গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১৪
#পদ্মকাঁটা
কলমে: #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-১৪
কনস্টেবলের শক্তপোক্ত চেহারা। মস্ত জুলফি, মুখে এক ধরনের কাঠিন্য ভাব আছে। দারোগা সাহেব বললেন, "আরিফ মিয়া, এই হচ্ছে ডালিয়া। আপনাকে এর কথাই বলেছিলাম। খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। আপনারা কথা বলুন। আমার একটু কাজ আছে।"
আরিফ মিয়া মাথা নিচু করে জ্বি স্যার বললেন। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বিরস গলায় বললেন," আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। চায়ের ব্যবস্থা করতে বলি?"
বাবা ডানে-বামে মাথা দোলাতে লাগলেন। এই প্রথমবার তিনি চা খেতে অস্বীকার করলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগলো। বাবার তো চা হলে আর কিছুই লাগে না। কি জানি বাপু!
মুখোমুখি তিনটে চেয়ার। একটাতে আরিফ মিয়া বসে আছেন। অন্য দুইটায় আমি আর বাবা বসেছি। বাবা সহজ গলায় বললেন, "বাইরে কোথাও বসে কথা বললে হয় না? এই চা কফি খেতে খেতে কথা বলা যাবে।"
আরিফ মিয়া মাথা নাড়ালেন। শান্ত গলায় বললেন, "দারোগা বাবু নেই। থানায় থাকা জরুরী। আপনি একবার এখানকার চা ট্রাই করে দেখতে পারেন। মন্দ নয়!"
বাবা আবারও মাথা দোলাতে লাগলেন।
"আচ্ছা, আপনি মা'কে মানে সৈয়দা পদ্মাকে কিভাবে চেনেন?"
"একসাথে চাকরি করতাম। পদ্মা খুব চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে ছিল। তখন সবেমাত্র চাকরিতে যোগ দিয়েছে। কাজের প্রতি অসীম আগ্রহ। ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো ছিল।"
"মা কেমন ছিল? মানে মানুষ হিসেবে কেমন? খুব ভালো নিশ্চয়ই?"
"ভালো মেয়ে ছিল। হাসি মুখে সবার সাথে কথা বলতো। খুব ভালো মেয়ে।"
"মা'কে নিয়ে আরো কিছু বলুন।"
"তেমন বিশেষ কিছু আমিও জানি না। তবে হ্যাঁ শেষবার ওকে একটা মিশন দেওয়া হয়েছিল, মিশন শেষ করার পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এরপর থেকে আর খোঁজখবর পাওয়া যায়নি।"
"কি মিশন?"
"নারী পা'চা'রকারীদের একটা চক্রকে ধরতে হবে। বেশ বড় ছিল চক্রটা। ভালো চেহারার ছেলেদের দিয়ে অসহায় মেয়েদের প্রেমের ফাঁ'দে ফেলতো। কিছুদিন সাধারণ কথাবার্তা, তারপর প্রেমের প্রস্তাব। মেয়েটার আর্থিক সমস্যা থাকলে টাকা পয়সা দিতো কিছু। ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটাতো। তারপর সুযোগ বুঝে পা'চা'র করে দিতো।
যেসব মেয়েদের এরা টার্গেট করতো তাদের বেশিরভাগ এতিম, মিসকিন, অসহায় অথবা খুব রক্ষণশীল পরিবারের কেউ। এদের নিয়ে থা'না পুলিশ হতো না। হলেও খুব কম৷
পদ্মার কাজ ছিলো ওই দলের কোন ছেলের সাথে প্রেমের অভিনয় করতে হবে। যা বলতে চায় শুনবে, শেষ মুহুর্তে সবাইকে ধরিয়ে দেবে। পদ্মা মিশনটা সফল করতে পেরেছিল। এরচেয়ে বেশি আর কিছুই জানি না।"
"ওহ আচ্ছা। মা'য়ের পরিবারের কাউকে চেনেন?"
"তেমন ভালো চিনি না। তবে তুলসি চিনতে পারে।"
"তুলসি কে?"
