1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১৫

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট-১৫


মা পাউরুটিতে জেলী মাখিয়ে প্লেটে রাখছে। সকালবেলা এই পাউরুটির হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন না কোন উপায় খুঁজতেই হবে। বাবা মুখ গোমড়া করে বললেন, "তনিমাকে থা'নায় ডেকেছে। শওকত সাহেব মেয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরাও যাবে নাকি?"


মা বললো,"গেলে যাওয়াই যায়। নাস্তাটা করে যাই।"


আমি চোখ বড় করে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা হালকা গলায় বললেন, "তোমাকে আর কষ্ট করে নাস্তা বানাতে হবে না। এক কাজ করি চলো। বাইরে কোথাও খেয়ে নিই। কি বলিস ডালিয়া?"


"হ্যাঁ বাবা। বাইরে খাবো।"


মা কঠিন মুখে বললো, "তোমরা বাপ মেয়ে বাইরে খাওয়ার প্লান করলে আমাকে আগে থেকে বলে দেবে। রোজ রোজ খাবার নষ্ট করতে পারবো না। আজকে কেউ বাইরে খেতে পারবে না।"


অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকলাম। বাবা মুখ এতটুকু হয়ে গেছে। মা'য়ের বিখ্যাত পাউরুটি দিয়ে সকালের নাস্তা সম্পন্ন হলো। আজকের পাউরুটি ততটাও খারাপ লাগেনি। 

শওকত সাহেব মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আন্টি শরিফুলের সাথে কথা বলছে৷ শরিফুল খুব হাত নাড়ছে। এই ছেলেটা কেন ওদের পিছনে লেগে থাকে কে জানে। বাবা বললেন,"আপনারা এখনও থানার ভেতর ঢোকেননি?"


শওকত সাহেব বললেন,"না। আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একসাথে গেলে ভালোই হয়।"


"আচ্ছা বেশ। চলুন। দেরি করলে দারোগা সাহেব রেগে যেতে পারেন।"


দারোগা সাহেব ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন আমার মুখের মধ্যে কারো ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। আন্টি বললেন, "দারোগা সাহেব একটু তাড়াতাড়ি করুন। তনিমাকে নিয়ে বেশিক্ষণ থা'নায় থাকতে চাই না।"


"আপনাদেরকে এখানে বসিয়ে রেখে গল্প করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। তনিমার কাছ থেকে অ'প'হ'র'ণের বিষয়টি জানতে হবে বিধায় আপনাদের ডাকা হয়েছে। বিনা কারনে গল্প করার জন্য ডাকিনি।"


আন্টি একটু মিইয়ে গেলেন। শওকত সাহেব বললেন, "তনিমাকে যা জিজ্ঞেস করুন। তবে একটু খেয়াল রাখবেন। বুঝতেই তো পারছেন। বাচ্চা মেয়ে।"


"জ্বি। বুঝতে পারছি। তনিমা তুমি মাঝের চেয়ারটায় বসো।"


তনিমা চেয়ার টেনে বসলো। তার মুখ ভাবলেশহীন। আমার দিকেও খুব একটা তাকাচ্ছে না। দারোগা সাহেব অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, "তনিমা তুমি সুস্থ আছো? মন ভালো আছে তোমার?"


তনিমা মাথা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। চাপা গলায় বললো," জ্বি, আমি ঠিক আছি।"


"এ ক'দিনের কথা মনে আছে তোমার?"


"কিছু কিছু মনে আছে। সব মনে নেই।"


"সবকিছু মনে থাকাটা কাজের কথা না। তারপর বলো, তুমি শেষবার কোথায় ছিলে? কে তোমার কাছে এসেছিল?"


"শেষবার আমি স্কুলে ছিলাম। স্কুল ছুটির পর ভাবলাম ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করে উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসি। দুঃস্বপ্ন দেখা ঠিক হয়ে গেছে। এই কথাটা বললে হয়তো উনি খুব খুশি হবে।"


"হঠাৎ করে ডাক্তার সাহেবকে ধন্যবাদ দেওয়ার ইচ্ছে হলো কেন? কেউ কি তোমায় বলেছিল?"


"হ্যাঁ তো। ক্লাসের দিদিমণি বললেন- কেউ আমাদের উপকার করলে তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা আদর্শ মানুষের একটা গুন।"


"তারপর?"


"তখন আমার মনে হলো ডাক্তার সাহেব আমার অনেক বড় উপকার করেছেন। এ ক'দিন এবারও দুঃস্বপ্ন দেখিনি৷ তাই উনাকে ধন্যবাদ দিতে গেছিলাম।"


"কিভাবে গেছিলে?"


