গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১
পোড়া পোড়া গন্ধে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি বাবা মা'য়ের চুলে আ'গু'ন লাগিয়ে দিয়েছে। মা মেঝেতে শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ, হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঘন কালো চুল কয়েক হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। মায়ের জ্ঞান নেই।
ভীতু গলায় বললাম," এসব কি করছেন?"
বাবা আমায় দিকে তাকালো। শান্ত গলায় বলল," কিছু করছি না। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।"
" মা? মা ওখানে শুয়ে আছে কেন?"
" তোমার মায়ের কিছু হয়নি। সে তোমার পাশেই শুয়ে আছে। তুমি ভুল দেখছ।"
পাশ ফিরে দেখি বাবার কথাই সত্যি। মা বিছানার কোণায় শুয়ে আছে। ঘুমন্ত কোমল মুখে সিদ্ধতা ছড়াচ্ছে। দ্বিতীয়বার মেঝের দিকে তাকালাম। মেঝেতে কিছুই নেই। একদম পরিষ্কার।
" কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?"
" না ওই, মেঝেতে।"
" মেঝেতে তো কিছুই নেই। বোধহয় তুমি খারাপ স্বপ্ন দেখেছ। ব্যাপার না, এমনটা হতেই থাকে। শুয়ে পড়ো।"
একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ালাম। ঘড়িতে রাত একটা। বাবা এ-সময় এ ঘরে কি করছেন? বাবা আলাদা রুমে থাকেন। রাত জেগে অফিসের কাজ করতে হয়। মা আমার সাথে পাশের রুমে থাকে। আগে বাবার সাথে থাকতো। বেশ কয়েকদিন হলো ঝগড়া করে ওঘর ছেড়ে এসেছে।
বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ঘুম এলো শেষ রাতে। ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। খোলা মাঠের সামনে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। পাশে বিশাল বটগাছ। বটগাছের গায়ে সিঁদুর দিয়ে কিছু লেখা রয়েছে। দূর থেকে ক্ষীণ গলায় কেউ আমায় ডাকছে। সাহায্য জন্য ডাকছে।
"আমায় বাঁচাও, আমি এখনও জীবিত আছি। এখানে ফেলে রেখে যেও না। শিয়ালে নিয়ে যাবে।"
ভয় মেশানো চাপা গলায় বললাম," কে তুমি? কোথায় আছো? আমি কিভাবে তোমাকে বাঁচাবো?" গলার স্বর অস্পষ্ট। তবুও লোকটা বুঝলো। কান্নাভেজা গলায় বলল," আমি তোমার পায়ের কাছে পড়ে আছি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে যেও না।"
পায়ের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। র'ক্ত মাখানো একটা শরীর মাটিতে পড়ে আছে৷ তার মাথা ধ'ড় থেকে আ'লাদা হয়ে গেছে। চিৎকার করে উঠলাম। ঘুম ভাঙলো নিজের চিৎকারে। চারদিক পরিষ্কার হয়ে গেছে। জানালা গলে সকালের আলো এসে ঘরের ভেতর পড়ছে। মা মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে আছে। বিছানায় উঠে বসলাম। সরু গলায় বললাম," মা, রাতে কি হয়েছিল?"
মা পেছন ঘুরে তাকাল। অবাক গলায় বলল," কি হবে? রাতে তো কিছু হয়নি। খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস নাকি?"
" না, তেমন কিছু না। দেখেছিলাম বোধহয় ঠিক মনে নেই। তবে স্বপ্নটা খুব ভয়ের ছিল।"
"সারা রাত ভুতের সিনেমা দেখলে ভয়ের স্বপ্ন দেখবি না তো কি করবি! কত করে বলি, ওইসব ছাইপাঁশ দেখিস না। কে শোনে আমার কথা।"
" আচ্ছা। আর দেখবো না। এক গ্লাস পানি দেবে?"