"পদ্মার সাথে তুলসিও এই মিশনে ছিল। এখনও পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে৷"
"তুলসির নম্বর দিতে পারবেন বা কোন ঠিকানা?"
"তুলসি আপাতত খুলনায় পোস্টিং। ঠিকানা আছে। দাঁড়াও, কাগজে লিখে দিচ্ছি।"
অত্যন্ত বিনীত গলায় বললাম,"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনার ভালো করুন।"
বাবা শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না।
"বাবা কিছু বলবে?"
বাবা ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠলেন। জড়ানো গলায় বললেন,"হ্যাঁ? না না কিছু বলবো না। একটু কাজ ছিল আমার। থাক। সমস্যা নেই, তুই কথা বল।"
" আমার কথা বলা শেষ৷ কি হয়েছে তোমার?"
"কিছু হয়নি। শরীরটা ভালো লাগছে না। মাথা ব্যাথা করছে।"
"ভালো একটা ডাক্তার দেখাও। কোন জিনিস নিয়ে বসে থাকা উচিত না। পরে দেখবে টিউমার ফিউমার হয়ে গেছে।"
বাবা কিছু বললেন না। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আরিফ মিয়া ঠিকানা লিখে দিয়ে গেছে। খুলনা মেডিকেল কলেজের পাশে ভদ্রমহিলার বাড়ি। একা থাকে৷ সময় করে উনার সাথে দেখা করতে হবে। কিন্তু উনার কাছ থেকে কি জানতে চাইবো? কোন সে সংবাদ যা শোনার অপেক্ষায় বসে আছি। মা তো আর বেঁচে নেই। কখনও আসবেও না। মা'য়ের ক'ব'রটা দেখতে যেতে হবে। বাবাকে বলে দেখবো? উনি কি নিয়ে যাবেন?
থানা থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে দারোগা সাহেব উপস্থিত হলেন। ঝলমলে গলায় বললেন, " দেখুন তো। কাকে নিয়ে এসেছি।"
আমি উনার পিছনে উঁকি দিলাম। একটা মেয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একি! এতো তনিমা! উত্তেজিত গলায় বললাম, "একি! তনিমা তুই! কোথায় ছিলি এতদিন?"
তনিমা কিছু বললো না। মাটির দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। দারোগা সাহেব বললেন, "তনিমাকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাচ্ছি। চাইলে আপনারও যেতে পারেন। সেখানে সব কথা হবে। শওকত সাহেবকে থা'নাতে ডাকা যেত। কিন্তু ইচ্ছে করছে না।"
বাবা কোন কথা বললেন না। আমার হাত ধরে জিপে উঠে বসলেন। আমার বামপাশে তনিমা বসে আছে। একজন মহিলা পুলিশ ওর হাত ধরে রেখেছে। কেউ কোন কথা বলছে না। আমি আগ বাড়িয়ে তনিমার হাত চেপে ধরলাম। তনিমা কোন কথা বললো না। খেয়াল করলাম ওর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে।
আন্টি তনিমাকে দেখে দৌড়ে এলেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে অসংখ্য চুমু দিতে লাগলেন। দৃশ্যটা আমার কাছে ভালো লাগলো। খুব ভালো লাগলো।
শওকত সাহেব বললেন," তনিমাকে কোথায় পেলেন? আমাদেরকে আগে বলেননি কেন?"
দারোগা সাহেব বললেন,"সে অনেক কথা, দাঁড়িয়ে বলতে পারছি না। বসার ব্যবস্থা করুন। চা নাস্তা আনতে বলুন। মিষ্টি আনতে দিন।"
দারোগা সাহেবকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। তার চোখেমুখে বিজয়ের আনন্দ ছড়িয়ে আছে। শওকত সাহেব নিজে গিয়ে চেয়ার নিয়ে আসলেন। পকেট থেকে টাকা বের করে শরিফুলের হাতে দিলেন।
বাবা বললেন,"এবার বলুন। তনিমাকে কোথায় পেলেন? আর আমাদের কিছু জানলেন না কেন?"
