গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১৩
#পদ্মকাঁটা
কলমে: #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-১৩
ডিএনএ রিপোর্ট চলে এসেছে৷ লা'শটা তনিমার নয়, অন্য কারো। হাসপাতাল থেকে চু'রি যাওয়া। খুব তাড়াতাড়ি পরিবারের সন্ধান পাওয়া যাবে। বাবা বললেন," দারোগা সাহেব যথেষ্ট ভালো মানুষ। দিন-রাত এক করে কাজ করছেন। এতটুকু অহংকার নেই।"
"দারোগা সাহেব বলেছিলেন উনার তনিমার বয়সী একটা মেয়ে আছে।"
"সেজন্যই বোধহয় কে'সটা গভীরভাবেঅনুভব করতে পারছেন। ভালো কথা, তোর মা কোথায়?"
"স্টোর রুম তন্নতন্ন করে কিসব খুঁজছে। জিজ্ঞেস করতে কিছু বললো না।"
"এই মহিলার ব্রেইন মাঝেমধ্যে ঢিলে হয়ে যায়। কি আর করার! এমন সুন্দর বিকেলে ময়লা ঘাটাঘাটি করছে। অসহ্য!"
"মা ময়লা ঘাটাঘাটি করলে তোমার কি? মা'কে কি কিছু বলবে বাবা?"
"বিশেষ কিছু না। চা খেতে ইচ্ছে করছিল। সাকেরা বু চা বানাতে পারে না৷ চায়ের ওপর সর ভাসে। কোনদিন চিনি দিয়ে শরবত বানিয়ে ফেলে কোনদিন চিনি ছাড়া তেতো চা।"
"আমি বানিয়ে দেবো বাবা?"
বাবা অবাক হয়ে বললেন," তুই চা-ও বানাতে পারিস নাকি? কোথা থেকে শিখলি?"
"চা বানাতে শেখা লাগে নাকি? তুমি বসো আমি বানিয়ে আনছি।"
মা'য়ের রান্নার পরিপাটি করে সাজানো। কোথাও বিন্দুমাত্র ময়লা নেই। দিনে দু'বার ধোয়া-মোছা করা হয়। মা অপরিষ্কার জায়গায় রান্না করা খাবার খেতে পারে না। চা পাতা, চিনি সবকিছু হাতের কাছেই ছিল। এক টুকরো লেবু চিপে চায়ের ভেতর দিয়ে দিলাম। চা চামচের দেড় চামচ চিনি। বাবা চা-টা মুখে দিয়ে বললেন," বাহ! দারুণ বানিয়েছিস তো! ভালো লাগছে খেতে।"
সহজ গলায় বললাম," তরল জিনিস খাওয়া যায় না। পান করতে হয়। আজকেই বইয়ে পড়লাম।"
বাবা হাসলেন। শব্দ করে হাসলেন। সেই হাসি দেখতে আমার খুব ভালো লাগলো।
স্টোর রুমের জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে৷ মা ঘেমে টেমে অস্থির। কোমরে কাপড় গুঁজে নিয়েছে।
"কি এতো খোঁজাখুঁজি করছো?"
"কিছু না। যা এখান থেকে।"
"বাবা তোমায় ডাকছিল, চা খেতে চাচ্ছে।"
মা ঝাঁঝালো গলায় বললো, " রাত-দিন চা চা করে মাথা খারাপ করে দেবে। ক'দিন ধরে বাড়ি থেকে নড়ছেও না। সাকেরা বু-কে গিয়ে চা করে দিতে বল। নাকি সে-ও চলে গেছে?"
"চলে গেছে।"
"আজ-কাল কেউ আমায় পাত্তা দিচ্ছে না। কারো কাছেই আমার কথার দাম নেই। তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা এখান থেকে।"
মা'য়ের স্টোর রুম মিশন শেষ হলো রাত নয়টায়। শাড়ি হাতে বাথরুমে ঢুকতে ঢুলতে বললো," তনিমাদের ওখানে গেছিল নাকি? তোর বাপ গেছিল?"
"না কেউ যায়নি। বাবা লাইব্রেরিতে বসে চা পান করছেন। সাথে তার বিখ্যাত তিন দিনের বাসি খবরের কাগজ।"
মা অবাক হয়ে বললো," চা পেল কোথায়? নিজে বানিয়েছে?"
"আমি বানিয়ে দিয়েছি।"
"তুই চা-ও বানাতে পারিস।"
"পারি।"
মা আর কিছু বললো না। বাথরুমে ঢুকে গেল। আমি পা টিপে টিপে স্টোর রুমের দিকে গেলাম। এখানে কি এমন কাজ করছিল মা? স্টোর রুমে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। আজ-কাল সব কিছুতেই কেমন সন্দেহ হয়! সবাইকে নিজের শত্রু মনে হয়। ডাক্তার সাহেব নিশ্চয়ই এর চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো জে'লে আছেন।
রাতের খাওয়া শেষে মা আমার ঘরে আসলো। হালকা গলায় বললো," তোকে একটা জিনিস দিতে এলাম।"
"কি জিনিস মা?"