মা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে পানি ঢাললো। আমার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল," তুই ক'দিনের জন্য নানাবাড়ি থেকে ঘুরে আয়। সোহেল এসেছে। কাল বিকেলে তোর মামা কল দিয়েছিল- তোকে যেতে বলেছে।"
উত্তরে অপেক্ষা না করে মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বোধহয় মায়ের কথাই ঠিক। কাল রাতে অনেকগুলো ভৌতিক সিনেমা দেখেছি, যার ফলস্বরূপ এমন বাজে স্বপ্ন দেখলাম। মা'য়ের তো কিছুই হয়নি, সুস্থ শরীরে আমার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রোদ ওঠার সাথে সাথে ভয় কেটে যেতে লাগলো। নিজের বোকামির কথা চিন্তা করে খানিকটা হাসি আসছে। কিসব অদ্ভুত স্বপ্ন! মা বাবা-মা দু'জন দু'জনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। পরিবারের অমতে গিয়ে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অথচ তাদের সম্পর্ক ছিল মাত্র তিন দিনের। বাবা পৈতৃক ভিটা ছেড়ে এসে জঙ্গলে মধ্যে জায়গা কিনেছেন। সেখানের জঙ্গল পরিষ্কার করে দোতালা বাড়ি উঠিয়েছেন। বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুর, সামনে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে ফুলের বাগান। একজন মালি রাখা আছে। সে ফুল বাগানের দেখাশোনা করে। মা'য়ের একজন সাহায্যকারীও আছে। সকালে আসে, সারাদিন কাজকর্ম করে রাতে বাড়ি ফিরে যায়। এক সময় মা-বাবা দু'জনেই চাকরি করত। দু'জনের টাকায় এতো বড় বাড়ি তৈরি হয়েছে। বিয়ের নয় বছরের মাথায় আমার জন্ম। আমার জন্মের পরপরই মা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তার এক কথা- টাকা পয়সা যা হয়েছে, তা যথেষ্ট। এখন আর চাকরি করবো না, মেয়ে মানুষ করবো। এরপর আরো ছেলেপুলে হবে। ওদেরও মানুষ করতে হবে। মা'য়ের খুব শখ ছিল তার একটা ছেলে হবে, কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। তেরো বছর হতে চলল এখনও আমার কোন ভাই-বোন হয়নি।
হাত-মুখ ধুয়ে বাগানে হাঁটতে বের হলাম। দিলু কাকা খুপরি হাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগানের একপাশে বসরাই গোলাপের ঝাড়, ফুল ভরে আছে। পথের পাশে সারি সারি বেলি ফুলের চারা। কলমের চারা। গতকাল বাজার থেকে কিনে আনা হয়েছে। চারাগুলোতে দু'একটা ফুল ধরেছে। খুব সুন্দর মিষ্টি গন্ধ।
দিলু কাকায় হাতের ইশারায় ওনার দিকে ডাকলো। কাছে যেতে মৃদু গলায় বলল," আম্মাজান সাবধানে থাকবেন। লক্ষণ বেশি ভালো না।"
" কি হয়েছে কাকা?"
" কাল রাতে আপনার ঘরের মধ্যে আগুনের শিখা জ্বলতে দেখছি। জ্বিন-ভূতের কাজ হতে পারে। রোজ রাতে আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাবেন। এতে আল্লাহ রহমত থাকবে।"
"জ্বি আচ্ছা।"
" শুধু তাই না আম্মা। পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। মনে হয় বাড়িতে অশুভ কিছু ঢুকছে। ভাইকে বলে বাড়ি বন্ধক দিতে হবে।"
ভীতু চোখে উনার দিকে তাকালাম। লোকটা কি আমায় ভয় দেখাতে চাইছে? আমার এসব জ্বিন পরীর ব্যাপার খুব একটা বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সে কখনও মিথ্যে বলে না। তাছাড়া কাল রাতে আমিও একই জিনিস দেখেছি। একই গন্ধ পেয়েছি। তা যদি স্বপ্নই হয়। তবে দিলু কাকা জানলো কেমন করে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, জানালার পাশে আগুন জ্বলছিল।
অসম্ভব অস্থিরতা নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। রাতে এখানে কিছু হলে তার কোন না কোন ছাপ তো থাকবেই। সবকিছু এক রাতের মধ্যে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু না! ঘরের কোথাও কিছু নেই। সবকিছু একদম ঠিকঠাক আছে।
বাবা বারান্দার চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়েছেন। সকালটা তার পত্রিকা পড়ার সময়। চা খেতে খেতে একদিনের বাসি পত্রিকা পড়েন। বাবার কাছে গিয়ে বললাম," কাল রাতে কি আপনি আমার ঘরে গিয়েছিলেন?"
বাবা অসম্ভব বিরক্ত হলেন। কড়া গলায় বললেন," রাতে তোমরা মা মেয়ে রুমের দরজা আটকে ঘুমাও। চাইলেও যাওয়ার কোন উপায় নেই। আমাকে বিরক্ত করো না। অফিসের দেরি হয়ে যাবে।"
বাবার কথা সত্যি। মা দরজা না আটকে ঘুমাতে পারেন না। তাহলে কাল রাতে ওইসব কি ছিল? আমার ক্ষেত্রে যদি স্বপ্ন ধরি তাহলে দিলু কাকা কি দেখেছে? দু'জনে একসাথে একই স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়। কিংবা আমি তাকে আমার স্বপ্নের কথা বলিনি। বানিয়ে বলার অপশন নেই। তবে কি বাবা মিথ্যে বলছে? কিন্তু কেন?
