গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ৫
#পদ্মকাঁটা
কলমে :#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-৫
লোকে বলে দিলু কাকার সাথে আমার চেহারার খুব মিল। একদম বাপ মেয়ের মতো! তবে কি? আমার খুব দূর্বল লাগছে। মাথায় কাজ করছে না। হাত পা কাঁপছে, সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। ঘুমের তেষ্টা ভীষণ তীব্র! ইচ্ছে করছে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ি।
"এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তুই তো কাঁপছিস!"
"সরে যাও। তুমি আমার মা না। দূরে থাকো আমার থেকে।"
মা চমকে উঠলো। আমার বাহু ধরে বললো," এসব কি বলছিস তুই? মাথা ঠিক আছে তোর?"
মায়ের দিকে তাকালাম। সুন্দর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ, ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে মা'য়ের মুখটা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বোধহয় জ্ঞান হারাচ্ছি। ছোট্ট মস্তিষ্ক আর কত চাপ সইতে পারে!
ঘরে আলো নেই বললেই চলে। জানালার পর্দা টানা, দরজা ভেজানো। আবছা অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে আছি। মা বাবা দু'জনেই এ ঘরে বসা। তাদের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। মা ভীতু গলায় বলছে," দিলু কি ওকে সব বলে দিলো নাকি?"
বাবা বললেন," না না, দিলু বলবে কেন? ওকে তো সব বলাই আছে।"
"তবুও আমার খুব ভয় হচ্ছে। ডালিয়া তখন বললো আমি ওর মা না। ওর থেকে দূরে থাকতে বললো। আমার কিন্তু কিছু ভালো লাগছে না।"
"আহা, চুপ করো না।"
মা চুপ হয়ে গেল। কারো সাহায্য ছাড়া আমার একার পক্ষে এই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব না। কিন্তু কে আমায় সাহায্য করবে? ডাক্তার সাহেব?
হুট করে এক অপরিচিত মানুষের সাহায্য কামনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা আমার জানা নেই। তবে উনার কথাটা প্রথমে মনে আসলো। ইচ্ছে করে ভাবিনি, হুট করে চলে এসেছে।
ডাক্তার সাহেবের চেম্বার চিনে যেতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু উনি কি আমায় সাহায্য করতে চাইবেন? চাইবেন না বোধহয়।
দিলু কাকা আজ আমায় স্কুলে নামিয়ে দিতে গেছিল। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে বললো," আম্মাজান আপনি ভেতরে চলে যান। ছুটির সময় নিতে আসবো।"
আমি ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়লাম। গেট থেকে খানিকটা সরে গিয়ে তেঁতুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দিলু কাকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে ডানে বামে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলো। এদিকে তো বাড়ির পথ না। কোথায় যাচ্ছে? আমাকে দেখতে হবে।
আজ তনিমাদের বাড়িতে সাঁতার কাটতে যাওয়ার কথা। তনিমা স্কুলে আসবে না। দু'জন মিলে খুব মজা করবো। ব্যাগে একটা জামাও আছে। এক দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলাম। স্কুল ড্রেস বদলে জামাটা পরে নিলাম। চুলগুলো এলোমেলো করে মুখে মাস্ক পরলাম। একটুখানি ধূলোবালি গায়ে মাখিয়ে নিলাম। আমায় বোধহয় চেনা যাচ্ছে না। স্কুলের দারোয়ানটাও চিনতে পারলো না। হ্যাঠ হ্যাঠ বলে ভাগিয়ে দিলো।
দিলু কাকা অনেক দূরে চলে গেছে বোধহয়। এতক্ষণে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা। না যায়নি। রাস্তার ওপাশের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। এখন কি বাড়ি ফিরে যাবে নাকি? ধূর ভালো লাগে না!
মধ্যে বয়স্ক এক ভদ্রমহিলা বাজারের ব্যাগ তুলতে হিমশিম খাচ্ছে। তার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, " ব্যাগটা আমার কাছে দিবেন? আপনি তো পারছেন না।"
মহিলা আমার দিকে তাকালেন। তাকানোর ধরনটা খুবই সুন্দর। কেমন মায়া কাড়া! কোমল গলায় বললেন," তুমি তুলে পারবে?"
