1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ৩

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট-৩


পাখির ডাকে ঘুম ভাঙলো। একটা কাকা জানালার ধারে জলপাই গাছের ওপর বসে আছে। বেসুরো কর্কশ গলায় ক্রমাগত কা কা করছে। জেগে উঠে খানিকটা বিরক্ত হলাম। কাকের ডাকে ঘুম ভাঙার ব্যাপারটা একটুও ভালো লাগছে না। কোকিলের গান শুনলে হয়তো ভালো লাগত। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। স্বপ্নের ব্যাপারে তেমন কিছু মনে করতে পারলাম না। হঠাৎ খুব ভয় পেয়েছিলাম এতটুকুই মনে আছে। রাতে না খাওয়ার কারণে প্রচন্ড খিদে পাচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। মা পাউরুটিতে মাখন লাগাচ্ছে। বেশ কয়েকদিন ধরে সকালের নাস্তা হিসাবে শুকনো পাউরুটি জুটছে। ফ্রিজে মাছ-মাংস থাকলেও মা রান্না করবে না। বড়লোকেরা নাকি সকালে পাউরুটি খায়।


বাবা বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন। মুখের ওপর পত্রিকা, ডান হাতে মগ ভর্তি চা। বাবার কাছে গিয়ে কোমল গলায় বললাম," কেমন আছো বাবা?"


"এইতো মা, ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?"


"ভালোই বলা চলে, রাতে হঠাৎ খুব ভয় পেয়েছিলাম। এই আর কি!"


"ঘুমের মধ্যে ভয় পাওয়া মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে।"


কঠিন মুখে বললাম," সাইকিয়াট্রিস্ট মানে পা'গলের ডাক্তার? আমি কি পা'গ'ল?"


বাবা কোমল গলায় বললেন," মোটেই না। তুই খুব বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান হওয়ার কারণেই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে যাবি। হাফ-পা'গল মানুষেরা শুধু শরীরের ডাক্তার দেখায়। আর পুরো পা'গ'লের কোন অনুভূতি থাকে না। এখন তুইই ঠিক কর, তুই কি করবি।"


"আগে থেকে সিরিয়াল দিতে হবে না? গেলেই ডাক্তার পাওয়া যাবে?"


"হু। গেলেই পাওয়া যাবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ হাফ-পা'গ'লা। মনের রোগকে রোগই মনে করে না। অথচ গায়ে একটা ঘামাচি ফুটলেই ডাক্তারের কাছে দৌড়ায়।


বাবা হাসলেন। আমিও শব্দ করে হেসে উঠলাম। বাবা ঝলমলে গলায় বললেন, " রেডি হয়ে নে। তোকে মাকেও রেডি হতে বল। সকালের নাস্তাটা বাইরে করে নেবো।"


" মা রাজি হবে না। একটু আগে দেখলাম পাউরুটিতে মাখন লাগাচ্ছে।"


"তোর মা নিজেও ওই জিনিস খেতে পছন্দ করে না। তুই গিয়ে বল। দেখবি একবারেই রাজি হয়ে যাবে।"


সত্যিই মা একবার বলায় রাজি হয়ে গেল। পাউরুটি ডেকে রাখতে রাখতে বলল," তোদের জ্বালায় কোন কাজ করার উপায় নেই। চল দেখি যাই।"


আমি অল্প হাসলাম। 

অল্প বয়সী এক তরুণ চেয়ারে বসে আছে। মনে হচ্ছে উনিই ডাক্তার। লোকটার মুখে চাপ দাঁড়ি, ফর্সা চেহারা। মেয়েদের মতো টানাটানা চোখ। ডাক্তার সাহেব অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, " শুভ সকাল লিটল প্রিন্সেস!


"শুভ সকাল।"


"তুমি কি হিন্দু নাকি মুসলিম?"


"মুসলিম।"


"আসসালামু আলাইকুম!"


"ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুমি কি আমার সাথে একান্তে কথা বলতে চাও?"


আমি বিব্রত হয়ে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তার সাহেব সহজ গলায় বললেন," তোমার সমস্যাগুলো কি বাবার সামনে বলতে পারবে?"


আমি মাথা নাড়ালাম। উনি বললেন," তাহলে মিস্টার। আপনি পাশের কক্ষে গিয়ে বসুন। এখানকার বজলুর দোকানে খুব ভালো আদা চা পাওয়া যায়। এক কাপ চা পান করতে করতে অপেক্ষা করুন। ভীত হবেন না। এ ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগলো আছে। আমার কার্যকলাপ আপনি ও ঘরে বসেই দেখতে পারবেন। শুধু কথা শুনতে পারবেন না।"


বাবা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। উনি বললেন," তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসে পড়ো। তুমি না বসলে আমাকেও দাঁড়াতে হবে।"


লোকটার কথার ধরন খুব অদ্ভুত। গোলগাল চেহারা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকাচ্ছে। 


"এখন বলো, তোমার কি সমস্যা? "


"আমি রাতের বেলা দুঃস্বপ্ন দেখি৷ খুব বাজে বাজে স্বপ্ন।"


"জেগে দেখো নাকি ঘুমিয়ে দেখো?"


