গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১৭
#পদ্মকাঁটা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১৭
আমার স্কুল ব্যাগটা তনিমাদের বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম। কোথাও গেলে এই জিনিসটা সবসময় আমার সাথে থাকে।
ব্যাগের মধ্যে ছোট্ট একটা চিরকুট পেয়েছি। তাতে সুন্দর করে 'ভালোবাসি' লেখা। সাথে একটা মোবাইল নম্বর। বুঝতে বাকি রইলো না এটা শরিফুলের কাজ। ছেলেটার হাবভাব আমার একটুও সুবিধার মনে হয় না। সারাক্ষণ আঠার মতো পেছনে লেগে থাকে। মা'য়ের মোবাইলটা নিয়ে বাগানের চলে এলাম। এসময়ে কেউ এদিকে আসবে না। মা রান্না করছে, বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন৷ দু'জনেই নিজের মতো ব্যস্ত। দু'বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে একটা ছেলে বললো, "আমি জানতাম তুমি কল দিবে।"
" কে আপনি?"
"অচেনা মানুষকে কল দিয়েছেন কেন মেডাম? যদি বিপদে পড়েন?"
"চেনা-অচেনার কথা নয়। আমার ব্যাগে একটা চিরকুট পেয়েছি। তাতে আপনার নম্বরটা লেখা। তাই কল দিলাম।"
"নম্বর পেলেই যে কল দিতে হবে তেমন কথা তো নেই।"
কড়া গলায় বললাম,"শরিফুল সাহেব! এসব হেয়ালি আমার একদম ভালো লাগে না। আপনি এসব বলেছেন কেন?"
শরিফুল ভাবলেশহীন গলায় বললো, " সবকিছু বোঝার পর কে আপনি এই প্রশ্নটা করার মানে কি? যদি চিরকুটের কথা বলো তাহলে বললো আমি আমার মনের কথা স্বীকার করেছি। মনের কথা নিশ্চয়ই দোষের নয়?"
"না, মনের কথা স্বীকার করা দোষের নয়।"
"তাহলে?"
"কোন তাহলে টাহলে নেই।"
"ডালিয়া শোনো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। অসম্ভব ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।"
"আমি আপনার সাথে একবার দেখা করতে চাই। কোথায় দেখা করতে পারবেন?"
"তোমার স্কুলের সামনে?"
"ঠিক আছে।"
"তোমার স্কুল দশটার দিকে শুরু হয়। আমি নয়টার সময় আসবো।"
"ভালো থাকবেন।"
"আরও কিছুক্ষণ কথা বলি?"
কঠিন গলায় বললাম, "না।" শরিফুল কল কেটে দিলো। আজকাল গল্প পড়ার অদ্ভুত নেশা জেগেছে। রাতেও রূপার আংটি' নামে একটা গল্প পড়লাম। গল্পের নায়ক নিরব। ছেলেটার কাজকর্মগুলো আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। উদ্ভট স্বভাবের ছেলে, রাস্তায় গল্পের বই পড়তে পড়তে হাঁটে। বাবা নেই, মামার বাড়িতে মানুষ। বড় মামার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা। সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন হোস্টেল থেকে বাড়ি ফেরার পথে জানতে পারে সেই মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে। যাওয়ার আগে একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে৷ নিরবকে সে বিয়ে করতে পারবে না। সে-ই চিঠি পড়েও নিরব তাকে অবিশ্বাস করতে পারেনি। ভালোবাসার মানুষকে কতটা বিশ্বাস করলে সবকিছু তুচ্ছ করা যায় গল্পটা না পড়লে বুঝতেই পারতাম না। প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া বাগদত্তাকে কেউ এভাবে খোঁজ করতে পারে জানা ছিল না। গল্পটা মানাল নামের একটা মেয়ের লেখা। কি অদ্ভুত নাম! মানাল কারো নাম হয় নাকি!
শরিফুল স্কুলের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে দু'টো গোলাপফুল। প্রেমের প্রস্তাব দিতে ফুল লাগে কেন? শুধু মুখে ভালোবাসি বলা যায় না? কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
শরিফুল বললো, "তুমি এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।"
"কিসের জন্য রাজি হয়ে যাবো?"