আমি মাথা নাড়লাম। চাপা গলায় বললাম," পারবো। আপনি রিকশা ঠিক করেন।"
মহিলা অপ্রস্তুত ভঙিতে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। মৃদু গলায় বললেন," রিকশায় যাওয়ার টাকা নেই। বাড়ি থেকে আসার সময় টাকা আনতে মনে নেই। তুমি বরং ব্যাগটা রেখে যাও। আমি যেতে পারবো।"
"কতদূর যাবেন?"
"এইতো সামনেই ধনেশ কবিরাজের বাড়ি।"
"কবিরাজ কি কাজ করে?"
"বোকা মেয়ে! কবিরাজ কি কাজ করে জানো না? গাছ গাছড়ার ওষুধ দেয়। উনি অবশ্য কবিরাজ না। ওঝাগিরি করে। জ্বিন পরী ছাড়ায়, যাদু টোনা করে। "
আমার চোখ চকচক করে উঠলো। দিলু কাকা নিশ্চয়ই এই কবিরাজের কাছে যাবে। চায়ের দোকান ছেড়ে রাস্তায় নেমে গেছে৷ উত্তরের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। আমি বললাম," চলেন। আমি আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।"
"তোমার মা বাবা কিছু বলবে না?"
"না, মা বাবা কাজে গেছে। ওরা আসার আগেই ফিরে আসবো। আপনি একা একা পারবেন না।"
মহিলা ইতস্তত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। এছাড়া উনার কোন উপায়ও নেই৷ বাচ্চা নিয়ে ব্যাগ সামলাতে পারছে না।
"কবিরাজ বাড়িতে গিয়ে কি করবেন? বাবুটা কি অসুস্থ?"
"না মা, বাবু সুস্থ আছে। আমি উনার বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। আজ উঠবো।"
"ওহ আচ্ছা। চলেন। কতদূর আর?"
"বেশি না, সামনেই।"
মাঝেমধ্যে ভাগ্য খুব সহায় থাকে। আজ আমার ভাগ্য আমার সহায় আছে। দিলু কাকা দু'বার পেছনে ফিরে তাকালেও আমার দিকে তেমন একটা খেয়াল করেনি। তার ধারণাই নেই যে আমি তার পিছু করতে পারি। একা থাকলে হয়তো কিছুটা সন্দেহ করতো কিন্তু এখন তো একজনের সাথে আছি।
কবিরাজের বাড়িতে কেমন অদ্ভুত গন্ধ। দিলু কাকা আমাদের আগে বাড়ির ভেতর ঢুকলো।
মহিলা আমাকে খুব যত্ন করে বসালেন। ঘরে শুকনো খাবার যা ছিল আমার সামনে সাজিয়ে দিলেন। আদুরে গলায় বললেন," তুমি না থাকলে আসতেই পারতাম না। ক'দিন হলো বাড়ি পাল্টেছি। কিছু জিনিসপত্র আনার ছিল।
"আমার না কবিরাজি কাজকর্ম দেখার খুব শখ। কবিরাজ কোথায় বসে? আমাকে একটু দেখাবেন?"
"আগে বিস্কুটগুলো খেয়ে নাও। তারপর নিয়ে যাচ্ছি। বড় ঘরের এক পাশে ওনার বসার জায়গা। অন্যপাশে আমাদের রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, একটা কথাও বলবে না। উনি শুনলে রাগ করবেন।"
আমি মাথা নাড়লাম। দুইটা বিস্কুট হাতে গিয়ে বললাম, নিয়ে চলেন না!"
মহিলা বিড়ালের মতো হেঁটে রান্নাঘরে গেলেন। নিচু গলায় বললেন," এই ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখো। বেশিক্ষণ দেখবে না কেমন। আমি একটু আসছি।"
আমি মাথা নাড়লাম। কবিরাজের সামনে দিলু কাকা বসে আছে। কোন কথা বলছে না। বললেও খুব ক্ষীণ গলায় বলছে। সে শব্দ কানে আসে না, বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
"তোর কাজ হচ্ছে? মেয়েটার মাঝে পরিবর্তন পাচ্ছিস কিছু?"
দিলু কাকা মাথা নাড়লো। সে কোন পরিবর্তন পাচ্ছে না।
"যা যা করতে বলেছিলাম ঠিকঠাক করেছিস তো?