আমি কটমট দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। কঠিন মুখে বললাম," ঘুমিয়ে দেখি।"


"স্বপ্নের কথা সবসময় মনে থাকে? নাকি কখনও কখনও ভুলে যাও?"


"বেশিরভাগ সময় মনে থাকে, মাঝেমধ্যে ভুলে যাই।"


"কি ধরনের স্বপ্ন দেখো? রোমান্টিক, হরর এই জাতীয়? অবশ্য রোমান্টিক স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন বলে না। মিষ্টি স্বপ্ন বলে।"


আমি কিছু বললাম না৷ বিব্রত মুখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। স্বপ্নের ব্যাপারগুলো উনাকে বলার মতো না। তাছাড়া দিলু কাকার ঘটনাটাও উনাকে বলতে পারবো না। উনি সহজ গলায় বললেন," কাজের কথা বাদ দাও। খানিকক্ষণ গল্প করা যাক। সেদিন কি হয়েছে শোনো, আমি বিছানায় শুয়ে আছি। হঠাৎ করে আমার স্ত্রী এসে আমার গায়ে কয়েকটা তেলাপোকা ছেড়ে দিলো। হাসতে হাসতে বলল,'একটু ভয় পাও। একটু চিৎকার করো।' ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করবো। লোকে দেখবে শুধু মেয়ে মানুষই না, পুরুষ মানুষও তেলাপোকা দেখলে ভয় পায়।"


আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। সহজ গলায় বললাম," আপনি ভয় পেলেন?"


"হ্যাঁ, পেলাম একটু। বউকে খুশি রাখার জন্য মাঝেমধ্যে এসব করাই যায়। এখন তোমার সমস্যার কথা বলো। কেমন স্বপ্ন দেখো?"


"সেদিন দেখলাম বাবা মা'য়ের চুলে আ'গু'ন ধরিয়ে দিয়েছে। পরেরদিন দুপুর স্কুল থেকে ফিরেছি। হঠাৎ দেখলাম, মা আমাদের মালির সাথে এক বিছানায় শুয়ে আছে। পরক্ষণেই কেউ নেই।"


" তোমার বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়? ভৌতিক নাটক সিনেমা দেখার অভ্যাস আছে? প্রচন্ড ক্লান্ত লাগে? দিনের রুটিন উল্টোপাল্টা?"


"এগুলোর প্রশ্ন করলেন! কোনটার জবাব দেবো?"


"আমার সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দরকার। তুমি একটা একটা করে উত্তর দাও।"


"হ্যাঁ, মা বাবা সারাদিন ঝগড়া করে। আমি হরর মুভি দেখতে খুব পছন্দ করি। স্কুল থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত লাগে। আমার প্রতিদিনের রুটিন আলাদা।"


"ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঘুমাতে যাও?"


"হুম।"


"দেখো, তোমার এই সমস্যাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হচ্ছে দুঃস্বপ্ন অন্যটা প্রচন্ড মানসিক চাপের কারণে ভুল দেখা। তুমি নিশ্চয়ই তোমাদের মালির সঙ্গে মা'য়ের খারাপ ব্যাপার চিন্তা করেছিলে?"


কড়া গলায় বললাম," না, আমি এমন কিছুই চিন্তা করিনি।"


"নিশ্চয়ই করেছ। খুব অস্পষ্ট হলেও করেছ। হয়তো তোমার মনে নেই।"


হ্যাঁ। এই ডাক্তার ঠিকই বলছে। দু'দিন আগে একটা সিনেমা দেখেছিলাম৷ সেখানে এমন একটা দৃশ্য ছিল। তখন আমার মা'য়ের কথা মনে পড়ছিল। মা দিলু কাকার সাথে শুয়ে আছে। ঠিক সেই দৃশ্যটাই সেদিন দেখেছি।


"মনে পড়েছে?"


আমি মাথা দোলালাম। উনি কোমল গলায় বললেন," এতে তোমার কোন দোষ নেই। মনের সব ভাবনাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এবার আসো দুঃস্বপ্নের ব্যাপারে। দুঃস্বপ্ন হচ্ছে যা আমাদের মনে উদ্বেগ বা চরম দুঃখের মত প্রবল সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এবং এটা দেখার পর প্রায়শই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় জাগ্রত হয়। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো?"


