গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ৪
#পদ্মকাঁটা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-৪
আৎকে উঠলাম। দিলু কাকা আমার ওপর জাদু করেছে। কিন্তু কেন? আমি উনার কি ক্ষ'তি করেছি? আমার এখন কি করা উচিত? দৌড়ে গিয়ে বাবাকে সবকিছু বলে দেবো? একি! আমার পা এগোচ্ছে না কেন? সমস্ত শরীর যেন সীসার মতো জমে গেছে। নড়তে পারছি না। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। এই মুহুর্তে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বাবাকে বললে দিলু কাকা কিছুই স্বীকার করবে না। তখন আর কিছু করার থাকবে না। না না বাবাকে কিছু বলা যাবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে। এই যাদু কি জিনিস? মুভিতে দেখা যাদুর মতো কিছু একটা। কিন্তু আমার ওপর যাদু করা হচ্ছে কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে এখনই কিছু করা যাবে না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।
কাঁপা হাতে ফুল তুলতে লাগলাম। দিলু কাকা বলল," আম্মাজান ফুল তুলছেন কেন? কাউকে দিবেন?"
যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম, "না কাকা। টেবিলে সাজিয়ে রাখবো।"
"আপনারা ডাক্তারের কাছে গেছিলেন না?"
"হু, গেছিলাম। পাগলের ডাক্তার। বলো তো কাকা, আমি কি পাগল?"
"না আম্মাজান। আপনি পাগল হবেন কেন? ভাই হয়তো বুঝতে পারেনি।"
"মেজাজটা একদম গরম হয়ে আছে।"
"আম্মাজান কি সিনেমা দেখবেন? চমৎকার কয়েকটা ভূতের সিনেমা পেয়েছি। দেখতে যা লাগে না! কি বলবো!"
"আপনার খুঁজে দেওয়া প্রতিটা সিনেমাই খুব সুন্দর হয়। দেখতে আরাম লাগে।"
দিলু কাকা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলো। চাপা গলায় বললো," কি যে বলেন না আম্মাজান! যান, মোবাইল নিয়ে আসেন। ডাউনলোড করে দিচ্ছি।"
এলোমেলো পায়ে ঘরের দিকে চলে এলাম। লোকটা কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। উনার কাছেই আমার সিনেমা দেখার হাতেখড়ি। একদিন গোলাপ ছাড়ের নিচে বসে কার্টুন দেখছি। এমন সময় দিলু কাকা এসে বলল," আম্মাজান কি দেখেন?"
"এইতো কাকা, কার্টুন দেখছি।"
"ছায়াছবির দেখেন না?"
"ছায়াছবি মানে মুভি? হ্যাঁ দেখি তো। কার্টুন মুভিগুলো দেখি, মাঝেমধ্যে এনিমেশনও দেখা হয়।"
"এসব সিনেমায় মজা নাই। ভূতের সিনেমা যা না! বললে আপনাকে ডাউনলোড করে দিতে পারি। রাতে দেখে মজা পাবেন।"
অতন্ত্য আবেগের বশে ভূতের মুভি ডাউনলোড করলাম। পরে দেখি ভূতের মুভি না। প্রেম কাহিনী। খুব বাজে বাজে দৃশ্য আছে। প্রথম দিকে একটু অস্বস্তি লাগলেও পরে এসব ভালো লাগতে শুরু করলো। নিয়মিত দেখতে লাগলাম। দিলু কাকা প্রতিদিন ভূতের মুভি নামিয়ে দিতো। সেগুলোও দেখতাম। কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেল।
আজকে বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্না হবে। মা সাকেরা খালাকে যেতে দেয়নি। সাকেরা খালা মুখ বেজার করে হাঁসের গোশত রান্না করছেন। আমি তার কাছে গিয়ে পিঁড়ি পেতে বসলাম। কৌতূহলী গলায় বললাম," খালা আপনি যাদুটোনায় বিশ্বাস করেন?"
"বিশ্বাস করবো না কেন? জ্বিন-পরী তো আছে মা।"
"যাদু করলে কি সত্যি সত্যি মানুষের ক্ষতি হয় নাকি মুভিতেই অমন বানায়?"