"তদন্তের সুবিধার জন্য আমাদের অনেক কথা লুকিয়ে রাখতে হয়। অ'প'রা'ধী ধরা না পড়া পর্যন্ত সবাইকেই স'ন্দে'হের তালিকায় রাখা হয়। এমনকি মা-বাবাকেও!"
"মা বাবাকেও স'ন্দে'হ তালিকায় রাখতে হবে?"
"আজকালকার যুগে কোন কিছুই অসম্ভব না। গতকাল নিউজে দেখলাম এক সেনাসদস্য তার বউ আর এক বছরের সন্তানকে মে'রে ফেলেছে। ঘটনা কতটা সত্যি জানা নেই। তবে সত্যি হলে তো বুঝতেই পারছেন মানুষ কোথায় পৌঁছে গেছে। আবার আপনার মেয়ের কথাই চিন্তা করুন, দিলু কিন্তু তার নিজের বাবা ছিল।"
বাবা একটু মিইয়ে গেলেন। বিব্রত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। শওকত সাহেব বললেন," তনিমাকে কোথায় পাওয়া গেছে?"
"বেনাপোল বর্ডারের পাশে। সম্ভবত ভারতে পাঠিয়ে দিতে চাইছিল।"
আমি বললাম," পনেরো মিনিটের মধ্যে বেনাপোল সীমান্ত থেকে বাগেরহাট চলে এলেন?
"হা হা। ভালো প্রশ্ন। ওখানের পুলিশেরা তনিমাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেছিল। আমি গিয়ে নিয়ে আসলাম।"
"উনারা সোজা থানায় আসলেন না কেন?"
"ওদের কাজ ছিল। আমি জোর করিনি৷ থা'নাটা আমার বাড়ি নয়, ওরাও আত্মীয় স্বজন না। তবে যে যাই বলুক তোমার গোয়েন্দা হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক। ইচ্ছে হলে আমাকে বলতে পারো, ব্যবস্থা করে দেবো।"
চোখ-মুখ লাল করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। শরিফুল ছেলেটা খুব জোরে জোরে হাসছে। এতো হাসির কি আছে? আমি কি গোয়েন্দা হতে পারি না?"
দারোগা সাহেব বললেন,"তনিমাকে মূলত কি'ড'ন্যা'প করা হয়েছিল। পুলিশের নজর এড়ানোর জন্য একটা লা'শকে ওভাবে ফেলে রাখা হয়েছে। লা'শের গায়ে তনিমার জামা-কাপড়, স্কুলের আইডি কার্ড এসব রাখা হয়েছিল। এটা এক ধরনের ধোঁকা। এদিকে পুলিশ লা'শ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, সেই সুযোগে ওরা তনিমাকে পা'চা'র করে দেবে। পরিকল্পনা ভালোই ছিল তবে সফল হতে পারলো না।"
"আপনি এসব জানলেন কীভাবে?"
"তদন্ত করে জেনেছি। প্রথমে হাসপাতাল থেকে জানানো হয় লা'শ চুরি হয়েছে। ওদের বিবরণ শুনে মনে হলো যে লা'শটাকে তনিমার ভাবা হচ্ছে এটা সে-রকম। মিলানোর জন্য শওকত সাহেব ও তার স্ত্রী ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হলো। তারপর হাসপাতালেও কিছু স্যাম্পল ছিল।"
"লা'শটা তো আগেই ক'ব'র দেওয়া হয়ে গেছিলো তাহলে কিভাবে মিলালেন? তাছাড়া রিপোর্ট না মিলিয়ে তো লা'শ দা'ফ'ন করতে দিলেন কেন?"
"রিপোর্ট তো ছিল। সেখান থেকে মিলিয়েছি। তুমি তো পাক্কা গোয়েন্দাদের মতো প্রশ্ন করছো!"