" করেছি। আপনার দেওয়া ছায়াছবিগুলো ওকে দেখিয়েছি। খাবার পানিতে ছালের গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়েছি। আগুনের গল্পও শুনিয়েছি। লাভ হয়নি।"
"এতো উতলা হলে কি চলে? এসব কাজ ধীরে ধীরে করতে হয়।"
"কত ধীরে করতে হবে? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আমার মেয়েকে ফেরত চাই।"
"একটা কথা বল বেটা। মেয়ে ফেরত চাইলে তো পুলিশের সাহায্য নিতে পারতি, আমার কাছে আসলি কেন?"
দিলু কাকা মাথা নাড়লো। ঠিক তখনই মহিলাটা এসে বললেন," আর দেখতে হবে না। এসো তোমাকে রিকশায় তুলে দিচ্ছি।"
অগত্যা উনার সাথে চলে এলাম। মহিলা স্কুল পর্যন্ত রিকশা ঠিক করে ভাড়া দিয়ে দিলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, " তোমাদের মতো মেয়েরা আছে বলেই এখনও পৃথিবী টিকে আছে। ভালো থাকবে সবসময়।"
আমি মাথা নাড়লাম। মন খারাপ হয়ে গেছে। সব কথা শুনতে পারলাম না। বাস্তব জীবন আর সিনেমার বুঝি এটাই পার্থক্য। সিনেমার নায়িকারা সবকিছু শুনে ফেলে, সব কাজ করে ফেলে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। আসার আগে স্কুল গেটের কাছে ব্যাগ লুকিয়ে রেখে এসেছিলাম। ফুলের ঝোপের আড়ালে কারোর নজর পড়ার কথা না। ব্যাগ নিয়ে তনিমাদের বাড়ি চলে গেলাম।
তনিমা বিছানায় শুয়ে আছে। আন্টি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি বললাম, " এ তনিমা! তোর কি হয়েছে?"
তনিমা কিছু বললো না। আন্টি বললেন," রাতে খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছে। এখন ভয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। আমায় বসে থাকতে হচ্ছে।"
"বাজে স্বপ্ন দেখা খুব খারাপ। আমি দেখেছিলাম৷ বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলেন।"
তনিমা উঠে বসলো। জড়ানো গলায় বলল, "কোন ডাক্তার? আমি যাব।"
"ডাক্তার মেহেদী। খুব ভালো ডাক্তার।"
তনিমা বললো," মা, আমিও যাবো। নিয়ে চলো না।"
আন্টি বিরক্ত গলায় বললেন," চুপচাপ শুয়ে থাক। ডালিয়া মা তোমার কাছে ডাক্তারের নম্বর আছে?"
"আমার কাছে নেই। তবে বাবার কাছে আছে। উনাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন।"
আন্টি তক্ষুনি বাবাকে কল দিলেন। ডাক্তারের নম্বর নিলেন, ঠিকানা শুনলেন। আমি ইতস্তত গলায় বললাম," একটা কথা বলবো? আমি কি আপনাদের সাথে যেতে পারি। ডাক্তার সাহেবকে বলে আসতাম আমি ভালো হয়ে গেছি।"
"তোমার বাবা বলে দিয়েছে নিশ্চয়ই।"
তনিমা বললো," না মা, ডালিয়াকে নিয়ে চলো। আসার সময় তিনজনে রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসবো।"
আন্টি বাবাকে কল দিলেন। বললেন- আমি তনিমা নিয়ে ওই ডাক্তার কাছে যাচ্ছি। তনিমা চাচ্ছে ডালিয়া ওর সাথে যাক৷ আপনার কোন আপত্তি নেই তো? ফেরার পথে আমি বাসায় নামিয়ে দেবো।"
বাবা সম্মতি দিলেন। তনিমা খুশি হয়ে হাত তালি দিতে লাগলো। মেয়েটার বাচ্চামি স্বভাব এখনও গেল না।
ডাক্তার সাহেবকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মেরুন রঙের একটা হাফ শার্ট পরে আছেন। উনাকে দেখেছি কেমন লজ্জা লাগতে শুরু করলো। আড়ষ্ট হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি খুব সুন্দর করে তনিমার সাথে কথা বললেন। যেমনটা আমার সাথে বলেছিলেন। কষ্টে দম আটকে আসছে। মানুষটা এতো খারাপ কেন! চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
চলবে
No comments