"সত্যই হয়। আমার দাদাও ওপর কালো যাদু করা হইছিল। শেষ বয়সে পা'গল হয়ে মা'রা গেছে।"
"যাদু করে কি কি করা যায়?"
"মানুষকে বশ করে। শত্রুতা থাকলে মে'রেও ফেলে, বান মা'রে।"
"ওহ! এসব থেকে বাঁচার উপায় নেই?"
"আছে তো মা। বড় বড় হুজুররা জ্বিন পোষে। ওই জ্বিন দিয়ে কাজ করার। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো।"
"এমনি কিছু করা যায় না? ওঝা বা হুজুরকে না দেখিয়ে।"
"আমার মা বলতেন- রাতে ঘুমানোর আগে সূরা ইখলাস, সূরা নাস, সূরা ফালাক পড়ে হাতে ফু দিয়ে সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে ওইদিন যাদুর প্রভাব পড়ে না। তাছাড়া আয়াতুল কুরসি পড়লে ঘুমাতেও শয়তান কাছে আসে না।"
আমি আর কিছু বলার আগে মা ঘরে ঢুকলো। সরু গলায় বলল," কি নিয়ে কথা হচ্ছে?"
সাকেরা খালা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন," কিছু না আপা। যাদু নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমার দাদাকে যাদু করা হয়েছিল তাই বলছিলাম।"
মা উনাকে আস্বস্ত করতে করে হালকা হাসলো। অথচ আমার দিকে কেমন কড়া চোখে তাকিয়ে আছে।
বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব। নানান পদে খাবার রান্না হচ্ছে। হাঁসের গোশত আর সেমাই পিঠা। এসব বাদেও মুরগী কোমরা হচ্ছে। তেলমশলা কম দিয়ে পোলাও হয়েছে। মা হেসে হেসে সব কাজ করছে, বাবাও হাত লাগিয়েছেন। মা-বাবা দু-জনে নিলে পিঠা বানালো।
আটটার মধ্যে সব রান্না শেষ। মা'য়ের প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। আমরা তিনজন খেতে বসলাম৷ সাকেরা খালাও আমাদের সাথে বসেছেন৷ আমার জীবনে এমন ঘটনা প্রথমবার দেখলাম। বাবা বললেন," হাঁসের গোশত রান্নার টেকনিক অন্যরকম। সাকেরা বু বোধহয় ভালো রাখতে পারেনি। আমি রাঁধলে আঙুল চাটতে হতো।"
সাকেরা খালা চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন। ঝাঁঝালো গলায় বললেন, " আগে একটু মুখে দিয়ে দেখেন। গোশত রান্নার আমার ধারে-কাছেও কেউ যেতে পারবে না। আমাদের ওখানে কোন অনুষ্ঠান লাগতে আমাকে ডাকতে আসে।"
মা বলল," না খেয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। হাঁসের গোশত ভালো হলে তোমায় দু'দিনের ছুটি দেবো। বেতনও কাটবো না।"
সাকেরা খালার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বাবা বললেন, "আমি এই মুহূর্তে খেতে পারবো না। একজন মেহমান আসবে। আমাকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দিলুকে খাবার দেওয়া হয়েছে?"
মা বললো," হু হয়েছে। সাকেরা বু গিয়ে দিয়ে এসেছে। এতক্ষণে বোধহয় খেয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে।"
আমি বিশেষ কিছু খেতে পারলাম না। হাঁসের গোশত সামান্য একটু মুখে দিয়ে বললাম," রান্না খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু আমি খেতে পারছি না। আমার শরীরটা যেন কেমন কেমন লাগছে।"
বাবা বললেন," কেমন লাগছে? বেশি খারাপ লাগলে গিয়ে শুয়ে পড়। ডাক্তার সাহেব আসলে একবার দেখিয়ে যাস।"
মা বলল," কোন ডাক্তার আসবে? তোমার কোন বন্ধু তো ডাক্তার নেই।"
"আরে আমার বন্ধু হবে কেন? ডালিয়ার ডাক্তার। আজই তো দেখালাম।"
"অপরিচিত লোককে বাড়িতে ডেকেছ কেন?"
