1t/Banner 728x90

গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১৬

 #পদ্মকাঁটা 

কলমে: #ফারহানা_কবীর_মানাল 

পার্ট-১৬


শওকত সাহেব ছোট মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। বলা বাহুল্য মেয়ে ফিরে পাওয়ার আনন্দেই ওনার এই আয়োজন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হবে। সকালের নাস্তা শেষ করে উনার বাড়িতে যাবো।

আজ খাওয়ার টেবিলের পরিবেশ ভিন্ন। মা পাউরুটির বদলে পরোটা বানিয়েছে। ডিম ভাজা, ডাল আর রসগোল্লা। বাবা বললেন, " আজ হঠাৎ তোমার কি হলো? পাউরুটি দেখছি না যে।"


আমি বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মা বললো, "সকাল সকাল পাউরুটি খেয়ে তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে। ওটা পরিবর্তন করা দরকার।"


"তা এসব কি তুমি বানিয়েছ নাকি হোটেল থেকে নিয়ে এলে?"


মা গলায় স্বর পরিবর্তন করে বললো, "আমি কি রান্না জানি না নাকি?"


"জানো। খুব জানো।"


মা হাসলো। বাবাও হাসছেন। সুখী পরিবারের দৃশ্য। তবুও আমার সাথে দৃশ্যটা ভালো লাগলো না। কেমন যেন লোক দেখানো মনে হলো? সত্যি বলতে ভালো কোন জিনিস আমার ভালো লাগে না। আচ্ছা আমি মানসিক রু'গী নয় তো? পৃথিবীর ভালো জিনিসগুলোকে ভালো মনে করতে পারি না। সবকিছুতেই সন্দেহ হয়। কেন হয়? এমন চলতে থাকলে আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাবো নিশ্চয়ই। বাবা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, "এতো কি ভাবছিস? তাড়াতাড়ি কর। যেতে হবে তো।"


"ও হ্যাঁ! খাচ্ছি।"


ডিম ভাজায় লবনের ছিটেফোঁটা নেই তবুও খেতে মন্দ লাগছে না। ভালো লাগছে। মা এখানে নেই। রান্নাঘরে গেছেন। চাপা গলায় বললাম, " বাবা একটা কথা বলবো?"


বাবা পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, " কি কথা?"


"আমি একটু তুলসীর সাথে দেখা করতে চাই। উনি মা'য়ের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারেন।"


"কি হবে দেখা করে? পদ্মা তো আর নেই।"


বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো। ধরা গলায় বললাম, "তবুও!"


বাবা কিছু বলতেন কিন্তু মা আসছে দেখে থেমে গেলেন। মা বললো, "সকাল নয়টার মধ্যে ও বাড়িতে থাকতে হবে। আপা বারবার করে বলে দিয়েছে আমাকে। দু'বার কলও দিয়েছে। বাপ মেয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।"


তনিমাদের বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। অনেকটা বিয়ে বাড়ির মতো লাগছে। শওকত সাহেব কারণে অকারণে ছোটাছুটি করছে। শরিফুল ওবার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। মা আন্টির কাছে গেছেন। বাবা সামনের দিকে বসে আছে। ঘরের মধ্যে অনেক লোক, এতো লোকজন আমার ভালো লাগে না। তনিমাদের পুকুর পাড়টা বেশ সুন্দর, খানিকটা নিরিবিলি জায়গা। পুকুরের পানি পঁচে গেছে বিধায় কেউ এদিকে আসে না। সিঁড়ি বাঁধানো আছে। আমি গিয়ে সিঁড়ির কোণায় বসলাম। আপাতত দৃষ্টিতে আমাকে খুব সুখী মানুষ মনে হয়। মা বাবা নেই তবুও দু'জন মা বাবা পেয়েছি। তারা আমায় নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। দিলু কাকার কাছে চলে যাওয়ার পরও তারা আমায় প্রত্যাখান করেনি। আদরে আগলে নিয়েছে৷ আমার খুব কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু আমি তা পারছি না। কেন পারছি না তা-ও বুঝতে পারছি না।


পুকুরের পানি পঁচে সবুজ হয়ে গেছে৷ হয়তো শৈবাল জন্মেছে। জন্মানোর আকুতি বুঝি মৃ'ত্যুতে গিয়ে বিলীন হয়ে যায়।


"একা বসে আছো কেন?"


পেছন ফিরে দেখি ডাক্তার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে। তার মুখ হাসি-হাসি।


"কি হলো কথা বলছো না কেন?"