শরিফুল লজ্জা পেয়ে গেল। নিচু গলায় বললো, "কিছু না। তুমিও না কিসব প্রশ্ন করে বসো।"
"শরিফুল সাহেব?"
"বলো।"
"বিয়ে করবেন আমাকে?"
শরিফুল চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালো। বিস্মিত গলায় বললো, "বিয়ে করবো মানে?"
"আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন। তাই জানতে চাইলাম বিয়ে করতে পারবেন কি-না?"
"বিয়ে তো নিশ্চয়ই করবো। আগে বিয়ের অনুমতি পাই। একুশ বছর হতে এখনও অনেকদিন বাকি। বয়স হোক তখন দেখা যাবে।"
"বিয়ের জন্য অনুমতি লাগে প্রেম করার জন্য অনুমতি লাগে না?"
শরিফুল চোখ ছোট করে আমার দিকে তাকালো। আমি হালকা গলায় বললাম," বিয়ের বয়স যেহেতু হয়নি তাহলে কাগজে কলমে বিয়ে করার দরকার নেই। এমনি ঘরোয়াভাবে সবার উপস্থিত কলেমা পড়ে বিয়ে হবে। আপনি আপনার বাড়ি থাকবেন আমি আমার বাড়িতে থাকবো। মাঝেমধ্যে দেখা হবে। এমনি টুকটাক কথাও বললাম। তারপর বিয়ের বয়স হলে তখন ঘটা করে বিয়ে হবে। তখন সংসার শুরু করবো। করবেন বিয়ে? আমি আমার বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফেলবো।"
শরিফুল আমতা আমতা করে বললো, "বিয়ে করে বউকে খাওয়াবো কি? তাছাড়া আমার তো এখনও বয়স হয়নি। আগে কিছুদিন রিলেশন কন্টিনিউ করি। তারপর না হয় এসব নিয়ে ভাবা যাবে।"
আমি হাসলাম। বরফ শীতল গলায় বললাম, "শরিফুল সাহেব। লোক দেখানো ভালোবাসা আমার চাই না।"
শরিফুল ভ্রু কুঁচকে বললো, "কোনটা লোক দেখানো ভালোবাসা? হাজার মানুষ আছে যারা রিলেশনশিপ বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে গেছে। কত-শত সম্পর্ক পূর্ণতা পেয়েছে। এগুলো নিশ্চয়ই লোক দেখানো ভালোবাসা না।"
"যেগুলো পূর্ণতা পায়নি? সেগুলোর কি হবে? এমন অনেক ছেলে-মেয়ে আছে যারা শেষ পর্যন্ত প্রেমিককে বিয়ে করতে পারেনি। একজনকে বেইমান খেতাব দিয়ে অন্যের সাথে সংসার করছে।"
"বিয়েতেও কিন্তু ডিভোর্স হয়।"
"হলে হয়। এসব আলোচনা আমার ভালো লাগছে না। আমি আপনার সাথে কোন প্রকার প্রেমের সম্পর্কে রাজি না। যদি বিয়ে করতে চান তাহলে পরিবার নিয়ে আমার বাড়িতে আসবেন। আমি বাবাকে বলে রাখবো।"
শরিফুল বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আমি কিছু না বলে স্কুলের ভেতর ঢুকে গেলাম। প্রেম করতে কোন সমস্যা নেই, বিয়ে করতে গেলেই যত সমস্যা। দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা সবার থাকে না। সকালবেলা মা'য়ের মোবাইলে একটা ভিডিও দেখলাম - কয়েকটা ছেলে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। 'প্রেম করে কাপুরুষ, বিয়ে করে বীরপুরুষ!'
কথাগুলো আমার কাছে বেশ ভালোই লাগলো। তাছাড়া প্রেমের ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন চু'রি চু'রি লাগে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা, চুপিচুপি কথা বলা। সত্যি বলতে লুকোচুরি ভালো লাগে না।
একটা ক্লাসেও মনোযোগ দিতে পারলাম না। সমাজ মেডাম কিসব বকবক করছেন বুঝতে পারছি না। এটাই শেষ পিরিয়ড। বিরক্ত চোখে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। মেডাম বললেন, "ডালিয়া দাঁড়াও।
ভদ্র মেয়ে মতো উঠে দাঁড়ালাম। মেডাম কোমল গলায় বললেন, " শুনলাম তুমি অসুস্থ ছিলে৷ ঠিক আছো এখন?"
