গল্প পদ্মকাঁটা পর্ব ১৮ সমাপ্ত
#পদ্মকাঁটা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট
আমি ডালিয়া। বহু যত্নে বেড়ে ওঠা ফুলের নামে আমার নাম। মনোরম পরিবেশে দক্ষিণা হওয়ায় দুলতে থাকা ফুল। যার সৌন্দর্য সবাইকে আর্কষণ করে। তবে আমার সৌন্দর্য কারো হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। একদিন মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। সেই থেকে শুরু। শান্ত সাগরের জলোচ্ছ্বাসের মতো উথাল পাথাল ঢেউ। সেই ঢেউয়ের মাঝে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে চোখে সামনে অনেক অজানা সত্যি ভেসে উঠেছে। কষ্টে ম'রে যেতে ইচ্ছে করেছে৷ তবে আমি হেরে যাইনি। সব কষ্টগুলোকে বুকের ভেতর দা'ফ'ন করে হাসি মুখে কথা বলেছি৷ লোককে দেখিয়েছি আমি পাথর। আমার হৃদয়ে র'ক্ত'ক্ষ'র'ণ হয় না। তবুও যেন নিজেকে পাথর দেখানোর চেষ্টাই আমাকে বারেবারে পাথরের আঘাত দিয়েছে।
আমি ডালিয়া। কালো চাদরে আবৃত সত্যির খোঁজে ব্যাকুল হয়ে থাকা ডালিয়া। যার গুরুগম্ভীর কথাগুলো পৃথিবীর কোন মানুষের কাছে ভালো লাগেনি। যাকে কেউ পছন্দ করেনি। যার কষ্ট কারো হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম হয়নি। সেই ডালিয়া। তেরো বছর বয়সেই জানতে পারি আমার বয়সটাও ভুল। পিতামাতার পালিত সন্তান। আসল বয়স ষোল বছর চার মাস একদিন! মা'য়ের মুখে এ কথা শুনে বিচলিত হয়নি। ভেবেছি! তিন বছর চার মাস একদিনের পথ এক মুহূর্তে পাড়ি দিয়ে নিজেকে চিনে নিয়েছি। কষ্টগুলোকে বাক্সে বন্দী করে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছি। সেই কষ্টের বীজ থেকে গাছ জন্মেছে। ফুল ফুটেছে। প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে অন্তর আত্মায়।
দিলু! এ এক নে'ম'ক'হা'রা'ম লোক! যাকে আমি বাবার মতোই সম্মান করেছি। আদুরে গলায় কাকা ডেকেছি। দিন শেষে সে-ই আমার জন্মদাতা পিতা হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিজের মেয়েকে দু'বার বিক্রি করতেও যার হৃদয় কাঁপে না সেই পিতা। নিজের মেয়ের চোখে অ'শ্লী'লতার ছাপ এঁকে দিয়ে হাসিমুখে ঘুরে বেড়ানো পিতা। সন্তারের ওপর কা'লো'যা'দু করে তাকে নিজের বশে আনতে চাওয়া পিতা। এই লোকটা বাবা নামের কলঙ্ক! আমি তাকে প্রচন্ড রকমের ঘৃ'ণা করি।
শুনেছিলাম মানুষের জীবন নাকি নদীর মতো। সমানতালে চলতে পারে না৷ পথ বদলায়। আসলেই তাই! সেদিন ঘুম ভেঙে দেখি বাবা মা'য়ের চুলে আ'গু'ন লাগিয়ে দিয়েছে। দিলু কাকা জানলো- অবস্থা বেশি ভালো না। রাতের বেলা ঘরের মধ্যে আ'গু'ন দেখেছে৷ এগুলো ভূত-প্রেতের কাজ। বাড়ি বন্ধক দিতে হবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। ভেবেছিলাম সে সত্যি বলছে।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা দিলু কাকার সাথে এক বিছানায় শুয়ে আছে। পরক্ষণেই কেউ কোথাও নেই। সব জায়গা ফাঁকা। তীব্র যন্ত্রণাদায়ক এই কষ্ট থেকে মুক্তির আশায় বাবা আমাকে এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলেন। থমকে গেলাম! মানুষ এমন সুন্দর করে কথা বলতে পারে? আর কোনদিন অন্য কারো কথায় কি এতোটা মততা জড়িয়ে থাকবে? চৈত্রের শেষে এক পশলা বৃষ্টির মতো কৈশোর হৃদয় ভিজেছিল ভালোলাগার অনুভূতিতে! সে-ই আমার প্রথম প্রেম, শেষ ভালোবাসা! তাকে দেখার পর আর কাউকেই ভালো লাগেনি।
এই ভালোবাসার মানুষটাও আমায় কম কষ্ট দেয়নি। আবেগ দেখিয়ে কাছে টেনেছে, বিবেক দেখিয়ে ছুড়ে ফেলেছে। বয়সের দোহাই দিয়ে দূরে সরে যেতে চেয়েছে৷ তবে তার চেষ্টা সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে নিজের করে নিতে পেরেছি। সে আমায় ছেড়ে যেতে পারেনি৷ এগারো বছর আট মাস খুব কম না হলেও আহামরি কিছু বেশি নয়। অনন্ত ভালোবাসার কাছে কিছুই না। কে বলতে পারে? বিশ বছর বয়সে পয়ত্রিশ বছর বয়সী কোন সরকারি চাকরিজীবীর সাথে আমার বিয়ে হতো না? অথবা আঠাশ ছুঁইছুঁই মেয়ের জন্য চল্লিশ বছরের পাত্র খোঁজে হাঁপিয়ে যাওয়া সমাজের কাছে বয়স একটা সংখ্যামাত্র। বারো বছরের যে ছেলেটা মায়ের গুছিয়ে রাখা টিফিনবাক্স নিয়ে স্কুলে যায়, বয়সটা তার কাছে সোনার হরিন। এ তার রঙিন শৈশব। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। অন্যদিকে যে ছেলেটা পিঠে বস্তা ঝুলিয়ে কাগজ কুড়াতে বের হয়, যে ছেলেটা পেটের টানে হোটেলের টেবিল মুছে দেয়, যে ছেলেটা চায়ের কাপ হাত খরিদ্দারের দিকে এগিয়ে যায় -তাদের কাছে বয়স কিছুই না৷ জীবনে দায়িত্বই সব। বেঁচে থাকার তাগিদ আর পেটের ক্ষুধা যে বয়স মানে না!
সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকট শব্দে বিছানায় উঠে বসি। মা বাবার মাথায় ফুলদানি দিয়ে বা'ড়ি মে'রে'ছে। চারদিক র'ক্তে মাখামাখি। বাবাকে বাঁচানোর তীব্র ইচ্ছে অনুভব করছি। কিন্তু শরীরে শক্তি নেই। পরক্ষণেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল। কোথাও কেউ নেই। এটা কোন নতুন সমস্যা না। আগেও আমার সাথে ঘটেছে। বাবাকে সবকিছু খুলে বললাম। তিনি আমাকে এক হুজুরের কাছে নিয়ে গেলেন। হুজুর জানলেন- আমার ওপর কা'লো'যা'দু করা হয়েছে। আমার মাথার চুলে গিট দিয়ে বাড়ির মধ্যে পুঁতে রেখেছে। সেই চুল খুঁজে পেতে হবে। তবেই এই সমস্যার সমাধান মিলবে। চুল না পেলে তার কিছুই করার নেই।
বাবা- মা সারাবাড়ি তনতন করে চুল খুঁজে লাগলেন। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। এক নাগাড়ে বমি করছি৷ ওষুধ ইনজেকশন কোন কাজ করছে না৷ বাবা দৌড়ে জে'লে গেলেন। দিলু কাকার হাত পা ধরে বললেন, "ভাই। আমার মেয়েটার অবস্থা খুব খারাপ। আধুনিক চিকিৎসা কাজে দিচ্ছে না। দয়া করে বল, ওর চুল কোথায় রেখেছিস? তুই যা চাস তাই দেবো। দরকার হলে জে'ল থেকে ছাড়িয়ে নেবো"
প্রতিত্তোরে দিলু কাকা বিশ্রী হাসি হাসলো। কুৎ'সিত মুখে বললো, " পদ্মাকে অন্তঃসত্ত্বা নিয়ে এসেছিলাম, না হলে তোকে এই মেয়ের অ'বৈ'ধ বাবা বলায় কোন বাঁধা ছিল না।"
"তোর যা ইচ্ছে ভাবতে পারিস। শুধু বল, চুল কোথায় রেখেছিস?"
বাবা খুব কাঁদছিলেন। করুণ গলায় বলছিলেন, "বলে দে ভাই। আমার মেয়েটা ম'রে যাবে।"
দারোগা সাহেবও বাবাকে শান্ত করতে পারছিলেন না। বাবার অসহায় কান্নাভেজা মুখটা আজও আমার চোখের সামনে ভাসে। আমি বিশেষ কেউ না, খুব সামান্য একজন মানুষ। তবুও আল্লাহ আমার জন্য এতো ভালোবাসা লিখে রেখেছে। এতো তো প্রয়োজন ছিল না। এর একশ ভাগের একভাগ ভালোবাসা পেলেই তো আমার জীবনটা সুখের হয়ে যেত।
জন্ম না দিলেও যে মা-বাবা হওয়া যায় এরাই তার স্পষ্ট প্রমাণ। সেবার দারোগা বাবু অনেক সাহায্য করেছিলেন৷ চুল পাওয়া গেল বেলি ফুলের টবের মধ্যে। সেই চুল নিয়েও নানান কান্ড! জমজমের পানিতে গোসল করানো হলো আমাকে। অনেক নিয়ম তৈরি হলো- শোবার আগে আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাতে হবে। ফজরের নামাজের পর সূরা নাস আর সূরা ফালাক পড়ে সারা গায়ে ফু দিতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় বাথরুমে বসা যাবে না৷ সেখানে নাকি খবিশ জ্বিন থাকে৷ কি বি'শ্রী নাম! শুনলেই বমি আসে৷ ওয়াক থু!