"প্রথমের স্কুলের সামনের দোকান থেকে দু'টো চকলেট কিনলাম। তারপর একটা রিকশা ঠিক করলাম। রিকশাওয়ালা কাকা এই গরমে চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিল।"


"তুমি তার কাছে জানতে চাওনি কেন উনি চাদরে মুখ ঢেকে রেখেছিলেন?"


"চেয়েছিলাম। বললো-অনেক ধূলো। মাস্ক আনতে ভুলে গেছে তাই চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন।"


"তারপর?"


"তারপর উনি অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় থাকি? কিসে পড়ি, বাড়িতে কে আছে সবকিছু।"


"তুমি ঠিকঠিক জবাব দিয়েছিলে?"


"হ্যাঁ।"


"তারপর?"


"তারপর উনি আমাকে ডাক্তার সাহেবের চেম্বারের সামনে নামিয়ে দিলেন। আমি ভাড়া দিতে গেলে নিলেন না। বললেন-টাকা লাগবে না। তুমি যাও।"


"কখনো এমন কাজ করবে না৷ মানুষ পরিশ্রম করে টাকার জন্য। তোমার কাছে টাকা থাকার পরেও যদি কেউ বিনামূল্যে কাজ করে দিতে চায় তাহলে তার উদ্দেশ্যে সমস্যা থাকতে পারে৷ ব্যাপারটা যাচাই করে নেবে।"


তনিমা মাথা নাড়লো। দারোগা সাহেব শান্ত গলায় বললেন,"তারপর কি হলো?"


"তারপর ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে গেলাম। উনি একাই বসে ছিলেন। কথা বললাম, চকলেট দিলাম। ডাক্তার সাহেব আমাকে ভীষণ বকা দিলেন।"


"কেন বকা দিলেন?"


"একা এসেছি কেন সেজন্য।"


" তারপর?"


" তারপর ডাক্তার সাহেব নিজে এসে একটা রিকশা ঠিক করে দিলেন। উনাকে ভাড়া দিয়ে বললেন- সোজা বাড়িতে নামিয়ে দেবে৷ আমার সময় নেই সেজন্য যেতে পারছি না।"


"তুমি বাড়ি গেলে না কেন?"


"ওই রিকশায় কিছুদূর যাওয়ার পর আগের রিকশাওয়ালাকে দেখালাম। উনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছিলেন। আমাকে ডেকে দাঁড় করালেন। আইসক্রিম কিনে দিলেন।"


"তারপর?"


"তারপর জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাচ্ছি। বললাম -বাড়ি যাচ্ছি।"


"কিন্তু তুমি তো বাড়ি গিয়েছিলে না। কোথায় গিয়েছিলে?"


"আমার একটা কলম কেনার দরকার ছিল। তাই মোড়ের মাথায় এসে রিকশাওয়ালা ছেড়ে দিলাম। এই বলে যে দোকান থেকে কলম কেনার পর হেঁটে চলে যাবো। সামনেই আমার বাড়ি। রিকশাওয়ালা আমায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। অবশ্য বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন একা যেতে পারবো কি-না। আমি বললাম পারবো।"


"কখনও এমন কাজ করা উচিত না। নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার পরই রিকশা থেকে নামা উচিত। বিশেষ করে তোমার মতো বাচ্চা মেয়েদের। আজকাল মানুষের দুনিয়া নেই। পি'শা'চের দুনিয়া হয়ে গেছে। যাইহোক তারপর বলো।"


"আমি কলম কিনে ফিরছিলাম তখন ওই চাদরে মুখ ঢাকা রিকশাওয়ালা কাকু আবার এলেন। বললেন- তোমার শরীর খারাপ দেখাচ্ছে চল বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আসি। আমারও মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। তাই রাজি হয়ে গেলাম। তবে উনি বাড়ির দিকে গেলেন না। উল্টো পথে যেতে লাগলেন।"


"তখনও তুমি কিছু বলোনি?"


"বলেছিলাম উনি বললেন দোকান থেকে বাজারের ব্যাগ নিবেন। তারপর আর কিছু মনে নেই।"


"অজ্ঞান হয়ে গেছিলে বোধহয়। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন?"


"যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি হাসপাতালে। আমার পাশে একটা মহিলা ক্রমাগত কাঁদছিল। উনাকে আমি চিনতে পারছিলাম না।"


"অনেক লোক মিলে কাজটা করেছে। তারপর কি কিছু মনে আছে?"