"পদ্মর ডাইরি। আমার কাছে ছিল। পাছে যদি কখনও তোর হাতে পড়ে তাই লুকিয়ে রেখেছিলাম। স্টোর রুমেই ছিল। আজ খুঁজে পেয়েছি।"
কালো কভারে মোড়ানো একটা ডাইরি। ডাইরির ওপর খুব সুন্দর করে 'পদ্মকাঁটা' লেখা। তার নিচে একটা তারিখ লেখা '০২-১২-২০০৭'। মা বললো," পদ্ম এ বাড়িতে আসার দু'দিন পর এই ডাইরিটা কিনে দিয়েছিলাম। তোর মা লিখতে খুব ভালোবাসতো।"
"তুমি লিখতে খুব ভালোবাসো। তাই না মা?"
মা চোখ মুছলো। ধরা গলায় বললো," আমার কথা থাক। তুই শুয়ে পড়। জীবনের সব কথা লুকিয়ে রাখা যায় না। পাতা ছিঁড়ে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও তা জোয়ারে ফেরত আসে।"
"একটা কথা বলবো?"
"বল।"
"ডাইরির ওপর এই তারিখটা লেখা কেন?"
"পদ্ম লিখেছিল ডাইরি হাতে পেয়ে।"
"কিন্তু আমার বয়স তো তেরো বছর?"
"সেটা কাগজে কলমে। সঠিক হিসাব ষোলো বছর চার মাস একদিন। যখন তোর ছয় বছর বয়স তখন তোর বড় একটা অসুখ হয়েছিল। স্কুলে ভর্তি করতে পারলাম না। রাত-দিন তোকে নিয়ে হাসপাতালে থাকতে থাকতে একসময় আমিও অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বয়স বেড়ে গেল, তোকে স্কুলে ভর্তি করতে পারলাম না। তারপর তোর বাবা বিস্তর ধরাধরি করে জন্ম নিবন্ধন কার্ডে বয়স কমিয়ে এনেছে।"
"আমি তো এসবের কিছু জানি না।"
"ইচ্ছে করেই তোকে জানানো হয়নি। আমরা কখনও চাইনি তুই এসব জানিস।"
মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ক্লান্ত গলায় বললো," আমি কি তোর কাছে ঘুমাতে পারি?"
"পারো।"
"আচ্ছা বেশ। শুয়ে পড়লাম। বাতি নিভিয়ে দে।"
বাতি নিভিয়ে মা'য়ের পাশে বসলাম। কপালে হাত রাখলাম। জ্বরজ্বর মনে হচ্ছে।
"তোমার তো জ্বর এসেছে। ওষুধ খেয়েছো?"
"না। তেমন কিছু হয়নি। ঘুমিয়ে পড়।"
আমি ঘুমালাম না। অনেক রাত পর্যন্ত মা'য়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। এই মানুষটা আমায় কত ভালোবাসা। মা'য়ের মততার এতটুকুও কমতি নেই। নিখাঁদ ভালোবাসা।
ডাইরিটা বের করলাম। পড়তে সাহস পাচ্ছি না। তবুও যে আমায় পড়তেই হবে।
প্রথম পৃষ্ঠা
আজ চার দিন হলো নিজের শহর ছেড়ে এসেছি। অচেনা শহরের অচেনা মানুষের বাড়িতে বসতি গড়ার চেষ্টা। শহর ছাড়ার আগে শেষবার মা'য়ের সাথে দেখা করতে গেছিলাম। তিনি আমার সাথে দেখা করেননি। দরজা আটকে কড়া গলায় বলেছেন, পদ্মা নামে তার কোন মেয়ে নেই। তুমি চলে যাও। চলে যাও এখান থেকে।"
করুণ সুরে বললাম," মা আমি তো তোমারই মেয়ে। শেষবারের মতো তোমায় এক পলক দেখতে চাই।"
মা হাসলেন। উঁচু শব্দের হাসি। বিদ্রুপ করে বললেন," আমার মেয়ে কোন অপরাধীকে বাঁচাতে পারে না। প্রেমের মোহে অন্ধ হয়ে নারী পা'চা'রকারীর সাথে ঘর বাঁধতে পারে না। তুমি চলে যাও পদ্মা। পুরো পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে তুমি একজনকে পেতে চেয়েছো এবং তুমি তাকে পেয়েছো। দুঃখ করো না। জীবন মানুষকে সব দিক থেকে পরিপূর্ণ হতে দেয় না।"
মা'য়ের কথার জবাব দিতে পারিনি। মা তো কিছু ভুল বলছেন না। সত্যি তো! সবকিছুর বিনিময়ে দিলুকে পেতে চেয়েছিলাম। আমি তাকে পেয়েছি। তার সন্তান আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে৷ আজ-কাল খুব স্পষ্টভাবে ছোট প্রাণটাকে অনুভব করতে পারি। এই পৃথিবীতে আমার আর কিছুই চাওয়ার থাকতে পারে না।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা
আজ দিলুর ব্যবহার অন্যরকম লাগলো। খুব বাজে ভাষায় দু'টো গা'লা'গা'ল দিয়েছে। এটা তো আমার প্রাপ্য ছিল না। নাকি এটাই আমার প্রাপ্য। নিজেকে অনেকটা পঁচা নর্দমার মতো লাগছে। খুব ইচ্ছে করছে কিছু কথা লিখি। কিন্তু কলম চলছে না।
তৃতীয় পৃষ্ঠা
আজ সন্ধ্যায় দিলু আমার কাছে মাফ চাইলো। মাফ চাওয়ার ধরনটা খুবই অদ্ভুত। পা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মাফ না করা পর্যন্ত ছাড়বে না। তখন নাকি ওর মাথা খারাপ ছিল। ভুলে করে বলে ফেলেছে। আমিও মাফ করে দিয়েছি। ওর ওপর রাগ করে থাকা যায় না। সবার জীবনেই বোধহয় এমন একটা মানুষ থাকে যার ওপর রাগ করে থাকা যায় না।
রাতের বেলা দিলুর সাথে খুব সুন্দর সময় কাটলো। আমার খোঁপায় একগুচ্ছ হাসনাহেনা ফুল গুঁজে দিয়ে বললো," আমাদের যেন একটা মেয়ে হয়। তাহলেই আমি খুব খুশি।"
অল্প হাসলাম। আমারও মনে হয় যে আমাদের মেয়ে হবে। বেনি দুলিয়ে মা মা করে ডাকবে। মেয়েটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবো। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। ব্যাস একটুকুই!
চতুর্থ পৃষ্ঠা
দিলু আজ কারো সাথে কথা বলছিল। আমি যেতেই মোবাইলটা ফেলে দিলো। আমতা আমতা করে বললো,"তুমি এখানে? ছাঁদে ছিলে না?"
মাথা নাড়লাম। স্বাভাবিক গলায় বললাম,"তুমি কি অসুস্থ? কাছে এসো দেখি।"
দিলুর হার্টবিট বেড়ে গেছে। কার সাথে কথা বলছিল? তাছাড়া আমায় দেখে এতো ভয় পাওয়াই বা কি আছে? মনটা কু ডাকছে। আল্লাহ না করুক কোন বিপদ হবে না তো? দিলু আবার ওই পথে ফিরে যাবে না তো? না না ও এমন করতে পারে না।
পঞ্চম পৃষ্ঠা
শেষ পর্যন্ত আমার সন্দেহই সত্যি হলো। দিলু আগের পথে ফিরে যাচ্ছে। মঈনুল নামে এক লোকের সাথে ব্যাপারে কথা বলছিল। ওদের কথার সবটা শুনে ফেলেছি। বাবুটা দুনিয়ার আসার সময় ঘনিয়ে আসছে। কি করবো আমি?
রাতের বেলা ডাইরি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছিলাম। হঠাৎ করে শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। মা খেতে ডাকছে। আজকের নাস্তা পাউরুটির সাথে তেঁতুলের আচার। বাবা গোমড়া মুখে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছেন। মা পানি আনতে গেছে। বাবা আমার দিকে ঝুঁকে এসে বিরস মুখে বললেন," এসব খেতে পারবি?"
মাথা নাড়লাম।
"চল তাহলে। বাইরে থেকে খেয়ে আসি। থানা থেকেও একবার ঘুরে আসবো। দারোগা বাবুকে কল দিয়েছিলাম। উনি তোর মা'য়ের খোঁজ পেয়েছেন।"
"কি খোঁজ পেয়েছে?"
"জানি না। গেলেই জানতে পারবি।"
বাইরে যাবো শুনে মা খুব রাগ করলো। কঠিন মুখে বললো, "নাস্তা না করে কোথাও যাবে না।"
বাবা সে কথায় পাত্তা দিলেন না৷ আমার হাত ধরে বেরিয়ে আসলেন।
দারোগা সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। ডান হাতে চায়ের কাপ। হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে হাসি মুখে বললেন," সৈয়দা পদ্মার খোঁজ পেয়েছি। উনি পুলিশে চাকরি করতেন। ২০০৭সালের শুরুর দিকে চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর থেকে কোন খোঁজ নেই।"
বাবা বললেন," উনার ব্যাপারে এ তথ্য কোথায় পেলেন?"
"গতকাল থানায় একজন নতুন কনস্টেবল এসেছে। সিনিয়র মানুষ। উনিই পদ্মার ছবি দেখে চিনলেন।"
আমি বললাম," আমি কি উনার সাথে কথা বলতে পারি?"
দারোগা সাহেব অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, "অবশ্যই পারো মা। অবশ্যই পারো।"
চলবে
No comments