আমি কিছু বললাম না৷ শওকত সাহেব বললেন,"কিভাবে তদন্ত করছেন যদি বলতেন।"
"লা'শটা যেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল ওই জায়গায় একটু খোঁজ খবর করলাম। তনিমা শেষবার ওই সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে দেখা করতে গেছিলো। তারপর সেখান থেকে বেরিয়েও এসেছিল। ওখানের এক দোকানের সিসি ক্যামেরায় ব্যাপারটা ধরা পড়ে।"
"কাজটা অনেক দ্রুত করেছেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। দেরি হলে মেয়েটাকে পা'চা'র করে দিতো। আপনার মতো সৎ পুলিশ অফিসার থাকলে সমাজটা পাল্টে যেত।"
দারোগা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মলিন গলায় বললেন," আমার মেয়েটা বেঁচে থাকলে ওদের মতোই দেখতে হতো।"
"আপনার মেয়ে বেঁচে নেই?"
"না। দু'বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মা'রা গেছে। মেয়ের সাথে দেখা করার জন্যই যথাসম্ভব ভালো কাজ করি৷ আল্লাহ কাছে মাফ চাই। আল্লাহ যেন জান্নাতে আমার মেয়ের সাথে আমাকে মিলিয়ে দেন।"
বাবা শব্দ করে আমিন বললেন।
দারোগা সাহেবের চোখের কোণায় অশ্রু টলটল করছে৷ পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। জড়ানো গলায় বললেন, "আমি উঠি। কাজ আছে।"
"চলে যাবেন কেন? মিষ্টি আনা হয়েছে। মিষ্টি খান।"
"না থাক। অন্যদিন খাবো। আপনাদের থানায় ডাকা হবে। তনিমাকে নিয়ে চলে আসবেন।"
কথাগুলো বলে হনহন করে চলে গেলেন। মনে হয় সবাইকে চোখের পানি দেখাতে চান না। উনি খুব কাঁদছেন। ক্রমাগত চোখ মুছচ্ছেন।
শোকের পরিবেশ নিমিষেই খুশিতে পাল্টে গেছে৷ শওকত সাহেব উঁচু গলায় হাসছেন। বাবার সাথে নানান গল্প করছেন। বাবা তেমন জবাব দিচ্ছে না। মাঝেমধ্যে মাথা দোলাচ্ছেন। তনিমা আন্টির সাথে ভেতরে গেছে, গোসল করবে।
তনিমাদের দরজার পাশে একটা টিউলিপ গাছ। গাছটা দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। গাছে ছোট একটা কলি ফুটেছে। এগিয়ে গিয়ে কলিটাকে ছুঁয়ে দেখলাম। শরিফুল পেছন থেকে উঁচু গলায় বললো, "ফুল পছন্দ কারো?"
"না, পছন্দ করি না।"
শরিফুল ভ্রু কুঁচকে বললো,"ফুল পছন্দ করে না এমন মেয়ে আছে নাকি?"
"জানি না। বলতে পারবো না।"
"তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করো কেন?"
"কেমন ব্যবহার করি? তাছাড়া আমার সাথে আপনার ক'দিন কথা হয়েছে?"
"আজ নিয়ে দু'দিন। তুমি চাইলে এই কথা অনেক দূর এগোতে পারে।"
"আমি চাচ্ছি না।"
"কেন চাচ্ছো না কেন? আমি কি দেখতে খারাপ?"
"জানি না। খেয়াল করে দেখিনি।"
শরিফুল চাপা গলায় বললো,"এখন দেখো। আমি দেখতে খুব একটা খারাপ না। সুন্দর বলার মতো ভালো দেখতে।"
কিছু বলতে যাবে তার আগে নজরে পড়লো ডাক্তার সাহেব হেঁটে আসছেন। তার হাতে ফুলের তোড়া। উনি কখন ছাড়া পেলো? ডাক্তার সাহেব মুচকি হেসে বললেন,"ভালো আছো ডালিয়া?"
আমি হাসলাম। খুব সুন্দর করে হাসলাম। কোমল গলায় বললাম,"হ্যাঁ। ভালো ছিলাম না৷ তবে আপনাকে দেখে ভালো লাগছে। এখন ঝুব ভালো আছি।"
শরিফুল কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
চলবে
No comments