"কিছু হয়নি। এমনিতেই। আপনি এখানে?"


"শওকত সাহেব দাওয়াত করেছেন। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তোমার দিকে নজর পড়লো।"


"জে'লে থেকে ছাড়া পেয়েছেন কবে?"


"জা'মি'নে বের হয়ে এসেছিলাম। এখন তো কে'সেই শেষ হয়ে গেছে।"


"আচ্ছা ভালো।"


"শওকত সাহেবের কাছ থেকে তোমার ব্যাপারে শুনলাম। উনি বললেন- তুমি একটু বেশিই পাকনা কথা বলো। দারোগা সাহেব তোমাকে গোয়েন্দা হওয়ার অফার করেছেন। সত্যি নাকি?"


"দেখুন। আমি যেসব কথা বলি তার একটা কথাও আমার নিজের বানানো নয়। এই কথাগুলো আমি আগে-পরে কোথাও না কোথাও শুনেছি। আপনি একাধারে কতগুলো গল্পের বই পড়েন। মুভি দেখেন। দেখবেন আপনার কথা বলার ধরন পাল্টে গেছে। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়।"


ডাক্তার সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন," জ্ঞান দিচ্ছো?"


আমি সহজ গলায় বললাম, " আপনাকে জ্ঞান দেওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই। আমি শুধু নিজের হয়ে সাফাই গাইছি।"


"এটা কি তোমার নিজের কথা?"


"না। এটাও একটা মুভিতে শুনেছিলাম। আমার বলা পঁচানব্বই ভাগ কথা অন্যের বাকিটা আমার নিজের।"


"সেই পাঁচভাগ থেকে একটা কথা বলো তো শুনি।"


"আপনি এখান থেকে যান। অনুষ্ঠান বাড়ি, পুকুরের এদিকটায় কাপড় দিয়ে ঘেরা কেউ দেখলে উল্টো-পাল্টা ভাববে।"


"এটা কি তোমার নিজের কথা?"


"ত্রিশ ভাগ নিজের।"


ডাক্তার সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। কিছু মানুষ হাসলে তাদের এতো সুন্দর লাগে যে ইচ্ছে করে আরো কয়েকটা কথা বলে তাদের হাসিয়ে দিই। ওরা হাসতে থাকুক। আমি চোখ ভরে দেখি। ডাক্তার সাহেব বললেন, "তুমি আমার ওপর রেগে আছো তাই না?"


"না, আমি আপনার ওপর রেগে নেই। রাগ করার মতো কিছুই হয়নি।"


আমাকে অবাক করে দিয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন, "হয়েছে। অনেক কিছুই হয়েছে। আমি জানি তুমি আমার ওপর রেগে আছো।"


"আপনি ভুল ভাবছেন।"


"ডালিয়া! তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি মনের ডাক্তার। মন পড়তে না পারলেও বুঝতে পারি। প্রথম দিকে তোমার মতো আমিও নিজের আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছে। সুন্দরী মেয়েকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে পারিনি। তোমাকে প্রস্তাব দিয়েছি। এমনকি তোমার বাবার কাছে গিয়েও প্রস্তাব দিয়েছে। তারপর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। এখানে আমার প্রচুর দোষ আছে। বলতে পারো অন্যায় করেছি আমি। আমার মতো তুমিও..'


আমি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, " এসব কথা বলে আমাকে বিব্রত করবেন না। আপনি আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, আমি মেনে নিয়েছি। এবং আমি আপনাকে এতটুকু নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে আমার জন্য দ্বিতীয়বার আপনাকে আর জে'লে যেতে হবে না। আমি কোন উল্টোপাল্টা কাজ করবো না।"


"তুমি আমাকে ভুল বুজচ্ছ।"


দৃঢ় গলায় বললাম, "আমি আপনাকে ঠিক বুঝতে পারছি। আপনার বয়স বেশি, শিক্ষিত মানুষ, এজন্য মনে করেন আপনি সব বুঝতে পারেন। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আমি বাচ্চা মেয়ে তাই পারবো না। সত্যি বলতে আমি ততোটাও বাচ্চা না। আমার বয়স ষোলো বছরের বেশি, আট মাস পরে সতেরো বছর হবে। কাজেই আমাকে বাচ্চা ভাবা ভুল।"


"ষোল বছর বয়সেও মানুষ বাচ্চাই থাকে। যাইহোক এটা কি তোমার নিজের কথা?"