"হ্যাঁ। মহিলা নিজেকে আমার মা বলছিল, আমি সব বুঝতে পারলেও কথা বলতে পারছিলাম না। মুখের মধ্যে কাপড় ঢোকানো ছিল। তারপর মাস্ক পরা। কেউ বুঝতেও পারছিল না। এক পর্যায়ে মহিলাটা আমাকে ধরে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। পাশের বেডের এক মহিলা বললো-কোথায় যান? উনি বললো- টেস্ট করিয়েছিল সেই রিপোর্ট আনতে৷ এরপর উনি আমাকে নিয়ে হাসপাতালের পিছনে চলে আসে। তারপর একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।"


"গোটা সময়ে তুমি কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারোনি? কোন প্রকার ইশারা বা কিছু?"


"না পারিনি। আমার কেমন অদ্ভুত লাগছিল। আর মুখের মধ্যে তো কাপড় দেওয়া ছিল। এরপর কোথায় নিয়ে গেছিল জানি না।"


দারোগা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তরল গলায় বললেন," মানুষ যে কবে মানুষ হবে!"


শওকত সাহেব বললেন," এতো কিছু হয়ে গেল কোন মানুষ ঠিক পেলো না?"


"শওকত সাহেব। আজ-কাল মানুষ নিজেদের নিয়েই খুব ব্যস্ত। হাসপাতালে সবার রুগী থাকে। নিজেদের দেখে সময় পায় না। তবুও অনেকে খুব বিনয়ী হয়। সাহায্য করে। কিন্তু অতোটা খেয়াল করার সময় পায় না।"


বাবা বললেন, "আপনি ভুল বলছেন। হাসপাতালে সবাই খুব ভালো হয়। অনেক পরোপকারী।"


"তা হয় ঠিক। কিন্তু কত সময়? আমার নিজের দেখা আছে, হাসপাতাল থেকে কাপড় চু'রি হচ্ছে। মোবাইল চু'রি হচ্ছে।"


"ভালো কিছু দেখেনি?"


"অবশ্যই দেখেছি। এক রুগী অন্য রুগীর হাত ধরে বেডে পৌঁছে দিচ্ছে। অন্য রুগীর লোক এসে মাথায় পানি দিয়ে দিচ্ছে। ভালো কাজের আড়ালে খারাপ কাজগুলো চাপা দেওয়া যায় না৷ দুটোই পাশাপাশি থাকে।"


শওকত সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, " তনিমাকে খুঁজে পেলেন কিভাবে?"


"খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছি। পুলিশরা অনেক জায়গা থেকে খরব পায়।"


"আপনি কি বলতে চাইছেন না?"


"না। আপাতত বলতে চাচ্ছি না। কিছু মনে করবেন না।"


শওকত সাহেব মাথা দোলাতে লাগলেন। থানা থেকে বেরিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় গেলাম। বাবাই নিয়ে এলেন সবাইকে। শরিফুল আমার দিকে তাকিয়ে ক্রমাগত হাসছে। বিষয়টা আমার ভালো লাগছে না। জীবনে প্রথমবার যাকে ভালো লেগেছিল সে খুব বি'শ্রীভাবে আমায় প্রত্যাখান করেছে। প্রথমে আমার আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছে। বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে দিলু কাকার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তারপর হঠাৎই উনার মনে হলো আমার বয়স কম। অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেন না। 

আচ্ছা আমি কি আবার উনার কাছে যাবো? গিয়ে বললো যে, 'ডাক্তার সাহেব শুনুন। আমার বয়স তেরো নয়। মা বলেছে আমার বয়স ষোল বছর হয়ে গেছে। এখন কি আমাকে বিয়ে করা যায়? তাছাড়া আপনার বয়স কত বছর?  চল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে নাকি? ত্রিশ বছর আহামরি কোন বয়স না। বর্তমান যুগে চাকরি পেতে পেতে অনেক ছেলের ত্রিশ বত্রিশ হয়ে যায়। তাই বলে কি তারা বিয়ে করে না? অবশ্যই করে। খুঁজে খুঁজে কচি মেয়ে বিয়ে করে। আপনি কি তাদের থেকে খুব আলাদা? 


শরিফুল পাশের টেবিলে বসেছিল। আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললো,"একা একা কিসব বলছো? আমাকেও  গালাগাল দিচ্ছো না তো?"


ক্ষীণ গলায় বললাম, "না। আপনাকে গালাগাল দিচ্ছি না।"


চলবে

No comments

Powered by Blogger.