1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ২

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট- ২


মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠলো। আমার বাড়িতে নিজের পরিবারের মাঝে বীজ বুনেছে চিরপরিচিত কুৎসিত অধ্যায় পরকীয়া! মা এমন জঘন্য কাজ করতে পারে ভাবতেও পারছি না। বাবা কি এসবের কিছু জানে? হয়তো জানা না, জানলেও খুব আবছা। কালেভদ্রে কখনো চোখে পড়লেও মনে লাগে না।

হঠাৎ করে বাগানের দিকে চোখ পড়লো। দিলু কাকা বাগানে কাজ আছে। বেলিফুলের কয়েকটা চারা নেতিয়ে পড়েছে। সেগুলোকে সোজা করার জন্য বাঁশের কঞ্চি পুঁতছে। কয়েক সেকেন্ড মধ্যে জায়গা বদলানো সহজ কাজ নয়, বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব। তবে কি আমি ভুল দেখছি নাকি তার এই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করার বিশেষ কোন উপায় জানা আছে? বিছানার দিকে তাকালাম। বিছানা ফাঁকা। সেখানে কোন মানুষ নেই। একটা কোলবালিশ এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। এসব কি হচ্ছে? তাহলে কি মা আর দিলু কাকা একসাথে ছিল না? না! ওরা এখানে ছিল না। থাকলে চোখের সামনে ওধাও হয়ে পারতো না। বোধহয় আমিই ভুল দেখেছি। তাছাড়া ওরা এখানে থাকলে সদর দরজা খোলা থাকত না। প্রায়ই বাড়িতে হুটহাট লোক চলে আসে। গতদিনও অপরিচিত এক মহিলা এসেছিল। মা কখনও এত বড় ভুল করবে না। হঠাৎ করে চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে লাগলো। দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করেছে। চোখে পানি আসছে নাকি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি? বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। সমস্ত শরীর ভর ছেড়ে দিচ্ছে। অভিকর্ষজ ত্বরণের দরুন মাটির দিকে পড়তে শুরু করেছি। নাকি এসবই আমার ভ্রম? বুঝতে পারছি না!


ঘন্টা খানেক পরে জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলে দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। মা চিন্তিত মুখে আমার মাথার কাছে বসে আছে। এক ধ্যানে কিছু একটা চিন্তা করছে। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। 


"মা, একটু পানি খাবো।"


মা চমকে আমার দিকে তাকালো। ব্যস্ত গলায় বলল," কি হয়েছিল তোর? মেঝেতে পড়ে ছিলি, জ্ঞান ছিল না। যা ভয় পেয়েছিলাম। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।"


"কেন অজ্ঞান হয়েছিলাম বলতে পারি না। আমর কিছু মনে নেই। হঠাৎ করেই মাথার ভেতর কেমন একটা লাগছিল। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার।


"এই রোদের মধ্যে স্কুলে গিয়ে এমন হয়েছে। গরমে সবাই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কতবার করে বললাম, হাতা নিয়ে যা। ছাতাটা মাথায় ধরলে একটু শান্তি লাগে। আমার কথা তো শুনবি না। যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে। কাল থেকে আর স্কুলে যেতে হবে না। বাড়ি বসে পড়াশোনা করবি। দরকার হলে প্রাইভেট মাস্টার ঠিক করে দেবো। তোর বাপও একজন মানুষ। ওই লোকটার কথা আর কি বলবো! মেয়েটাকে তো একটা রিকশা ঠিক করে দিতে পারে। আমাদের দিকে তার কোন খেয়াল নেই। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ।"


" মা তুমি শুধু শুধু বাবাকে রাগারাগি করছো। আমি একদম ঠিক আছি। তখন একটু খারাপ লাগছিল।"


"হয়েছে থাক! তোর আর বাপের হয়ে সাফাই গাইতে হবে না। জ্ঞান ফিরিয়ে তাই আলহামদুলিল্লাহ। এখন চুপচাপ শুয়ে থাক। আমি পানি নিয়ে আসছি। এ ঘরে পানি নেই।"


মা ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, "সাকেরা বু এক গ্লাস পানি দাও তো। কোথায় গেলে? কাজের সময়ই তোমাকে পাওয়া যায় না।"


বিছানায় উঠে বসলাম। মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে। গা গরম হতে শুরু করেছে। শীত শীত করছে। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিলাম। চাদরের উষ্ণতায় সামান্য আরাম পেলে মন্দ কি? 