"না।"


ডাক্তার সাহেব কিছু বলতে যাবে তার আগে শওকত সাহেব আসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, "ডাক্তার সাহেব কখন এলেন? ভেতর আসেন।"


ডাক্তার সাহেব বললেন, "এইতো একটু আগে। ডালিয়ার সাথে কথা বলছিলাম।"


"কথা শেষ? তাহলে ভেতরে আসুন।"


ডাক্তার সাহেব উনার সাথে চলে গেলেন। শরিফুল দাঁত খিঁচিয়ে বললো, "ওই ডাক্তারটাকে আমার সুবিধার মনে হয় না। কি বলছিল তোমাকে?"


আমি বললাম," কিছু বলছিল না। তাছাড়া উনাকে আমার খুব একটা অসুবিধারও মনে হয় না। উনি আমার ডাক্তার ছিলেন।"


"ওহ! জানতাম না।"


"পৃথিবীর সব জিনিস যে আপনি জেনে যাবেন ব্যাপারটা এমন না।"


শরিফুল হাসলো। লজ্জা মাখা হাসি। দেখতে ভালো লাগলো না। দু'জন পুরুষের কি অদ্ভুত বৈপরীত্যে! 


খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতে বিকেল হয়ে আসলো। বাবা বললেন, "ডানিয়ার মা শোনো। তুমি এখানে কিছুক্ষণ থাকো। আমি ডালিয়াকে নিয়ে একটা জায়গায় যাচ্ছি। সন্ধ্যার আগে চলে আসবো।"


মা বললো, "কোথায় যাবে?"


"সুজন সাহেব আসবে।"


মা কিছু আর জিজ্ঞেস করলেন না। সুজন সাহেব বাবার সাথে মাছের ব্যবসা করেন। বাবা সুজন সাহেবের সাথে দেখা করলেন না। আমাকে নিয়ে খুলনার বাসে উঠে বসলেন। সরু গলায় বললেন, "তুলসীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমার কথা হয়েছে। কি কি জানতে চাইবে ঠিক করে নাও। বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।"


আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালাম। বাবার মুখ ভাবলেশহীন। 

তুলসী আন্টি বেশ আন্তরিক। প্রথম দেখায় আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আদুরে গলায় বললেন, "পদ্মার মতো দেখতে হয়েছে। তিলটা একদম পদ্মার মতো।"


বাবা বললেন, " কিছু অর্ডার করুন। রেস্তোরাঁয় এসে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে না।"


আন্টি কিছু অর্ডার করলেন না। ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করতে করতে বললেন, "ডায়েট করছি। আপনারা খান।"


আমি বললাম, "একটা কথা বললেন?"


শশায় কামড় দিতে দিতে উনি বললেন," কি কথা মা?"


"মা'য়ের দিলু ছাড়া অন্যকারো সাথে সম্পর্কে ছিল নাকি?"


"একদম না। শুধু দিলুর সাথেই সম্পর্ক ছিল।"


"আপনি নিশ্চিত জানেন?"


"হ্যাঁ, নিশ্চিত জানি।"


"দিলু আমাকে বলেছিল- মা'য়ের অন্যকারো সাথে সম্পর্ক আছে।"


"মিথ্যে বলেছে। কারো সাথে সম্পর্ক ছিল না। বরং ওই দিলুটাই খারাপ ছিল।"


আমি ছোট করে আচ্ছা বললাম। বুকের ওপর থেকে পাথর নেমে গেছে৷ এখন নিজেকে হালকা লাগছে। খুলনা থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। তুলসী আন্টি খুব ভালো মানুষ। আসার আগে আমাকে কতগুলো ফুল কিনে দিলেন। বাবা আমায় নিয়ে সোজা বাড়ি ফিরলেন না। অন্য কোথাও নিয়ে গেলেন। মসজিদের পাশে সারি সারি ক'ব'র। বাবা ভাঙাচোরা একটা কবরের দিকে হাতের ইশারা করে বলেেন," এটা তোমার জন্মদাত্রী মা'য়ের ক'ব'র।"


ক'ব'রের দিকে তাকালাম না। তাকালাম বাবার মুখের দিকে। বাবার মুখে ল্যামপোস্টের আলো এসে পড়ছে। সেই আলোয় তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। শুধু চেহারা দিক থেকে নয় মন দিক থেকেও সুন্দর। খুব সুন্দর। এই মানুষটা কেন আমার নিজের বাবা হলো না? আল্লাহ কি আমায় উনার সন্তান বানাতে পারতেন না?


চলবে

No comments

Powered by Blogger.