সকালের নাস্তায় কলা, পাউরুটি। সাকেরা খালা এখনও আসেননি। তিনি এলে তারপর রান্না হবে। মা চুলার কাছে যেতে পছন্দ করে না। ব্রেকফাস্টে পাউরুটি দেখে বাবা ভীষণ রেগে গেলেন। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে করতে অফিসে চলে গেলেন। মা নাস্তা করছেন, বাবার কথায় তার কোন হেলদোল নেই।
" মা, কাল রাতে কি বাবা আমাদের ঘরে এসেছিল?"
" সে কথা তোর বাবাকেই জিজ্ঞেস কর। আমায় বলছিস কেন?"
" এমনিতেই। বাবা বলেছে তুমি দরজা লাগিয়ে দাও।"
" তা কি দরজা খুলে ঘুম পড়বো? রাত-বিরেতে চোর ডাকাত আসলে।"
"সদর দরজা তো আটকানোই থাকে।"
" বেশি পাকা পাকা কথা বলিস না। চুপচাপ খেয়ে গিয়ে পড়তে বোস। সামনের মাসে পরীক্ষা।"
" আচ্ছা।"
মা'য়ের সাথে কথা বলার কোন মানে হয়। সে কোন কথার জবাব দেবে না। অনেক চেষ্টা করেও বইয়ের পাতায় মন দিতে পারছি না। রাতের ঘটনা ভীষণ ভাবাচ্ছে। হ্যাঁ তো। মা'য়ের চুল দেখলেই অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। মা'য়ের চুল পা পর্যন্ত লম্বা। রাতে যদি তেমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে চুল দেখলেই বোঝা যাবে। এক দৌড়ে ছাঁদে চলে গেলাম। মা সিঁড়ির পাশে বসে মোবাইল দেখছে। কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানা। ইচ্ছে করেই ঘোমটা সরিয়ে দিলাম। মা'য়ের চুল ঘাড় পর্যন্ত ঝুলে আছে।
" চুল কাটলে কখন?"
" দু'দিন আগেই তো কাটলাম। মনে নেই তোর?"
" না, কেন কাটলে?"
" লম্বা চুল সামলাতে ইচ্ছে করে তাই। তোর সামনেই তো কাটলাম। ভুলে গেছিস নাকি?"
আমি মাথা নাড়ালাম। মা বলল," এই পর্বে দারুণ সীন চলছে। বিরক্ত করিস না তো। যা এখান থেকে।"
মা মিথ্যে বলছে কেন? তার চুল দু'দিন আগে কাটা হয়নি। গতকাল সকালেও দেখলাম শ্যাম্পু করে চুল ছেড়ে দিয়েছে। একগোছা কালো চুল মাটির কাছে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। মা'য়ের হাবভাব ভালো ঠেকছে না। কোথাও খুব বড় সমস্যা হয়ে গেছে। আমাকে বলতে চাইছে না। কিন্তু কেন? আমার থেকে লুকিয়ে রেখে কি লাভ?
মাথায় দুশ্চিন্তার বোঝা নিয়ে স্কুলে চলে গেলাম। মা স্কুল কামাই করতে দেবে না। আজ খুব গরম পড়েছে। গরমের কারণে ক্লাস হবে না। হেড স্যার সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সরকার থেকে নির্দেশ এসেছে- গরমের মধ্যে ক্লাস নেওয়া যাবে না।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল। মা একটু বেশিই বোঝে! কতবার করে বললাম আজ স্কুলে যাব না। শুনলো না। বাড়ির সদর দরজা খোলা, ঘরের মধ্যে উঁকি দিতেই দেখলাম দিলু কাকা বিছানায় শুয়ে আছে। মা তাকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে আছে। আদুরে গলায় বলছে," আমাদের প্লান কাজে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।"
মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠলো। আমাদের বাড়িতে চিরপরিচিত কুৎসিত অধ্যায় পরকীয়ায় সূচনা হয়েছে। মা এমন জঘন্য কাজ করতে পারে ভাবতে পারছি না। বাবা কি এসবের কিছু জানে?
সূচনা পর্ব
#পদ্মকাঁটা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
No comments