মা শুধু পানি আনেনি। তার সাথে ফল কেটে নিয়ে এসেছে। দু'টো ডিম পোঁচ করেছে। এক গ্লাস দুধও এনেছে।


করুণ গলায় বললাম," মা, আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। পানিও খাবো না। তৃষ্ণা মরে গেছে।"


" তৃষ্ণা কখনও মরে যায় না, সময়ের সাথে বাড়তেই থাকে। বেশি বাজে না বকে যা দিয়েছি চুপচাপ খেয়ে নে।"


"মা!"


" বল?"


"একটা কথা জানতে চাইবো? সত্যি বলবে?"


"আমি কখনও মিথ্যে কথা বলি না। যাইহোক কি কথা জানতে চাস?"


"দিলু কাকা কি ঘরে এসেছিল?"


"তোর বাবা না থাকলে দিলুর ঘরে ঢোকা নিষেধ। জানিস না?"


"জানি। আমার কেমন যেন মনে হলো দিলু কাকা ঘরে এসেছে। সামনের ঘরে খাটের ওপর শুয়ে আছে। তুমি.."


এতটুকু বলার পর মা থামিয়ে দিলো। কঠিন মুখে বলল," খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়। তোর মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। বিশ্রাম প্রয়োজন।"


সাকেরা খালা মা'কে ডাকছেন। রাতের জন্য কি বাঁধবে বুঝতে পারছে না। মা আমার মুখে হাত বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে দিলো। কোমল গলায় বলল," চিন্তা করিস না। মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হওয়া এমন বড় বিষয় নয়। তোর বাবা আসলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলবো। এখন একটু বিশ্রাম নে।"


বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার একটু আগে। আলো মরে এসেছে।ইচ্ছে করছিল আরো খানিকক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকি। কিন্তু মা'য়ের কারণে সেটা সম্ভব হলো না। মা এসে ডেকে তুললো। শান্ত গলায় বলল," তোর বাবা এসেছে। তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এসব ব্যাপারে অবহেলা করা ঠিক না মা।"


" আমি এখন যেতে পারবো না। আরও কিছুক্ষণ ঘুমুতে চাচ্ছি। ভালো ঘুম হলে শরীর ঠিক হয়ে যাবে।"


"অহেতুক জেদ করিস না। নতুন করে অশান্তি হবে।"


" কোন অশান্তি হবে না মা। তুমি গিয়ে আরাম করে সিরিয়াল দেখো। বাবাকে বড় মগের এক মগ চা বানিয়ে দাও। সকালে পত্রিকা পড়া শেষ হয়নি। এখন চা পান করতে করতে গোটাটা শেষ করবে।"


"তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? কি হয়েছে তোর? দেখি জ্বর এসেছে নাকি।"


মা কপালে হাত দিতে গেল। আমি বেশ অনেকটা পিছিয়ে গিয়ে বললাম," আমার শরীর একদম ঠিক আছে। কোন জ্বর-টর নেই। আর থাকলেও তোমার দেখতে হবে না।"


"তাহলে কে দেখবে?"


