর কিছু না। শ্রেফ কিছু না।"


" আমি কিছু বলিনি ভাইজান। সবই রক্তের টান।"


বাবার চিৎকার শুনে মা দৌড়ে এলো। ভীতু গলায় বললো, " কি হয়েছে? তুমি চিৎকার করছ কেন?"


"দিলু বলছে ডালিয়া নাকি ওর মেয়ে, ওর সাথে থাকতে চায়।"


"কেন বলেছে? দিলু এমন বলবে কেন? দিলু ভাই আপনি এসব কথা বলছেন কেন?"


"যা সত্য তাই বলছি। সত্য কি কখনও চাপা থাকে?"


বাবা এক ছো'ব'লে দিলু কাকার কলার চেপে ধরলেন। রাগী গলায় বললেন, "ডালিয়া তোর মেয়ে না। মনে করে দেখ তুই ওকে বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলি৷ ওকে আমরা দত্তক নিয়ে ছিলাম। আমার কাছে সব ডকুমেন্টস আছে। তুই আমার মেয়েকে আমার থেকে নিতে পারবি না। কখনোই না।"


আমি হতভম্ভ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। তার মানে সত্যিই আমি দিলু কাকার মেয়ে। বাবা-মা আমায় দত্তক নিয়ে ছিলেন। শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। মা দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো। কোমল গলায় বললো, "চল মা, ঘরের ভেতর চল।"


"না, আমি যাব না। আমি তোমাদের সাথে থাকবো না। আমি আমার বাবার কাছে থাকবো।"


বাবা শান্ত গলায় বললেন," বোকামি করো না।"


দিলু কাকা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। বললো, " হ্যাঁ মা। তুমি আমার কাছেই থাকবে। আমি তোমার গ্রামে নিয়ে যাব। তোমার মা'য়ের কবর দেখিয়ে নিয়ে আসবো।"


বাবা দিলু কাকাকে মা'র'তে এলেন। বি'শ্রী ভাষায় গা'লি'গা'লা'জ করতে করতে বললেন," জা'নো'য়া'র কোথাকার! তোকে শে'ষ করে ফে'লবো।"


মা অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করলেন।


বাবা সোফায় বসে আছেন। তার চোখ রক্তের মতো লাল হয়ে গেছে। আমি শান্ত গলায় বললাম, " বাবা, আমাকে সবটা সত্যি সত্যি বলো। তুমি না আমায় নিজের মেয়ে ভাবো? তাহলে বলো। বলো না প্লিজ!"


বাবা খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন। ধরা গলায় বললেন," সত্যিই তুমি আমার মেয়ে না। আমরা তোমকে জন্ম দিইনি। দিলু তোমার জন্ম দাতা পিতা।"


মা বাবাকে চুপ করাতে চাইছে। বাবা মা'য়ের হাত সরিয়ে দিলেন। সহজ গলায় বললেন," আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বউকে নিয়ে দিলু এই শহরে আসে। থাকার জায়গা নেই। দু'দিন খান জাহান আলীর মাজারে রাত কাটায়। তৃতীয় দিন আমার সাথে দেখা হয়। ওদের সমস্যার কথা বলে। আমি তাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। দিলুকে মালির চাকরি দিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিই। এতে মানবতার চেয়ে নিজের লাভটাই বেশি ছিল। আমার স্ত্রীও সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এতো বড় বাড়িতে একা থাকে। একজন সঙ্গী পেলে মন্দ কি!"


এতটুকু বলার পর বাবা থামলেন। শার্টের হাতায় চোখ মুছে বললেন," যথাসময়ে দিলুর স্ত্রী পেইন শুরু হলো। তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। দৌড়াদৌড়িতে আমার স্ত্রী সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল। তাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। তবে শেষ রক্ষা হলো না। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই আমাদের বাচ্চাটা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। দোষটা আমারই! আমিই ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম। বাড়িতে একা রাখতে চাইনি। তোমায় জন্ম দেওয়ার আট ঘন্টা পরে তোমার মা মা'রা যায়। সন্তান হারিয়ে আমার স্ত্রীর অবস্থাও খুব করুণ। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। পরিস্থিতি বিচার করে এই দিলুর থেকে বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে তোমাকে দত্তক নিলাম। সেসবের কাগজপত্রও আছে। এখন চাইলেই তুমি নিজের বাবার কাছে ফেরত যেতে পারবে না।"


দিলু কাকা খেঁকিয়ে উঠলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো, "বাজে কথা বলবেন না। আমি কোন টাকা-পয়সা নিছিলাম না। আপনি জোর করে আমার মেয়েকে কেঁড়ে নিয়েছিলেন। ডালিয়া মা, তুই এই লোকটার কথা বিশ্বাস করিস না।"


বাবা হাসলেন। মা'য়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,"কাগজপত্রগুলো নিয়ে এসো। সত্যি মিথ্যা প্রমাণ হয়ে যাক।"


মা অনেক খুঁজেও কোন কাগজ বের করতে পারলো না৷ আমি বললাম," তোমরা কোন কাগজ বের করতে পারলে না৷ তার মানে তোমরা মিথ্যা বলছো। আর আব্বা সত্যি কথা বলছে। আমি এই মুহুর্তে তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যাব। মিথ্যেবাদীরা আমার কেউ হতে পারে না।"


বাবা এলোমেলো হয়ে সোফায় বসে রইলেন। তার মুখ ভাবলেশহীন। যেন জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পর্যন্ত নেই। মা কান্না জড়ানো গলায় বললো," ওগো! তোমার মেয়ে এসব কি বলছে? ওকে বুঝাও না। ডালিয়া মা, আমার কথা শোন। উনি তোর বাবা না হলেও আমি তোর মা। আপন মা না হই দুধ মা। আড়াই বছর বুকের দুধ খাইয়ে তোকে বড় করেছি৷ তোর জন্য বছরের পর পর রাত জেগেছি। আমি তোর মা, আমাকে ছেড়ে কোথাও যাস না।"


মা'য়ের আকুতি-মিনতি আমার মন গলাতে পারলো না। দিলু কাকার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি কানে আসছে। মা খুব কাঁদছে। কাঁদলে কাঁদছে! তাতে আমার কি! মিথ্যাবাদীরা আমার কেউ হতে পারে না। একি! আমার চোখে পানি আসছে কেন? অদ্ভুত যন্ত্রণা হলো তো!


চলবে

No comments

Powered by Blogger.