"প্রথমে সব মানুষই অপরিচিত থাকে। আস্তে আস্তে পরিচিত হয়। তাছাড়া লোকটাকে অপরিচিত বলা যায় না। ডালিয়াকে দেখার সময় আমায় পাশের ঘরে গিয়ে বসতে বললো। এসি রুম। চাকর ছেলেটাকে দিয়ে আদা চা আনালো, দু'টো সমুচাও ছিল। খাওয়া শেষে এক গ্লাস বরফ শীতল পানি এনে দিলো। বলতে গেলে যত্নের চূড়ান্ত করেছে। আজকাল কোন ডাক্তারের ব্যবহার এমন হয় না। ওরা এক দরজা দিয়ে লোক ঢোকায় অন্য দরজা দিয়ে বের করে দেয়। হা হা হা।"
বাবা সুন্দর ভঙ্গিতে হাসলেন। ডাক্তার সাহেব আসছে শুনে আমার ঘুম উড়ে গেল। বুকের মধ্যে ডিপ ডিপ করতে লাগলো। মা সরু চোখে বাবার দিকে তাকালো। রাগী গলায় বললো," আজ রাতেই বলতে হবে কেন? অন্যদিন বলা যেত না?"
"আহা! আজ বললে সমস্যা কি?"
"কোন সমস্যা না। লোকটা তোমায় যত্ন করেছে নিজের লাভের জন্য। পাবলিসিটি বাড়ানোর জন্য।৷ এতে এতো গলে যাওয়ার তো কিছু নেই।"
"তা অবশ্য ঠিক। মনের ডাক্তারদের রোগী থাকে না।"
"জানলে আসতে বলেছ কেন?"
বাবা কড়া চোখে মা'য়ের দিকে তাকালেন। অথচ তার মুখ হাসি-হাসি।
মা আর কিছু বললো না। বাবা গামলা থেকে এক টুকরো গোশত তুলে মুখে পুরে দিলেন। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না। ঘরের দিকে হাঁটা দিতে গেলাম। ঠিক তখনই চোখ পড়লো জানালার দিকে। একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। চোখ দু'টো টকটকে লাল রঙের।
ঘরে যেতে পারলাম না। মা'য়ের পাশে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। ভয় মেশানো গলায় বললাম," আমার খুব খারাপ লাগছে।" মা কিছু একটা পড়ে আমার মাথায় ফু দিলেন। খেয়াল করলাম লাল চোখজোড়া আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগলাম। ভয় কেটে যাচ্ছে।
ডাক্তার সাহেব এলেন রাত দশটার দিকে। হাতে করে এক কেজি মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। মা উনাকে দেখে খুব বিরক্ত হলো। আমাকে উনার সামনে যেতে দিলো না। কড়া গলায় বললো," তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমিও তোমার সাথে যাচ্ছি।"
আমি প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বললাম," তুমি এমন করছো কেন?"
"এমনি করছি। যা বলছি তাই শোনো। বাড়তি কথা বলবে না।"
রাতে খুব সুন্দর ঘুম হলো। এক ঘুমে রাত কেটে গেছে। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। সকাল সকাল ঘুম ভাঙলেই বাগানে হাঁটতে যেতে ইচ্ছে করে। ফুলগুলো খুব সতেজ হয়ে থাকে। মা আমার জন্য বাদাম কিসমিস ভিজিয়ে রেখেছে। সেগুলোর কয়েকটা মুখে দিয়ে বাগানে হাঁটতে গেলাম। বোধহয় দিলু কাকা এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। তার ঘরের কাছে গিয়ে উঁকি মারলাম। কাকা কারো সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে- আমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য আমি সব করতে পারি। যত টাকা লাগে আমি দেবো। শুধু ডালিয়ার মন বদলাতে হবে। যাতে ও নিজের বাবাকে চিনতে পারে।
আমার মন বদলাতে হবে কেন? তাছাড়া আমার বাবাকে নতন করে কি চিনতে হবে? এক মিনিট! উনি কি যেন বললো আমার মেয়েকে কাছে নিয়ে আসতে চাই। মানে? আমি দিলু কাকার মেয়ে? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? লোকে অবশ্য বলে আমার সাথে দিলু কাকার চেহারার খুব মিল। তবে কি?
চলবে
No comments