"কারোর দেখতে হবে না। বাবা অফিস থেকে ফিরে এসেছে অনেকক্ষণ হয়ে যাচ্ছে। তোমাদের ঝগড়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত যাও।"


মা একটুও নড়লো না। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। মা'য়ের এমন অবস্থা দেখে আমার কষ্ট পাওয়া উচিত। এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে ক্ষমা চাওয়া যেতে পারে। আবার পা ধরেও মাফ চাওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু আমার তেমন কিছু করতে ইচ্ছে করলো না। বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম। চাদর দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে মোবাইল বের করলাম। আজ খুব সুন্দর একটা মুভি ডাউনলোড করেছি। মুভির কিছু জায়গায় খোলামেলা দৃশ্য আছে। সেসব দেখতে আমার একটু খারাপ লাগে না। বরং খুব ভালো লাগে। 

আদর্শ মা হিসেবে এখন আমার মা'য়ের কি করা উচিত ছিল? আমাকে খুব ভালো ভাবে বুঝিয়ে বাবার সাথে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া অথবা চাদর সরিয়ে ইচ্ছেমতো পে'টা'নো, কড়া গলায় ব'কা'ঝ'কা করা। মোবাইল কেড়ে নিয়ে পড়তে বসানো। কিন্তু না। সে তেমন কিছুই করলো না। পাশের ঘরে গিয়ে বাবার সাথে ঝগড়া শুরু করেছে। উঁচু গলায় বলছে," তোমার সংসার ছেড়ে চলে যাব। বাপ মেয়ে মিলে আমার জীবনটা একদম শে'ষ করে দিয়েছো। দুপুর থেকে মেয়ের দেখাশুনা করছি, কবার খোঁজ নিয়েছো তুমি?"


বাবাও থেমে নেই। ঝাঁঝালো গলায় বলছেন, " সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে তবে বাড়ি ফিরি। কোথায় একটু বিশ্রাম নেবো। সুস্থ মতো থাকবো। কিন্তু না, আমার কপালে তো তা লেখা নেই। বিয়ের পর থেকে জীবনের সব সুখ চলে গেছে। সংসার দেখে রাখার দায়িত্ব পুরুষ মানুষের হলে মেয়েরা কি করবে? সারাদিন বসে সিরিয়াল দেখবে?"


"তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো এক সময় আমি তোমার থেকে অনেক বেশি রোজগার করতাম। এই সংসারের জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমায় খাওয়ার খোঁটা দেবে না।"


"হ্যাঁ হ্যাঁ। কিভাবে রোজগার করতে খুব ভালো করে জানা আছে। বসের গাড়িতে এই হোটেল ওই হোটেল। কিছু জানি না ভেবেছ?"


মা কি বললেন শুনতে পারলাম না। ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে নিয়েছি। উঁচু ভলিউমে বাইরের আওয়াজ শোনা যায় না। গেলেও খুব অস্পষ্ট। মা'ও নিশ্চয়ই বাবাকে কড়া কোন কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। তমিলা না কে একটা আছে। তাকে নিয়েও ঝগড়া হয়। মুভির একটা দারুণ সীন চলছে। আমি বিছানার চাদর চেপে ধরলাম। 


মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। দুপুরের পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। খিদের পেট চোঁচোঁ করছে। মা পাশে নেই, ঘরে লাইট জ্বলছে। দরজাটা হালকা করে ভেজানো। কিছু একটা খেতে হবে। না হলে সারা রাতে আর এক ফোঁটাও ঘুম হবে না। ফ্রিজে নিশ্চয়ই খাবার-দাবার রাখা আছে। আমাদের ফ্রিজ কখনও খালি হয় না। ধীর পায়ে উঠে রান্নাঘরে দিকে গেলাম। বাবার ঘর থেকে গোঙানির আওয়াজ আসছে। এমন আওয়াজ মানুষকে আকর্ষণ করে। দরজার ফাঁকায় চোখ রাখতেই চমকে উঠলাম। মায়ের হাতে র'ক্তমাখা ছু'রি। বাবা ছটফট করছেন। তার শরীর ভেজা। মেঝেতে র'ক্তের বন্যা বইছে। 

আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হতে আসতে লাগলো। এসব কি শুরু হয়েছে?


চলবে

No comments

Powered by Blogger.