আমি মাথা নাড়ালাম। উনি নড়ে-চড়ে বসলেন। চশমা ঠিক করতে করতে বললেন, " দুঃস্বপ্নের দুইটা দিক। এটা নাইটমেয়ার অন্যটা স্লিপ টেরর। তোমার ক্ষেত্রে দুটোই দেখা যাচ্ছে।"


"এগুলো কি জিনিস?"


"নাইটমেয়ারে শিশুরা দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পায়। স্বপ্নগুলো ভীষণ ভয়ংকর। যেমন ধরো মা-বাবাকে কেউ মা'রতে আসছে। তোমার কোন ক্ষতি হচ্ছে। এসব স্বপ্ন জেগে ওঠার পর মনে থাকে। এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিন থেকে ছয় বছরের বাচ্চাদের হয়ে থাকে। অন্যদিকে স্লিপ টেররের ক্ষেত্রে হঠাৎ তীব্র ভয় পায় কিন্তু স্বপ্ন দেখছে কি-না বলতে পারে না।"


"আমি এসব থেকে  কিভাবে মুক্তি পাবো? আমার যে খুব কষ্ট হয়।"


"কিছু উপায় তো নিশ্চয়ই থাকবে। এই যেমন ধরো কয়েকদিন সিনেমা দেখা যাবে না। রুটিন মেনে চলতে হবে। বাকিগুলো তোমার বাবাকে বলে দিবো।"


"আচ্ছা ঠিক আছে। বাবাকেই না হয় বলবেন।"


"তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়ই?"


"হ্যাঁ। বুঝেছি। মেনে চলার চেষ্টা করবো।"


"তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। তুমি কি এক কাপ চা খাবে? আদা চা। আমার খুব পছন্দের।"


আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম," না, আমি চা খাবো না।"

হঠাৎ করে খারাপ লাগতে শুরু করছে। ডাক্তার সাহেব বিবাহিত হতে গেলেন কেন? উনার বউ না থাকলে কি এমন সমস্যা হতো? দুনিয়া পাল্টে যেত নাকি! দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। সরু গলায় বললাম, " আপনার নামটা একটু বলবেন?"


উনি মুচকি হাসলেন। সহজ গলায় বললেন, " আমার নাম মেহেদী হাসান। তোমার কি নাম?"


"আমার নাম ডালিয়া।"


"খুব সুন্দর নাম। আমার পছন্দের ফুলের নাম। আর একটা কথা আমি কিন্তু অবিবাহিত। ওই ঘটনাটা বানানো।"


আমি চমকে উঠলাম। সে চমক উনার চোখ এড়ালো না।৷ আমার দিকে খুব সুন্দর করে হাসলেন। এই লোকটা মনের ডাক্তার! উনি কি আমার মন পড়তে পারছে? না না পারছে না। মন পড়ার মন বৈজ্ঞানিক উপায় তৈরি হয়নি। নাকি হয়েছে? ইসস কি এক বিশ্রী কান্ড হয়ে গেল! লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। 


মা-বাবার সাথে অনেক ঘোরাঘুরি করলাম। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে এলো। দুপুরের সবাই মিলে বিরিয়ানি খেয়েছি। দিনটা খুব সুন্দর কাটছে। আসার সময় দেখলাম আজ অনেক গোলাপ ফুটেছে। কয়েকটা গোলাপ তুলে এনে ফুলদানিতে রাখতে মন্দ হয় না। মিষ্টি গন্ধ ছড়াবে। ফুল তোলার জন্য বাগানে গেলাম। দিলু কাকাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এই সুযোগ! ফুল তুলতে দেখলে উনি খুব কষ্ট পায়। বেজার মুখে তাকিয়ে থাকে। একটা ফুল তোলার পর দিলু কাকার গলা কানে এলো। চাপা স্বরে কারো সাথে কথা বলছে। কান খাঁড়া করলাম।


"না কোন কাজ হচ্ছে না। ডালিয়ার ওপর কোন প্রভাব পড়ছে না। শুধু শুধু আমার থেকে টাকা নিস না। মা'ই'রামু একদম।"


কিছুক্ষণ নিরবতা!।


"কবে কাজ হইবো? আজও দেখলাম মা বাবা সাথে ঘুরতে যাচ্ছে। জাদুর পাওয়ার বাড়াতে হবে। বেশি শক্তিশালী জাদু কর। ডালিয়া যেন..."


আৎকে উঠলাম। দিলু কাকার আমার ওপরে জাদু করেছে। কিন্তু কেন? আমি উনার কি ক্ষতি করেছি? দৌড়ে গিয়ে বাবাকে বলে দেবো? একি! আমার পা এগোচ্ছে না কেন? পা দু'টো  সীসার মতো জমে যাচ্ছে কেন?


চলবে

No comments

Powered by Blogger.