"জ্বি মেডাম। এখন ঠিক আছি।"
"তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ। স্কুলে এসে তোমার কথা বলে গেছিলেন। যাইহোক বসো।"
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। বাবার বোধহয় এমনই হয়!
স্কুলের সামনের ডাক্তার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। খুব সুন্দর দেখতে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছেন। মেয়েটা খুব হাসছে। কেমন যেন একটা চাপা কষ্ট অনুভব করতে লাগলাম। বারবার এই লোকটার সাথে দেখা হয় কেন? আমি তো উনাকে দেখতে চাই না। একটুও দেখতে চাই না। ডাক্তার সাহেবকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম হঠাৎ উনি ডাক দিলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, "কেমন আছো?"
"ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?"
"এইতো ভালো। কেমন চলে সব?"
আমি কিছু বলার আগে উনার সাথে থাকা মেয়েটি প্রশ্ন করলো, "মেহেদী এই মেয়েটা কে? তুমি ওকে কিভাবে চেনো?"
ডাক্তার সাহেব বললেন, "কেউ না। কিছু সমস্যা নিয়ে চেম্বারে এসেছিল।"
কঠিন মুখে বললাম,"কেউ না তো ডেকে জিজ্ঞেস করছেন কেন কেমন আছি? আমি কি নিজে থেকে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি নাকি?"
মেয়েটা বললো, "এই মেয়ে তুমি এমন রিয়াকশন করছো কেন? মেহেদী কি এমন বলেছে?"
কড়া গলায় বললাম, "আপনার মেহেদী কি বলেছে শোনেননি নাকি? আমাকে এ ধরনের কথা বলার মানে কি?"
"কি এমন বলেছে তোমাকে?"
কথার জবাব দিলাম না। পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করলাম।উনি কয়েকবার পিছন ডাকলেন। ফিরে তাকালাম না। আমার কিছু ভালো লাগছে না। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। একবার মনে হচ্ছে ম'রে যাই। মানুষ শুধু শুধু বেঁচে থাকে কেন? কি এমন আছে এই পৃথিবীতে? কষ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। কিছুই না।
বাড়ি ফিরে দেখি মা বাবার সাথে ঝগড়া করছেন। বাবা নাকি কোন মেয়েকে নিয়ে রিকশায় ঘুরেছেন। মা'য়ের এক বান্ধবী তাকে কল দিয়ে সে কথা বলেছে। বাবা মা'কে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কিন্তু মা কোন কথা শুনতে রাজি না। বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম। খুব ক্লান্ত লাগছে। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। ছোটবেলা থেকে এই রোগটা আমায় কুঁড়ে কুড়ে খায়। মাঝেমধ্যেই শরীর ছেড়ে দেয়। খুব ক্লান্ত লাগে। দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে আছে। কি তীব্র সেই ঘুমের তেষ্টা! ইচ্ছে করে হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকি।
পৃথিবীতে কত জিনিস আবিষ্কার হয়। মানুষ চাঁদেও যায়। মন নিয়ন্ত্রণ করার মেশিন আবিষ্কার হয় না কেন? মনে কষ্ট যে সহ্য করা যায় না।
বিকট শব্দ ঘুম ভাঙলো। বিছানায় উঠে বসলাম। মা বাবার মাথায় ফুলদানি দিয়ে আ'ঘা'ত করেছে। র'ক্তে সারা ঘর ভিজে যাচ্ছে। বাবা দু-হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে আমায় ডাকছেন। সেই কন্ঠস্বর খুব হালকা, বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কথাগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। আমার ওঠা উচিত, এম্বুলেন্স ডেকে বাবাকে হাসপাতালে নিতে হবে। বাবার পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে যায়নি। কিছুটা জ্ঞান আছে। এই মুহুর্তে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো বেঁচে যাবেন। কিন্তু আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না। শক্তিহীন হয়ে পড়েছি একদম। বিছানায় শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
চলবে
No comments