মা নিয়ম করে এসব মেনে চলতে লাগলেন৷ প্রতিদিন গোসলের পানিতে জমজমের পানি মিশিয়ে দেয়, দোয়াকালাম পড়ে ফু দেওয়া কপ্পুর মিশিয়ে দেয়৷ সেই সাথে আবার আধুনিক চিকিৎসা। নিয়ম করে হাসপাতালে যাওয়া। র'ক্ত পরীক্ষা করা। এমনিই নানান তাল-বাহানা! মেহেদী সাহেবও মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতেন। কেন আসতেন জানা নেই। কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। তিনি আমার সাথে দেখা করতেন না। বাবার সাথে কথা বলে চলে যেতেন। আমার পিছনে পানির মতো টাকা খরচ হয়। বাবা মা নিজেদের সব সঞ্চয় খরচ করে ফেলেছিলেন।
এক সময় আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, "আল্লাহ আমার কথা শুনেছে। এবার সবচেয়ে বড় দায়িত্বটা পালন করতে চাই।"
সবার জীবনেই একটা বিশেষ দিন থাকে। আমার জীবনেও আছে৷ সেদিন বাগানে ছিলাম। শীতল পাটির ওপর বসে গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে থালায় রাখছি। বাবা আমার কাছে এলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, "আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি। ছেলেকে তুই চিনিস। মেহেদী! এখন তোর মতামত থাকলে কথা বাড়াতে পারি।"
আমি কিছু বললাম না। লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "মেহেদী বলেছে সে তোকে খুব বছর করে। প্রথমে আমি রাজি হইনি। ছেলের বয়স বেশি। তারপর মনে হলো বয়স দিয়ে কি হবে। সুখটাই তো আসল। তোকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি। তোর মত থাকলে তখন না হয়। আসলে কি জানিস মা? আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কষ্ট আর নেই।"
"তোমারও কি আক্ষেপ আছে?"
"বহুদিন হয়ে গেছে মা বাবার সাথে দেখা হয়নি। শুনেছি তারা খুব অসুস্থ। মা আমায় খুব ভালো বাসতো জানিস। আমি না খেলে খাবার খেত না। সে-ই মা-ও আমায় ভুলে গেছে৷ ও বাড়িতে গেলেও আমার সামনে আসে না। আদর্শ প্রেমিক, আদর্শ স্বামী হতে পারলেও আদর্শ সন্তান হতে পারিনি।"
মলিন গলায় বললাম, "জীবনে সবকিছু একসাথে হওয়া যায় না বাবা।"
বাবা কাঁদছে। মানুষ এতো সুন্দর করে কাঁদতে পারে? কাঁদলে নাকি মানুষকে ভালো দেখায় না। এই কথাটা সত্যি নয়। বাবা তো খুব সুন্দর লাগছে। যেন কেউ এক নিষ্পাপ বাচ্চার হাত থেকে ফুল কেড়ে নিয়েছে। ফুলের শোকেই তার বিরহ।
আঠারোতম জন্মদিনে মেহেদীর সাথে বিয়ে হয় আমার। পহেলা শ্রাবণ! চারদিকে মেঘের অন্ধকার। বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ। ফুলে সাজানো খাটের মাঝখানে বসে প্রিয় মানুষের প্রতীক্ষা। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হতে চায় না। ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। ঘরের চার কোণে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। ফুলের মিষ্টি গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বিয়ের আগে মেহেদী আমায় একটা চিরকুট দিয়েছিল। তাতে লেখা -'আপনি না হয় বৃষ্টি হয়ে আসুন। যাকে পাওয়াটা রহমত আর ছুঁয়ে দেখা সুন্নাত।'
ধরণীতে আজ বৃষ্টি নেমেছে। মুষলধারা বাদল। মেহেদী জীবনে আমি এসেছি। কে বেশি প্রিয়? ধরনীর কাছে বৃষ্টি নাকি মেহেদীর কাছে আমি? উত্তর জানা নেই। এই উত্তরের অপেক্ষায় গোটা জীবন চলতে হবে। তবুও কি উত্তর পাওয়া যাবে?
বিয়ের চার মাসের মাথায় দারোগা সাহেবের সাথে দেখা করি- তাকে জানাই আমি গোয়েন্দা হতে চাই। অবশ্য ঠিক গোয়েন্দা হতে চাই না। আমি পদ্মকাঁটা হতে চাই। এ দেশের মেয়েদের যারা পা'চা'র করে দেয় তাদের ধরে চৌদ্দশিকের আড়ালে পাঠিয়ে দিতে চাই। এ যে আমার মা'য়ের ইচ্ছে। জন্মদাত্রী মা'য়ের ইচ্ছে। দিলুর শা'স্তি
হয়েছে। ফাঁ'সি হয়নি ঠিকই। তবে খুব কঠিন শা'স্তি বলা চলে। কিছু লোকের শা'স্তির কথা শুনলে এতো আনন্দ লাগে কেন?
সমাপ্ত
No comments